যখন সংস্কৃতিতে ধর্ম ঢুকে যায়…
সংস্কৃতিতে যখন ধর্ম ঢুকে যায়, মানে আপনি যেটিকে সংস্কৃতি জ্ঞানে গ্রহণ করেন সেটিকে যখন কোনো সম্প্রদায় তার ধর্মের অনুষঙ্গ বানায় তখন ওই সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সবাইকে আপনি কাছে পাবেন না। যে হিজাব আপনি স্টাইল হিসেবে পরেন, সেটাকে লোকে স্টাইল ভাববে না, ধর্ম ভাববে। যে টিপ আপনি স্টাইল, সংস্কৃতি, সৌন্দর্য বৃদ্ধির অনুষঙ্গ ভাববেন, আপনার ব্যক্তি স্বাধীনতা ভাবেন- সেটার মধ্যে লোকে ধর্ম খুঁজবে।
পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রায় কুলা, ঢালা, বাঘ, হাতি, বক, বিড়াল মেনে নিবে কিন্তু লক্ষ্মীপ্যাঁচাকে সবাই মেনে নিবে না কারণ তাকে কেউ কেউ পূজা করে। লক্ষ্মী এবং প্যাঁচা কবে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ ছিল, পহেলা বৈশাখের অংশ ছিল? এটাকে শোভাযাত্রায় আনছেন কোন উদ্দেশ্যে- সে প্রশ্ন ভিন্ন ধর্মবাদীরা তুলতেই পারে? মুখোশ যদি হয় দেব-দেবীর আদলে তারও সমালোচনা হবে। অথচ এই সমালোচনাতো হওয়ার কথা ছিল না।
শুধু আমরা কেন, ইসলামী দেশ ইরানে ‘নওরোজ’ পালন তো রীতিমতো শিহরণ জাগানো ব্যাপার। ইসলাম ধর্ম যখন ইরানে তার জায়গা করে নেয় তখন কিন্তু নওরোজকে বাতিল করেনি। আরবে আনন্দ প্রকাশের জন্য উলু ধ্বনি প্রদান করে থাকে। ইসলাম ধর্ম আরবের ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ প্রথা বাতিল করেনি। এখনও সন্তানের জন্ম হলে তারা উলুধ্বনি প্রদান করে। সুতরাং ওলামাদের উচিৎ সংস্কৃতি নিয়ে বাড়াবাড়িতে জড়িত না হওয়া। এটি মূর্তিও নয় অর্চনাও নয়, একটা সংস্কৃতি। ভালো না লাগলে পালন না করেন কেউ বাধা দিচ্ছে না, আপনাকে বাধ্য করছে না।
ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রার করা নির্দেশ দিয়েছিল। সেটি কোনো কোনো ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি পালন করতে না চায় আমার মতে সেখানে চাপাচাপি না করাই ভালো। তবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এর সঙ্গে কোনো আপস চলবে না। হেফাজতি, মারফতি সে যেই হোক- এর সঙ্গে বিরোধে এলে রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করতে হবে। কঠোর সাজা দিতে হবে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রশ্নে আরও বলবো, সংস্কৃতি এক চলমান নদীর স্রোতধারার মতো, এর স্বচ্ছতা থাকলে সবাই সেটা গ্রহণ করবে। দেশ কাল এখানে বিষয় না। পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রার সে স্বচ্ছতা এবং শক্তি রয়েছে বলে সেটি আগামীতে ছড়িয়ে যাবে অন্য দেশেও। কিছু মৌলবাদী মানসিকতার মানুষের, বোমাবাজি করা ছাড়া যাদের অন্য কোনো শক্তি নেই, তারা একে দমন করতে পারবে না, যদি আমরা সতর্ক থাকি। কিন্তু শোভাযাত্রায় যদি ধর্ম ঢুকানোর অপচেষ্টা হয় তাহলে সেটি অন্যায়, এখানেও মুখ খুলতে হবে। নিজে ধর্ম আকড়ে থাকলে, বা প্রগতি-মৌলবাদী থেকে অন্যকে প্রগতিশীল হতে বললে, সেটার ফল এমনই হবে।
সাম্প্রতিক টিপ নিয়ে টিপ্পনির ঘটনা মৌলবাদের আস্ফালন, এর বিরুদ্ধে শুধু ফেসবুকে মাতম তুলে লাভ নেই। এর গভীরতার সন্ধান করুন। মৌলবাদ বিকাশের উৎস, আশপাশের প্রভাব খুঁজুন। ইউটিউবে লোকজন এতো ওয়াজ শুনছে কেন? ‘জয়শ্রী রাম’ কবে সম্ভাষণ, স্লোগান ছিল এই অঞ্চলের এক সম্প্রদায়ের? সব কিছু একসূত্রে গাঁথা। মূল উৎপাটনের চেষ্টা করুন।
বাংলাদেশ সরকার টিপের বিরুদ্ধে নামেনি, যেমনটা কেরালার মুশকানের হিজাবের বিরুদ্ধে নেমেছে তার রাষ্ট্র। আপনিও হয়তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম টেনে আনা, ড্রেসকোডের দোহাই দিয়েছিলেন তখন যখন হিজাবি মেয়েটি ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি তুলেছিল। কিন্তু গুজরাটের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেন মুসলিম শিক্ষার্থীদেরও হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম আনার এই ঘটনা চোখে দেখছেন না আপনি।
ক’দিন আগে যে ঢাকায় একটি হিজাবি নারী বাসের মধ্যে একটি মেয়েকে টি-শার্ট পরার জন্য তীব্র বাক্যবাণে জর্জরিত করছিল, ঘটনা দেখেও বাসে এতোগুলো মানুষ নিশ্চুপ ছিল, তার প্রতিবাদে আপনি টি-শার্ট পরে রাস্তায় নামেননি কেন, ফেসবুকে ছবি দেননি কেন? বাসের ওই মেয়েটির ধর্ম পরিচয় জানেন না বলে? জানলে সুবিধামত মাতম তুলতেন যেমনটা নারায়ণগঞ্জে এক প্রভাবশালী নেতা একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে কান ধরিয়ে উঠবস করানোর পর অনেকে আপনারা রাস্তায় কান ধরে উঠবস করলেন, ফেসবুকে কান ধরার সেই ছবি দিলেন।
তাই বলবো, আগে অন্যের বিশ্বাসকেও মর্যাদা দিতে শিখুন, সংস্কৃতির মধ্যে ধর্ম ঢুকানোর কুমতলব পরিহার করতে বলুন। আপনি নিজে ধর্ম, লিঙ্গ, স্থান, সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় সিলেকটিভ প্রতিবাদী হওয়ার ঢং ছাড়েন, দেখবেন আপনার পাশে সবাইকে পাবেন।
আপনি যখন এসবের বিরুদ্ধে কথা বলবেন না, তখন আপনার-আমার ব্যক্তি অধিকার দিন দিন হারিয়ে যাবে। আর টিপ পরায় শিক্ষিকা লতা সমাদ্দারকে হেনস্তার অভিযোগ উঠবে পুলিশের বিরুদ্ধে, বাসে হিজাবি নারী টি-শার্ট পরা মেয়েকে হেনস্তা করবে প্রকাশ্যে, আর হিজাব পরে স্কুলে আসার অপরাধে মুশকানকে আক্রমণ করতে আসবে গেরুয়া গুণ্ডারা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম