ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পাকিস্তান: শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি শেষ?

মোস্তফা হোসেইন | প্রকাশিত: ১০:২১ এএম, ১৩ এপ্রিল ২০২২

গত সপ্তাহটা ছিল পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ সময়। ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি অবলোকন করলো দুনিয়ার মানুষ। যার পরিণতিতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হলো।

একজন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী সেদেশে প্রথম সংসদে অনাস্থাভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা হারালেন। তবে সংসদীয় রাজনীতির বিধান অনুযায়ী বিদায়ের দৃশ্যকে কোনোভাবেই সরল সমীকরণ করার সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীন ইমরান খানের দল এবং বিরোধী দলের যে লড়াই চলছিল তা কিন্তু সংবিধান এবং সংসদীয় রীতিনীতির আলোকে ইতিবাচক ছিল না। শেষ পর্যন্ত সেখানকার সুপ্রিম কোর্টকে নাক গলাতে হয়েছে,সুষ্ঠু সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে।

এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রসঙ্গ আসতেই পারে। ইমরান খানের সুপারিশ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট বাতিল করে যে নির্দেশনা জারি করেছিলেন, তাকে যদি সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী বাতিল না করা হতো তাহলে আজকে হয়তো পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস লিখতে হতো ভিন্নভাবে। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন ডেপুটি স্পিকার যে রুলিং দিয়েছেন সেটি পাকিস্তানের সংবিধানের পরিপন্থি। ইমরান খান সাম্প্রতির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য বিদেশি চক্রান্ত কাজ করছে বলে যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, সুপ্রিম কোর্ট তাকেও ভিত্তিহীন বলে রায় দিয়েছেন।

স্পষ্টত আদালত বলেছেন,ইমরান খানের সুপারিশে প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট বাতিল করেছেন এটা সংবিধানের বিরোধিতা। শুধু তাই নয়,স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয় পার্লামেন্ট অধিবেশন বসিয়ে আস্থা ভোটের আয়োজন করতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী ৯ এপ্রিল সংসদ অধিবেশন ডাকা হয়। কিন্তু তারপরও অনাস্থা ভোটের আয়োজনটিকে পাথরচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। কিছুক্ষণ অধিবেশন চলার পরেই স্থগিত করতে থাকেন স্পিকার।

শুধু তাই নয় সরকার দলীয় সদস্য শাহ মোহাম্মদ কোরেশিকে অস্বাভাবিকভাবে ফ্লোর দিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। পরিস্থিতি দেখে প্রতীয়মান হচ্ছিল সরকারি দল অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠানে মোটেও আগ্রহী নয়। পার্লামেন্টে একের পর এক সাসপেন্স আর উত্তেজনা তৈরি হতে থাকে তখন। সন্ধ্যা যায় যায়, একটা পর্যায় আসে, যখন স্পিকার নিজেই আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে তিনি স্পিকারের পদ থেকে ইস্তফা দিলেন। কৌশলটা ছিল মধ্যরাতের পর সংসদ অভিভাবকহীন হয়ে পড়বে আর আস্থা ভোট অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না এটা তো সবাই জানে। ইমরান খানকে অনাস্থার বিশেষণ কাঁধে নিয়ে বিদায় নিতে হল।

এটাও ঠিক ইমরান খানের বিদায়ের পর পাকিস্তান অনিশ্চয়তার আশঙ্কামুক্ত হয়েছে এটা জোরগলায় বলা যাবে না। বরং বলা চলে ভবিষ্যতে অনিশ্চয়তার দুয়ার খুলে গেল। অন্তত সপ্তাহকাল ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে টালমাটাল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তা বিশ্লেষণ করলে সেই আশঙ্কা ঘনীভূত হতে পারে, এমনটা বললে বেশি হবে না।

রাজনীতির গতি যে কত দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে, সাংবিধানিক ক্রাইসিস যে কতটা গাঢ়তর হতে পারে পুরো পাকিস্তানকে বড় রকমের একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে এই পরিস্থিতি দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকেও জড়িয়ে ফেলেছিল। বিশেষ করে পার্লামেন্ট, সুপ্রিম কোর্ট, প্রেসিডেন্সি,পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলি, নির্বাচন কমিশন ও সর্বশেষ প্রশাসনও দূরে থাকতে পারেনি এই রাজনীতির খেলা থেকে।

যদিও প্রশাসনকে এই রাজনৈতিক খেলার অংশীদার হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখিয়ে দিয়েছে, রাজনীতিতে প্রশাসনও একটি বড় ভূমিকা পালনকারী প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের আমলার ইমরান খানের পক্ষ হয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে দূতিয়ালী করতে দেখা গেছে। তিনি বিরোধী দলকে অনুরোধ করেছিলেন, তারা যেন অনাস্থা ভোট থেকে সরে আসে। ইমরান খান পদত্যাগ করে মুখ রক্ষা করে যাতে বিদায় নিতে পারেন। বাস্তবতা হচ্ছে বিরোধী দলীয় নেতারা তার সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।

অনাস্থার পরিবেশ পাকিস্তানে আগে ১৯৮৯ ও ২০০৬ সালে তৈরি হয়েছিল। অনাস্থা আনাও হয়েছিল। বিশেষ করে ১৯৮৯ সালে বেনজীর ভুট্টোর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা হলে তিনি তা মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ভোট বন্ধ করার কৌশল অবলম্বন করেননি। তার সুফলও পেয়েছিলেন তিনি। সেই যাত্রা তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু ইমরান খান এমন কৌশল নিলেন, যাতে করে পার্লামেন্ট বাতিল করেও নিজের আসনটি ধরে রাখতে পারলেন না।

তিনি সুপ্রিম কোর্টকে পরোক্ষভাবে চ্যালেঞ্জ করার কথাও ভাবছিলেন, এমনটা বলা যায় তাঁর আহুত বিশাল সমাবেশের আয়োজন দেখে। পাশাপাশি তিনি সুপ্রিম কোর্টের রায়েরও সমালোচনা করলেন। অন্যদিকে সংসদে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন এমন আগাম বার্তাকেও তিনি অস্বীকার করেন। তিনি ও তার অনুসারীরা একাক্রমে বলে আসছিলেন,পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র কাজ করছে।

অথচ সপ্তাহকালের জনমত জরিপ করলে দেখা যাবে পাকিস্তানের দুই তৃতীয়াংশ মানুষও তার এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে বিশ্বাস করেনি। ৯ তারিখ পার্লামেন্টে তিনি যে ভাষণ দিলেন সেখানেও তিনি বলেছেন পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র দায়ী। কিন্তু পার্লামেন্টেও তিনি তার এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

তারপরও আপাত সমাধান হিসেবে নতুন সরকারের সৃষ্টিকে বলা যায়। পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজ এর প্রধান শাহবাজ শরিফ সোমবার বিকেলে জাতীয় পরিষদে ১৭৪টি ভোট পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ হারানো ইমরান খানের দলের সদস্যরা তখন অধিবেশন বর্জন করেন। অন্যদিকে অধিবেশন শুরুর আগে পিটিআই পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা সংসদ সদস্য থেকে পদত্যাগ করবেন।

পিটিআই’র সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আবার সৃষ্টি হবে নতুন পরিস্থিতি। ফলে এমনটা বলা যাবে না পাকিস্তানের রাজনীতিতে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। তবে সুপ্রিম কোর্টের রায় এর সুবাদে হলেও পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সংসদীয় বিধান মানার একটা উদাহরণ তৈরি হল তাকেও খাটো করে দেখা যায় না। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে যে রাজনৈতিক টার্ম ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ চলে আসছে, তার আপাত বিদায় লক্ষণ হিসেবে হয়তো স্বীকার করতে হবে। তবে তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে যে চিরতরে এর বিদায় হয়েছে তাও বলা যাবে না।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/জেআইএম