ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অনিশ্চয়তায় ইউক্রেইন ফেরত ৫ শতাধিক বাংলাদেশির শিক্ষাজীবন

তানভীর আহমেদ | প্রকাশিত: ০২:০০ পিএম, ০৫ এপ্রিল ২০২২

ইউক্রেইন-রাশিয়া সংকট যে খুব সহসা শেষ হচ্ছে না তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কোন কোন বিশ্লেষক যদিও শুরুর দিকে এই সংঘাত দুই সপ্তাহের বেশি বিলম্বিত হবে না বলে যে অনুমান করছিলেন সেই অনুমান ভুল প্রমাণিত করে সংঘাত ৪০ দিন ছাড়িয়েছে। ইউক্রেইন-রাশিয়ার এই সংঘাতে ৪২ লাখ শরণার্থীর মধ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শরণার্থী প্রায় দেড় হাজার।

সম্প্রতি ইউক্রেইন-পোল্যান্ড সীমান্ত সংবাদ সংগ্রহ করে ফিরে আসার পর থেকেই টেলিফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে বাংলাদেশী শরণার্থীরা তাদের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছিলেন আমাকে। শরণার্থী হওয়া বাংলাদেশিদের একটা বড়ো অংশই শিক্ষার্থী, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর তাদের ভবিষ্যত শিক্ষা জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ থেকে স্বল্প মেয়াদী ভিসায় ইউক্রেইনে পড়াশোনা করতে গিয়ে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ইউক্রেইন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, জার্মানি, পর্তুগাল ও ফ্রান্সের মতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছেন। পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের আশ্রয়ে থাকা প্রায় ৫ শতাধিক অভিবাসী বাংলাদেশিরাও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। পোল্যান্ড দূতাবাসের শেল্টার সেন্টারটিও মার্চের ১৫ তারিখ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করাটাই এখন সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ বলেই মনে হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের তথ্য সহায়তার এই বিষয়টি অনুভব করে গত ১৫ মার্চ যুক্তরাজ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ইউকের উদ্যোগে অনলাইনে একটি কনসালটেশন ও কাউন্সিলিং সেশনের আয়োজন করা হয়েছিলো, সেখানে প্রায় অর্থ শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা যুক্তরাজ্য আইন পেশায় জড়িত রয়েছেন এমন ব্যারিস্টার, সলিসিটর ও একাডেমিকরা শিক্ষার্থীদের পরমর্শ দিয়ে সহায়তা করেন।

অনুষ্ঠানের পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ইউকের আইনজীবীরা যদিও শিক্ষার্থীদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন নিয়মিত তবুও একটি সংগঠনের পক্ষে শত শত শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেওয়াও সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের আরো নানা ধরের জিজ্ঞাসা রয়েছে যা তাদের ভবিষ্যত শিক্ষাজীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মূল জিজ্ঞাসা ছিলো, তারা ইউরোপের দেশগুলোতে ভর্তি হতে চাইলে বা ক্রেডিট ট্রান্সফার করতে চাইলে সেই দেশগুলো থেকে কি ধরনের সহযোগিতা পাবেন।

পোল্যান্ড দূতাবাস বা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের আসলে এধরনের নিয়মিত তথ্য সরবরাহের কোন হটলাইন নম্বর নেই যেখানে শিক্ষার্থীরা চাইলে সরাসরি তথ্য বা গাইডলাইন পেতে পারেন। প্রাথমিক ভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে নম্বর গুলো দেওয়া হয়েছিলো সেগুলো ইউক্রেইন থেকে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের নিরাপদে সরিয়ে আনার সহায়তার জন্য।

অনিশ্চয়তায় ইউক্রেইন ফেরত ৫ শতাধিক বাংলাদেশির শিক্ষাজীবন

এখন যারা নিরাপদে ইউক্রেইন ছেড়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন তাদের পরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা বা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ব্যাপারে সহযোগিতা প্রয়োজন। অনেক শিক্ষার্থী ইউক্রেইনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিউশন ফি দিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, সেই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা এখন বন্ধ। যারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন সেমিস্টারের মাঝামাঝি অবস্থায় ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক তদ্বির প্রয়োজন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথ পার্টনারশিপ করা, যেন ইউক্রেইন ফেরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের দেশে অন্তত ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে বাকি শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়।

ইউক্রেইনের উজহরড ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী ইলমা আজিজ মাহী ও রাকিবা ফারুক চৈতী আমাকে জানালেন, তারা হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মেডিক্যাল কলেজ গুলোর সাথে কথা বলেছেন। হাঙ্গেরির মেডিক্যাল কলেজগুলো শিক্ষার্থীদের গেস্ট স্টুডেন্ট হিসেবে ভর্তির সুযোগ দিতে চায়। এই ক্যাটাগরিতে শিক্ষার্থীরা হাঙ্গেরিতে সাময়িক ভাবে মেডিক্যালের কোর্সগুলো শেষ করতে পারবেন, তবে চূড়ান্তভাবে শিক্ষার্থীদের সনদ দেবে ইউক্রেইনের সংশ্লিষ্ট মেডিক্যাল কলেজ।

দ্বিতীয় অপশনটি হলো শিক্ষার্থীরা চাইলে প্রথম সেমিস্টার থেকে নতুন করে হাঙ্গেরিতে ভর্তি হতে পারবেন। এছাড়াও শিক্ষার্থীরা পুনরায় হাঙ্গেরিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলে তাদের সেখানে ভর্তির সুযোগ দেওয়ার অপশনও রয়েছে। এই সুবিধা গুলোর কোনটাই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত নয় বলেই বলছেন শিক্ষার্থীরা, কারণ ইউক্রেইনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাঙ্গেরি বা পোল্যান্ডের এই অপশনগুলোকে সম্মতি দিচ্ছে না।

অনিশ্চয়তায় ইউক্রেইন ফেরত ৫ শতাধিক বাংলাদেশির শিক্ষাজীবন

তাছাড়া নতুন একটি দেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে সেই দেশের ভাষায় শিক্ষা গ্রহণও সহজসাধ্য নয়। অন্যদিকে হাঙ্গেরির গেস্ট স্টুডেন্ট সার্টিফিকেট দিয়ে ইউক্রেইনের মেডিক্যাল কলেজ চূড়ান্ত সনদ দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে না।

এদিকে ইউক্রেইনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাশ করতে বলছে, কিন্তু মেডিক্যালের মতো প্রাকটিক্যাল ও ল্যাব নির্ভর একটি কোর্স অনলাইনে সমাপ্ত করতে আগ্রহী নয় শিক্ষার্থীরা। তাই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একটা ভালো অপশন হতে পারে তারা যদি বাংলাদেশের পাবলিক বা প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে ক্রেডিট ট্রান্সফারের সুযোগ পায়।

উজহরড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যালের দুই শিক্ষার্থী ইলমা ও চৈতী প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই আবেদন জানিয়ে ইমেইলও করেছেন গত ১৬ মার্চ। চৈতী ও ইলমার সেই বার্তা প্রধামন্ত্রীর দপ্তরে পৌঁছানি বলেই অনুমান করি। আমি ইউক্রেইন ফেরত বাংলাদেশি মেডিক্যালের শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশে ক্রেডিট ট্রান্সফারের বিষয়টি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের কাছে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোন উত্তর পাইনি।

ইলমা আর চৈতীর মতো এমন ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় কতটা চিন্তিত আমার জানা নেই, তবে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইতিমধ্যে তাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৈঠক করেছেন বলে জেনেছি। ইউক্রেইনের টার্নোপিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনির্ভাসিটিতে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ভারোতীয় বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থী পাভেল দাশ আমাকে জানালেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ইউক্রেইন ফেরত ভারতীয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১৬ মার্চের ওই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ভারতীয় শিক্ষার্থীদের পশ্চীমবঙ্গের মেডিক্যাল কলেজে ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে বাকি শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। আর আমাদের ইউক্রেইন ফেরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ইলমা আর চৈতীরা কোথায় গেলে সহযোগিতা পাবেন সেই তথ্য জানতে গত চার সপ্তাহ ধরে ইমেইল চালাচালি করছেন!

অনিশ্চয়তায় ইউক্রেইন ফেরত ৫ শতাধিক বাংলাদেশির শিক্ষাজীবন

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ইউরোপ বা ইউকের বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজে ক্রেডিট ট্রান্সফারের বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নজরে আনতে আমি পোল্যান্ডে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হাসেনের সাথে কথা বললাম, তিনি অবশ্য আমাকে আশ্বস্ত করেছেন শিক্ষার্থীরা যদি আবেদন করেন তাহলে তিনি তাদের ক্রেডিট ট্রান্সফারের বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলবেন।

একটা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যেখানে কোন রকমে জীবন হাতে নিয়ে এক কাপড়ে ইউক্রেইন ছেড়েছেন, এখন সেই শিক্ষার্থীদের দূতাবাস, শিক্ষামন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইমেইল চালাচালি করতে বলা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেইন থেকে বাংলাদেশীদের নিরাপদে সরিয়ে আনতে দূতাবাস ও রাষ্ট্র যেভাবে উদ্যোগ নিয়েছে এখন এই শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে তাদের পুনর্বাসনেও সরকার উদ্যোগী হবে, প্রয়োজনে জুম মিটিং করে শিক্ষার্থীদের কথা শুনুন। আমাদের দূতাবাস বা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এধরনের পাবলিক কনসালটেশনের উইং বা হট লাইন নম্বর রাখা জরুরি, যেখান শিক্ষার্থীরা শিক্ষা বা অভিবাসন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য পাবেন।

সরকারের জনবল সংকট ও সীমাবদ্ধতার বিষয়টি আমরা অনুভব করি তাই প্রয়োজনে শিক্ষামন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস, অভিবাসন বিশেষজ্ঞ, ব্রিটিশ কাউন্সিল বা প্রবাসে সামাজিক সংগঠনগুলোর সাথে যৌথভাবে সমন্বয় করে সরকার ইউক্রেইন ফেরত শিক্ষার্থী ও অভিবাসীদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারে।

লেখক: ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহকারী একাত্তর টিভির সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম