ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

‘টিপ পরছোস ক্যান?’

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ১০:৩৯ এএম, ০৪ এপ্রিল ২০২২

আমরা কি একটা ভয়ঙ্কর সময়ে ঢুকে পড়েছি? গত কয়েকদিনের কয়েকটি ঘটনা আমার মনে বারবার এই প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ছিল উদার, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়।

ধর্মনিরপেক্ষতাকে অনেকে ধর্মহীনতার সাথে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা হলো, সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করার অধিকার। বাংলাদেশ তাই করছিল। বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল সেই উদারতায়। ইসলামের মূল চেতনার সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো বিরোধ নেই।

ইসলাম যার যার ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু মানুষ সবকিছুতে ধর্মকে টেনে এনে ইসলামকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে চাইছেন। ইসলাম সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে। কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ ইসলামকে কঠিন করে দিচ্ছে। ইসলামের সহজ সাবলীল সৌন্দর্যকে এরা নিষেধের বেড়াজালে আটকে ফেলার চেষ্টা করছে।

এই সাম্প্রদায়িক শক্তিটি ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে মিলে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ চালিয়েছে। এসবই তারা করেছে ধর্মের নামে। এভাবেই যুগে যুগে তারা ধর্মকে ব্যবহার করেছে, ধর্মের অবমাননা করেছে।

বিজয়ের পর ধর্মের নামে অধর্ম করা সেই সাম্প্রদায়িক শক্তি গর্তে চলে যায়। কিন্তু ৭৫এর পর তারা দ্বিগুণ শক্তিতে ফিরে আসে। ধীরে ধীরে চলে আসে ক্ষমতার কাছাকাছি। বাংলাকে আফগান বানানোর আকাঙ্খা প্রকাশ্য রাজপথে উচ্চারিত হয়েছে। ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্র এবং সমাজের অনেক অসঙ্গতি দূর করেছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার শিকড় এত গভীরে চলে গেছে, আওয়ামী লীগ পারেনি সেই বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে। বরং ক্ষমতায় টিকে থাকতে কৌশলের আবরণে বারবার আপস করে সেই বিষবৃক্ষে আওয়ামী লীগও প্রকারান্তরে পানি ঢেলেছে।

ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করার সাহস পায়নি আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি হেফাজতে ইসলামের নানা আবদার রাখতে গিয়ে রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ হয়েছে। দুধ কলা দিয়ে পোষা সাম্প্রদায়িকতার সেই কালসাপ এখন সুযোগ পেলেই ছোবল হানছে।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান বারবার আমাদের জাতীয়তাকে শত্রুজ্ঞান করেছে। ধর্ম হলো মানুষের বিশ্বাস আর জাতীয়তা হলো তার মাটি, তার শিকড়। পাকিস্তান বারবার ধর্মীয় জাতীয়তা চাপিয়ে দিতে চেয়েছে এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

পহেলা বৈশাখ পাকিস্তানীদের কাছে আতঙ্ক ছিল, রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে তাদের গা জ্বলতো। বাঙালি সংস্কৃতির সাথে ইসলামের বা কোনো ধর্মেরই কোনো বিরোধ ছিল না, নেইও। যার যার ধর্ম পালন করেও নিজস্ব জাতীয়তা চর্চায় কোনো বাধা নেই। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের স্লোগান ছিল ‘আমরা হিন্দু, আমরা খৃস্টান, আমরা বৌদ্ধ, আমরা মুসলমান; আমরা সবাই বাঙালী।’

মুসলমানের ঈদ, হিন্দুর পূজা, বৌদ্ধের পূর্ণিমা, খৃস্টানদের বড়দিন। কিন্তু পহেলা বৈশাখ সবার, সব বাঙালির। বাঙালি মুসলমান ধর্মীয় চেতনায় ঈদে উৎসব করে, জাতীয়তাবাদী চেতনায় পহেলা বৈশাখ পালন করে। কোনোটার সাথে কোনো বিরোধ নেই।

বাঙালি নারীরা শাড়ি পরে, সুন্দর করে সেজে কপালে একটা টিপ পরে। টিপ ছাড়া বাঙালি নারীর সাজ যেন পূর্ণ হয় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘নীরার জন্য কবিতার ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘বহুদিন পরে তোমার সঙ্গেদেখা হলে ঝর্ণার জলের মতো হেসে উঠবে, কিছুই না জেনে/নীরা আমি তোমার অমন সুন্দর মুখে বাঁকা টিপের দিকে চেয়ে থাকবো।’

