‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’
অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দিন কাটছে ইদানীং। চারদিকে এতো অনুভূতির খেলা চলছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম যাদের জন্য স্বপ্ন দেখছে এই বাংলাদেশ তারা আজ কোন পথে? কতটা অধঃপতন হলে ছাত্ররা শিক্ষককে চক্রান্ত করে ফাঁসানোর মতো চিন্তা করতে পারে? হৃদয় মণ্ডলকে যারা ফাঁসালো তাদের বয়স কত? জীবনের কতটা দেখেছে তারা? কী শিক্ষাইবা পাচ্ছে?
এই ছাত্ররাই একদিন হাল ধরার কথা বাংলাদেশের। তাদের মাথায় তো থাকবে কেমন করে নিজেকে একজন গঠনমূলক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়। তাদের মাথায় থাকার কথা বিশ্ব জয়ের চিন্তা। তারা স্বপ্ন দেখবে কেমন করে বাংলাদেশ একদিন ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জয় করবে আর সেই দিন কেমন করে আনন্দ যাপন করা যাবে সেই দিনের আলাপ। আমাদের সন্তানদের চিন্তা হওয়ার কথা একদিন আমাদের চলচ্চিত্র অস্কার জিতে আসবে। আমাদের সন্তানের চোখে থাকবে জ্ঞানের আলোর জ্যোতি। তারা নিজেদের মধ্যে তর্ক করবে আইনস্টাইন, গ্যালিলিও নিয়ে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে কতটা নিজের করে নেওয়া যায় সেই আশায় বুক বাঁধবে তারা।
কিন্তু হায়!! এ কোন যুগ এলো। এ কোন সময়ের মুখোমুখি আমরা? আমার সন্তান এখন বিজ্ঞানকে তাদের শত্রু মনে করে। যুগের অগ্রযাত্রাকে তারা থামিয়ে দিয়ে পিছনে চলে যেতে চায়। শিক্ষকের সাথে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা নিয়ে আলোচনার বদলে তর্ক করে ধর্মের অপবিশ্বাস নিয়ে। যে শিক্ষককে দেখলে আমরা নতজানু হয়ে যেতাম সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে জেলে পাঠায়।
সৈয়দ শামসুল হল লিখেছিলেন -
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন শকুনি নেমে আসে এই সোনার বাংলায়,
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন শকুনি নেমে আসে এই সোনার বাংলায়,
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন এ দেশ ছেয়ে যায় দালালের আলখাল্লায়,
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়,…
কবিতাটা বড্ড প্রাসঙ্গিক হয়ে গেলো গত কিছুদিনের কিছু ঘটনায়। আজ গোটা বাংলায় যেন শকুনি নেমে এসেছে। সেই শকুনি তার বিষাক্ত ঠোঁট বসাতে চাইছে আমার পতাকায়। আমার সবুজ ধানের ক্ষেতের চিরচিরে বাতাসকে বন্ধ করতে চাইছে। হৃদয় মণ্ডলের মগজকে কিনে নিতে চাইছে। ধর্মের অজুহাতে কেড়ে নিতে চাইছে আলোর রাস্তাকে। অথচ, ধর্ম কোন বিষয় নয়। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই সামনে এগোতে হবে। পিছনে ফিরে যাওয়ার আর কোনো অবকাশ নেই। তবে কারা আমাকে পিছনে ফিরিয়ে নিতে চাইছে? কেন? কারা তারা? আমরা কি জানি এর উত্তর?
সারাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলার পিছনে কারা জড়িত? হৃদয় মণ্ডলকে যারা ফাঁসাতে চাইলো তারা কি এই বাংলায় মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাস করে? যে ছাত্ররা তার শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার মত চিন্তা করতে পারে তারা তো এই দেশ ও জাতির জন্য কলঙ্ক। এমন শিক্ষার কোনো দরকার নাই। এমন কুশিক্ষায় যারা বেড়ে উঠছে তাদের এই মাটিতে বাড়তে দেওয়া মানেই সামনের দিনের মুশতাকের জন্মকে নিশ্চিত করা।
হৃদয় মণ্ডলের জেলে যাওয়া, আমোদিনি পালের বিরুদ্ধে হিজাব নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করা, এর কোনোটাই কি আসলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা? কেমন করে হয়? আসলে তারা টেস্ট কেইস চালাচ্ছে। জাতির নার্ভ চেক করছে। রাষ্ট্র কোন ঘটনায়, কেমন করে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে সেটা দেখছে তারা। আমরা কি মেনে নিচ্ছি না প্রতিবাদ করছি ওজন বুঝে নিচ্ছে। চূড়ান্ত ছোবলের আগে রেকি চালাচ্ছে তারা।
এখনও যদি হুঁশ না ফিরে তাহলে খুব বেশিদিন লাগবে না যেদিন তারা রাস্তাঘাটে ধর্মের ব্যানার নিয়ে নেমে যাবে। একজন কনস্টেবল যখন একজন নারীকে টিপ পরা নিয়ে বাজে কথা শোনায় তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে আমাদের বাহিনীগুলোও মুক্ত নয় সেই ছোবলের হাত থেকে।
বাঙালিয়ানাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে তারা। একজন সৈয়দ শামসুল হক বেঁচে থাকলে হয়তো লজ্জা পেতেন কারণ তারুণ্য আজকে সৈয়দ হক পড়ে না, তাদের আদর্শ হয়ে গেছে একজন প্যারাডক্সিকাল সাজিদ। বইমেলায় ধর্মীয় অনুভূতির অজুহাতে অনেক বইকে নিষিদ্ধ করা হয় অথচ বিজ্ঞানের ভুল ব্যাখ্যা বা ধর্মের নামে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে তরুণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর দায়ে এমন একটি অবৈজ্ঞানিক বইকে বেস্ট সেলার বানানো হয়!
সব ঘটনাই ঘটছে খুব সাজানো নকশায়। এ দেশ আজ দালালের আলখেল্লায় ঢেকে যাচ্ছে। চারদিকের এই অন্ধকারকে ছিঁড়ে ফেলতে আবারও আমাদের একজন নূরুলদীনের দরকার। সাধারণ মানুষ আজ দম বন্ধ পরিবেশে বসাবাস করছে। সবাই অপেক্ষায় আছে একজন নূরুলদীন আসবে যে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা এই জাতিকে টেনে তুলে আনবে আলোর পথে।
আমাদের কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত হয়ে যাওয়ার আগেই রুখে দাঁড়াতে হবে সবাইকে। ঘুমিয়ে থাকার আর সময় নেই। আমার সন্তানদের সন্ত্রাসী হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে হবে। আমার সন্তানদের কূপমণ্ডুক শিক্ষা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। একজন আরিফ আজাদ কেমন করে অতটা শক্তিশালী হয়ে গেলো? গোটা তরুণ সমাজকে কোন পথে নিতে চাইছে তারা? বইবিমুখ জাতিকে তাহলে প্যারাডক্সিকাল সাজিব কেন টানলো? কেন আজ আমরা বিজ্ঞানের এমন কোন আকর্ষণীয় বই লিখতে পারলাম না যা ছাত্রদের মনে প্রশ্ন তুলতে পারে?
আমরা আবার জেগে উঠতে চাই। ’৭১ সালের পরাজিত শক্তিকে বুঝিয়ে দিতে চাই, তাদের সেই পুরোনো চাল এখন অকার্যকর। জাগতে হবে আমাদের। অন্ধকারে বসে থাকলে আলো আসার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। সৈয়দ হকের সেই কবিতার লাইনে আবারও বলতে চাই “জাগো বাহে, কোনঠে সবায়।”
আসুন আমরা সবাই সেই নূরুলদীন হই।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম