ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রমজানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মহৎ উদ্যোগ

মো. সামছুল আলম | প্রকাশিত: ০৯:৪১ এএম, ১১ এপ্রিল ২০২২

একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী, মজুতদার, মুনাফালোভী চক্রের কারসাজিতে রমজান মাসে মাছ, মাংস, ডিম , দুধ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। এ মাসে প্রাণিজ আমিষের বাজারেও যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ঠিক তখনই সুলভ মূল্যে মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এক মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

এ উপলক্ষে গত ৩ এপ্রিল (রোববার) রাজধানীতে সুলভ মূল্যে দুধ, ডিম, পোলট্রি ও মাংসের ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়েছে। ১ রমজান থেকে ১০টি স্থানে শুরু হলেও বর্তমানে রাজধানীর ১৩টি স্থানে ২৮ রমজান পর্যন্ত এই বিক্রয় কার্যক্রম চালু থাকবে। এ কার্যক্রমের আওতায় প্রতিটি ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে পাস্তুরিত তরল দুধ প্রতি লিটার ৬০ টাকা, গরুর মাংস প্রতি কেজি ৫৫০ টাকা, খাসির মাংস প্রতি কেজি ৮০০ টাকা, ড্রেসড ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ২০০ টাকা, ডিম প্রতি হালি ৩০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।এতে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। ফলে প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি কিছুটা পূরণ হবে।
রাজধানীর সচিবালয় সংলগ্ন আবদুল গণি রোড, খামারবাড়ি গোলচত্বর, মিরপুর ৬০ ফুট রাস্তা, আজিমপুর মাতৃসদন, পুরান ঢাকার নয়াবাজার, আরামবাগ, নতুনবাজার, মিরপুরের কালশী, সেগুনবাগিচা, খিলগাঁও , এলেনবাড়ী ,যাত্রাবাড়ী ও জাপানগার্ডেন সিটিসহ মোট ১৩টি স্থানে ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে করে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে ।

গরু ও খাসির মাংস, পোলট্রি, দুধ ও ডিমের সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি সাপ্লাই চেইন সচল রেখে মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রমজান মাসে জনসাধারণ যেন সহজে প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারে, সে লক্ষ্যে ব্যবসায়ী-উৎপাদনকারী-সাপ্লাই চেইন সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এই ভ্রাম্যমাণ বিপণনব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছে।

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প ভ্রাম্যমাণ এ বিক্রয় কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা দিচ্ছে। সুলভ মূল্যে বিক্রির পাশাপাশি যে পরিবহনগুলোয় এই পণ্য বিতরণ করা হচ্ছে, সেগুলো যাতে স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসম্মত হয়, পণ্যে যাতে ভেজাল না থাকে, পণ্য যাতে মেয়াদোত্তীর্ণ না হয়, পণ্য যাতে অস্বাস্থ্যকর ও জীবাণুযুক্ত না হয়, সেজন্য মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং এলডিডিপি প্রকল্প নিয়মিত মনিটরিং করছে।

বিক্রির প্রথমদিন ১০টি গাড়িতে ১০০০ কেজি গরুর মাংস, ৪২ কেজি খাসির মাংস, ব্রয়লার ২৫০ পিস (প্রতিটি এক কেজি করে), ১০০০টি ডিম ও ২০০০ লিটার দুধ বিক্রি করা হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগে ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় ১০টি গাড়িতে এক হাজার কেজি মাংসের পরিবর্তে দেড় হাজার কেজি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ধারণার চেয়ে বেশি হওয়ায় ব্রয়লার মুরগিও ৫০০ কেজি সরবরাহ করা হবে।

খাসির মাংস ১৫০ কেজির পাশাপাশি এখন থেকে তিন হাজার লিটার দুধও সরবরাহ করা হবে। একই সঙ্গে ২০ হাজার ডিম বিক্রয় করা হবে। তবে নিয়ম অনুযায়ী লাইনে দাঁড়ানো প্রত্যেক ব্যক্তি সর্বোচ্চ এক কেজি গরু বা খাসির মাংস, এক কেজি মুরগির মাংস, ডিম এক ডজন, দুই লিটার দুধ কিনতে পারবেন। গত বছর রমজান মাসে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এলডিডিপি প্রকল্প এবং ডেইরি ও পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় সুলভ মূল্যে দুধ, ডিম ও মাংসের ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় ব্যবস্থায় ৩৪ কোটি ৮৫ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭ টাকার পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ৪৭ লাখ ৩১ হাজার ৩১০ জন ভোক্তা ও ৮১ হাজার ৩৭৭ জন খামারি সরাসরি উপকৃত হয়েছেন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঐকান্তিক ইচ্ছায় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তর সংস্থার নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে আজ বাংলাদেশ মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত মাংস ও ডিম এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির পর্যায়ে পৌঁছেছে। পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা মেটানো, বেকারত্ব দূর করা, কর্মদ্যোক্তা তৈরি করা এবং নতুন আঙ্গিকে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখার ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ খাত ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

দেশের মোট জিডিপির ৫ দশমিক ০১ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ৩৭ দশমিক ১৯ শতাংশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান। এর মধ্যে মোট কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান শতকরা ১৩ দশমিক ১০ ভাগ। স্থির মূল্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান শতকরা ১ দশমিক ৪৪ ভাগ। প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৩ দশমিক ৮০ এবং জিডিপির আকার প্রায় ৫০ হাজার ৩০১ দশমিক ৩ কোটি টাকা (বিবিএস-২০২১)। জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ২০ ভাগ প্রত্যক্ষ এবং শতকরা ৫০ ভাগ পরোক্ষ ভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল।

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি খাতকে আরও সমৃদ্ধ করতে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় প্রাণিসম্পদ খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন’প্রকল্পের কাজ চলমান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্পের কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন। প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্পের আওতায় করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫ লাখ ৯৭ হাজার ২৪৯ জন খামারিকে প্রায় ৭শ কোটি টাকা নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া প্রকল্প এলাকায় ৪ হাজার ২০০ প্রাণিসম্পদ সেবা প্রদানকারী (এলএসপি) নির্বাচন করা হয়েছে। ১ হাজার ৫০০ খামারিকে মিল্কক্রিম সেপারেটর মেশিন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১ লাখ ৪৯ হাজারের অধিক খামারিকে যুক্ত করে ৪ হাজার ৫৯৭টি প্রডিউসার গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। এর আওতায় প্রাণিচিকিৎসা খামারির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ৩৬০টি মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক ক্রয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬১টি বিতরণ করা হয়েছে। বাকি ২৪১টি জুন ২০২২ এর মধ্যে বিতরণ করা হবে। এতে প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদন আরও বাড়বে।

এ প্রকল্পের অধীনে সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় স্লটার হাউজ তৈরি করা হবে। একই সঙ্গে প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ নীতিমালা, প্রাণিসম্পদ বিমা নীতি প্রণয়ন, প্রাণী নিবন্ধন ও পরিচিতি দেওয়ার সিস্টেম ও ডাটাবেজ উন্নয়নের কাজ চলছে। এসব উদ্যোগের জন্যই প্রাণিসম্পদ খাতে বিপ্লব এসেছে। এখন কোনো প্রাণী আর আমদানির প্রয়োজন হচ্ছে না। অবৈধভাবে যেনো কোনো প্রাণী আমদানি না করা হয় সে বিষয়েও মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।

মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তর সংস্থার নিরলস প্রচেষ্টার কারণে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে মাংসের উৎপাদন ১০ দশমিক ৮০ লাখ মেট্রিক টন ছিল তা বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৮৫ দশমিক ৪১ লাখ মেট্রিক টন, দুধের উৎপাদন ২২ দশমিক ৯০ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ১১৯ দশমিক ৮৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ডিমের উৎপাদন ৪৬৯ দশমিক ৯১ কোটি থেকে বেড়ে ২০৫৭ দশমিক ৬৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।

২০২১ সালসহ পাঁচ বছর ধরে পবিত্র ঈদুল আজহায় দেশি গবাদি পশু দিয়ে শতভাগ কোরবানির চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। এমনকি গত বছর কোরবানিযোগ্য ২৮ লাখ ২৩ হাজার ৫২৩টি উদ্ধৃত পশু অবিক্রীত ছিল।

করোনাকালেও দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের পুষ্টি নিশ্চিতে করতে এবং খামারী ও চাষীদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে ভিন্ন এক উদ্যোগ নেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। করোনার সময় উৎপাদিত মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য এবং প্রাণী ও প্রাণিজাত পণ্য বাজারজাতকরণে স্থানীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ ও অনলাইন বাজারব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল।

করোনাকালীন ভ্রাম্যমাণ ও অনলাইন বিক্রয় ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রায় ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের মাছ, মাংস, দুধ, ডিম এবং অন্যান্য মৎস্য ও প্রাণিজাত দ্রব্য বিক্রি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের মহৎ উদ্যোগের কারণে দেশের জনসাধারণ উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি দেশের চাষি, খামারি বাচঁবে ফলে দেশও বাঁচবে।

লেখক: গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আরও পড়ুন