যার লেখা গান-গজল ছাড়া বাঙালি মুসলমানের ঈদ পূর্ণ হয় না, সেই কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই/পরি চাঁপা রঙের শাড়ি খয়েরি টিপ/জাগি বাতায়নে জ্বালি আঁখি প্রদীপ/মালা চন্দন দিয়ে মোর থালা সাজাই।’ বাঙালি নারীর সৌন্দর্য ধারণার সঙ্গেই আবহমান কাল ধরে মিশে আছে টিপ। শুধু নারীর সৌন্দর্য নয়, শিশুদের ঘুম পাড়ানি গানেও টিপের প্রবল আধিপত্য, ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা/চাদেঁর কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।’ সেই টিপও এখন সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আক্রমণের লক্ষ্য।

তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দার হেঁটে হেঁটে তার কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। ফার্মগেটে মোটর সাইকেলে বসা একজন পুলিশের পোশাক পরা এক ব্যক্তি তাকে ধমক দেন, ‘টিপ পরছোস ক্যান?’। লতা সমাদ্দার প্রতিবাদ করতে গেলে সেই পুলিশ সদস্য তার গায়ের ওপর দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করেন। লতা সমাদ্দার কোনোরকমে সরে গেলেও পুলিশ তার পায়ের ওপর দিয়েই মোটর সাইকেল চালিয়ে চলে যায়।

লতা প্রতিবাদ করেছেন, থানায় জিডি করেছেন। কিন্তু এই ঘটনায় আতঙ্কটা আরো বেশি। কারণ কোনো নারী রাস্তায় বখাটের হেনস্তা বা ইভটিজিংয়ের শিকার হলে তিনি পুলিশের দ্বারস্থ হবেন। কিন্তু সেই পুলিশই যদি হেনস্তা করে, মানুষ কোথায় যাবে, কার কাছে বিচার চাইবে।

লতা সমাদ্দার জিডিতে মোটর সাইকেলের নাম্বার উল্লেখ করেছেন। সেই বখাটে পুলিশ সদস্যকে ধরা এখন পুলিশের জন্য ঘণ্টার ব্যাপার। অনেক ক্লুলেস খুনের রহস্য উন্মোচন করে পুলিশ বাহিনী আমাদের আস্থা অর্জন করেছে। এখন পুলিশের দায়িত্ব সেই বখাটে পুলিশকে ধরে আইনের আওতায় আনা। একজন পুলিশের জন্য গোটা বাহিনীকে দায়ী করতে আমি রাজি নই।

বা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে আমি বাংলাদেশকেও চিত্রিত করতে চাই না। আমি আশাবাদী কারণ লতা সমাদ্দারের পাশে দাঁড়িয়েছে বিবেকবান সব মানুষ। গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্র নিন্দার ঝড়। এই ঝড়েই আমি আশার আলো দেখি। কে টিপ পরবেন, কে শাড়ি পরবেন, কে জিন্স পরবেন, কে টি-শার্ট পরবেন, কে হিজাব পরবেন; এটা যার যার স্বাধীনতা। রাষ্ট্র কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি, আমরাও যেন না করি।

গণমাধ্যম, আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিবাদকে সংসদে তুলে এনেছেন সাংসদ সুবর্ণা মোস্তফা। সংসদে তিনি বলেছেন, ‘টিপ পরা না পরা নারী সমাজের অধিকার, তা নিয়ে দেশের কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের ইভ-টিজিং বা কুকথা বাংলাদেশের তথা নারী সমাজের জন্য একটি লজ্জাজনক ঘটনা। তা তিনি হিন্দু, মুসলিম বা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান, যে ধর্মের নারীই হোন না কেন। দেশের সংবিধানের কোন আইনে লেখা আছে একজন নারী টিপ পরতে পারবে না? যে কোনো ধর্ম, সে বিবাহিত না অবিবাহিত যাই হোক সেটা তার অধিকার।’

সুবর্ণা মোস্তফার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও অবিলম্বে দায়ী পুলিশ সদস্যের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করছি। এখন পুলিশের দায়িত্ব নিজেদের বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার স্বার্থে দ্রুত যেন অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে আইনের আওতায় আনে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। আর কেউ যাতে রাস্তাঘাটে নারীদের হেনস্তা করতে না পারে, হয়রানির করতে না পারে।
৩ এপ্রিল, ২০২২

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম