রাজনৈতিক দল ও নেতারা কোথায়?
আমাদের দেশে বড় দুইটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এর বাইরে আরও অনেক দল ও দলাংশ আছে। আছে জাতীয় পার্টি, বর্তমানে সংসদে প্রধান বিরোধী দল। বেশ কয়েকটি বামপন্থী দল ও অন্তত একটি কিছুটা সক্রিয় বাম জোটও আছে, যারা বিকল্পধারার রাজনীতির কথা বলে। কিন্তু সম্প্রতি দেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে, যেগুলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার পরিকল্পিত অপচেষ্টা বলেই মনে হয়। কিন্তু এসব ঘটনা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কোনো কথা নেই।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের দু’চারজন প্রতিদিন প্রতিযোগিতা করে পাল্টাপাল্টি কথা বলেন। তারাও স্পর্শকাতর ওই বিষয়গুলো নিয়ে নীরবতা পালন করছেন। কথায় আছে, নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। তবে কি টিপকাণ্ড, বিজ্ঞান শিক্ষকের নামে অভিযোগ তুলে তাকে জেলে পাঠানো এবং একজন নারী হিন্দু শিক্ষকের বিরুদ্ধে হিজাব পরায় শাস্তি দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তোলার ঘটনাগুলোর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর মৌন সম্মতি আছে? অবস্থা দেখে সেরকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল অবশ্য নীরবতা পালন না করে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের মুক্তির দাবিতে গত শনিবার রাজধানীর শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেছেন , ‘আমরা সব সময় শুনে এসেছি, আমাদের দেশটি একটি জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এর প্রথম ধাপ স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েদের সঠিকভাবে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত করা। ঠিক সেই দায়িত্বটি পালন করতে গিয়েছিলেন হৃদয় মণ্ডল। শুধু এ কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে নেওয়া হয়েছে। এটা আমাদের দেশ, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। এটা কীভাবে সম্ভব?’
হ্যাঁ, এই অসম্ভব কাণ্ডটি সম্ভব হয়েছে গত মাসে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের জবাবে বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের ক্ষেত্রে। মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে যে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে, সেসব তথ্য এখন জানা যাচ্ছে। এলাকার একজন নামী বিজ্ঞান শিক্ষক। তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক।
সম্ভবত এজন্যই তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে কেউ একজন শিক্ষার্থীকে ব্যবহার করেছেন। যদি তা-ই না হবে তাহলে দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান ক্লাসে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করবে কেন? আর কেনই বা শ্রেণিকক্ষে মোবাইল ফোন নিয়ে যাবে এবং শিক্ষকের বক্তব্য রেকর্ড করে তা প্রচারের ব্যবস্থা করবে? এটা তো সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। হঠাৎ করে এটা করা সম্ভব নয়। এরজন্য পূর্বপ্রস্তুতি লাগে। দুরভিসন্ধিমূলকভাবেই সবকিছু করা হয়েছে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা। ২১ বছর ধরে শিক্ষকতা করেন যে ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ কেউ তুললেই সেটা যাচাই-বাছাই না করে মামলা দিয়ে আটক করে তাকে কারাগারে পাঠানো হবে? আদালত যে দুই দফায় তার জামিন নামঞ্জুর করলেন তারই বা ব্যাখ্যা কি? অবশ্য ১৯ দিন কারাগারে থাকার পর ১০ এপ্রিল রোববার হৃদয় মন্ডলের জামিন মঞ্জুর হয়েছে। অবশেষে তিনি মুক্তি পেয়েছেন।
হৃদয় মণ্ডলের স্ত্রী ববিতা হালদার বলেছেন, ‘আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমার ছেলেকে আসামির ছেলে বলে ডাকা হচ্ছে।’ তবে হৃদয় মণ্ডলের পরিবারের সুরক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘হৃদয় মণ্ডলের সঙ্গে কেন এমন হলো, তা তদন্ত করা হচ্ছে। তাঁর পরিবারের সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ মন্ত্রীর নির্দেশ পালনে স্থানীয় প্রশাসন কোনো দুর্বলতা না দেখালেই ভালো।
পানি ঘোলা হওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, ‘আমরা দেখছি ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে অসহিষ্ণু একটা পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্যে হয়তো আরও ভিন্ন অনেক কারণ আছে। আমাদের সেই কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে।’
‘ভিন্ন কারণ’ তো অবশ্যই আছে কিন্তু সেটা খুঁজতে আবার দীর্ঘসূত্রতার নীতি নেওয়া হলে আবারও এমন অঘটন ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়।
দুই.
নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় যে, গত ৬ এপ্রিল বুধবার হিজাব পরে ক্লাসে আসায় ওই স্কুলের কয়েকজন ছাত্রীকে তিনি মারধর ও হেনস্তা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনাটি ভাইরাল হওয়ার পর স্থানীয় পর্যায়সহ দেশব্যাপী এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সরেজমিনে অনুসন্ধানে চালিয়ে এমন অভিযোগের কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। বরং জানা গেছে, স্বার্থের সংঘাত এবং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে এক পক্ষকে কোণঠাসা করতে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা চালিয়েছে অন্য পক্ষ।
স্থানীয় বাসিন্দা, স্কুলের শিক্ষক ও কর্মচারী এবং ঘটনার সময় উপস্থিত একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্কুলে ইউনিফর্ম পরে না আসায় গত বুধবার বারবাকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের অ্যাসেমব্লির সময় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে শাসন করেন সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পাল ও শরীরচর্চার শিক্ষক বদিউজ্জামান। ওই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র ও ছাত্রী উভয়েই ছিল। ছিল কয়েকজন হিন্দু শিক্ষার্থীও। ইউনিফর্ম না পরার শাস্তি হিসেবে ছাত্রদের হাতের তালুতে বদিউজ্জামান এবং ছাত্রীদের হাতে আমোদিনী পাল বেত্রাঘাত করেন। সেখানে হিজাব-সংক্রান্ত কোনো আলোচনাও হয়নি। কিন্তু ঘটনার পরদিন হিজাব পরায় ছাত্রীদের মারা হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। এতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং বিদ্যালয়ে ভাঙচুর করা হয়।
কিন্তু এমন গুজব কেন ছড়ানো হলো- সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, স্কুলটির পরিচালনা কমিটি এবং শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে আমোদিনী পালকে বেকায়দায় ফেলতে পরিকল্পিতভাবেই এটা করা হয়েছে।
বারবাকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ চলতি মাসেই অবসরে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। ধরণীর পর নিয়মানুসারে প্রধান শিক্ষক হবেন আমোদিনী পাল। অবসরে যাওয়ার আগে আমোদিনীর কাছে সব হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে যেতে হবে ধরণী কান্তকে। তখন তার দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হতে পারে বলে শঙ্কায় আছেন তিনি। সেই শঙ্কা থেকেই আমোদিনীর বদলে রবিউল নামে একজনকে প্রধান শিক্ষক পদে বসাতে চান ধরণী। সে জন্য পরিকল্পিতভাবে হিজাব-বিতর্ক তুলে আমোদিনীকে বেকায়দায় ফেলতে চাইছেন তিনি। এ কাজে স্কুলের পরিচালনা কমিটির আহ্বায়কসহ কেউ কেউ ধরণীকে সহায়তা করছেন।
অভিযুক্ত শিক্ষক আমোদিনী পাল বলেছেন‘ধরণী কান্ত তাঁর সময়ের নিয়োগের কোনো হিসাব দিতে পারেননি। আমি প্রধান শিক্ষক হলে আমাকে হিসাব বুঝিয়ে দিতে হবে। তখন তাঁর দুর্নীতি ফাঁস হয়ে যাবে। এ জন্য আমাকে তিনি প্রধান শিক্ষক হতে দিতে চান না। নিজের কুকীর্তি ঢাকতে পছন্দের কাউকে এ পদে বসাতে চান। তাই কৌশলে আমাকে ফাঁসাতে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছেন তিনি।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে যে দুজন শিক্ষার্থীর অভিযোগের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী গত শুক্রবার তাদের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পায়নি। বাড়ির সদর দরজায় তালা ঝুলতে দেখা গেছে। হিজাব-বিতর্ক তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে উপজেলা প্রশাসন। তিন দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
নওগাঁর পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান মিয়া বলেছেন, ঘটনার পর থেকে এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে ও সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে যাতে কেউ আইনশৃঙ্খলার অবনতি না করতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তিন.
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক লতা সমাদ্দারকে কপালে টিপ পরার কারণে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছিলেন এবং পায়ের ওপর মোটরসাইকেল তুলে দিয়েছিলেন পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেক। লতা সমাদ্দার থানায় মামলা করলে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হইচই শুরু হয়।
জাতীয় সংসদেও সাংসদ সুবর্ণা মোস্তফা ঘটনা উল্লখ করে হেনস্তাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলেন। পুলিশ তৎপর হয়ে দুইদিন পর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। কনস্টেবল নাজমুল তারেককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ব্যাপারে গঠিত পুলিশের তদন্ত কমিটিও অভিযোগের সত্যতা পেয়ে কনস্টেবল নাজমুল তারেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে।
নাজমুল তারেক অবশ্য প্রথমে ঘটনা সম্পর্কে অসত্য বয়ান দিয়ে বলেছিলেন, তিনি নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে মোটর সাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। তবে তা যে বানোয়াট, সেটা প্রমাণ তো হয়েছেই উল্টো সিসি টিভি ফুটেছে দেখা গেছে, মোটর সাইকেল চালানোর সময় তার মাথায় হেলমেট ছিল না। ছিল টুপি।
পুলিশ সদস্য হয়ে তিনি হেলমেট না পরে আইন ভেঙেছেন। তিনি নিজেকে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তার হাতে স্মার্টফোন নেই , তিনি টিভি দেখেন না। অথচ নারী বা অন্যধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ পুষে রাখেন অন্তরে। তিনি রাস্তায় মোটরসাইকেলে বসে একজন নারীকে টিপ পরার ‘অপরাধে’ প্রকাশ্যে গালাগাল করতে পারেন। এই ঘটনা নিয়ে টিপ পরার পক্ষে বিপক্ষে অনেকে অনেক কথা বলছেন। ধর্ম বিশ্বাসের প্রশ্নে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা যেমন অনেকের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠছে, তেমনি ধর্মকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতাও বাড়ছে। এগুলো সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
দুঃখজনক এটাই যে, এই ঘটনাগুলো ঘটছে তখন যখন টানা তিন মেয়াদে দেশ শাসন করছে আওয়ামী লীগ। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আওয়ামী লীগ সবসময় বিএনপিকে দোষারোপ করে থাকে। কিন্তু প্রায় ১৩ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় থাকার পরও সাম্প্রদায়িক শক্তির এত উল্লম্ফন কীভাবে ঘটলো? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজা দরকার দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/জেআইএম