ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

লং কোভিড ও করোনার চোখ রাঙানি

ড. মো. হাসিনুর রহমান খান | প্রকাশিত: ০৯:২৫ এএম, ৩০ মার্চ ২০২২

করোনার বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে, করোনা ভীতির ও বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে| আমাদের প্রায় সবারই মনোজগতে বর্তমানে এমন একটি অবস্থার বিরাজ করছে| বিশেষকরে করোনা সংক্রমণের হার এবং মৃত্যু ব্যাপক ভাবে কমে যাওয়ায় অনেকে করোনা মহামারির কথা প্রায় ভুলতে চলেছি| কিন্তু ইতিমধ্যে করোনা আমাদের স্বাস্থ্যের, অর্থনীতির এবং অন্যান্য অনেক কিছুর ব্যাপক ক্ষতি করে গেছে|

স্বজন হারানোর পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে নানা রকম স্বাস্থ্যের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সাধন করেছে, যা লং কোভিড নামে পরিচিত| ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকের এসব ক্ষতির ভার বহন করতে হবে দীর্ঘকালীন সময় করে না হয় আজীবন ধরে| স্বজন হারানো পরিবার কিংবা লং কোভিড ক্ষতিগ্রস্তরা কখনোই এই করোনা মহামারীর কথা ভুলতে পারবেন না|

লং কোভিড এর সার্বজনীন সংজ্ঞা এখনও তৈরি হয়নি| তবে যুক্তরাজ্যসহ কোন কোন দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ১২ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে শারীরিক কোনো সমস্যা বা কোনরকম লক্ষণ যা অন্য কোন রোগের কারণে হয়নি এমন প্রমাণিত হলেই তবে তাকে লং কোভিড বলে গণ্য করা হয়| বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এই সময়টা কে ধরা হয় দুই মাস|

কোভিড এর কারণে দীর্ঘমেয়াদি যে সমস্যাগুলো দেখা দিচ্ছে তাদের মধ্যে হল ক্লান্তি বা মারাত্মক দুর্বলতা (৫১%), বুকে ব্যথা (৩৭%), শ্বাস-প্রশ্বাস ছোট হয়ে আসা (৩৬%), ব্রেইন ফগ বা স্মৃতিশক্তি লোপ বা স্মৃতি জড়তা (২৮%), খাবার স্বাদ কিংবা গন্ধ পরিবর্তন হওয়া, জয়েন্টে জয়েন্টে বা পেশিতে ব্যথা হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য| ছাড়াও রয়েছে পেটের সমস্যা, বুক ধড়ফড় করা, রাতে ঘুম না হওয়া, চোখের পাওয়ারের পরিবর্তন হওয়া, বিষন্নতা, অনীহা, ক্রমাগত কাশি হওয়া, মাথাব্যথা হওয়া, ইত্যাদি|

লং কোভিড এর নানা রকম লক্ষণ বা সমস্যা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা এখনো চলছে| এক গবেষণায় দেখা গেছে করোনাভাইরাস ব্রেইনকে আক্রমণ করে ব্রেইনের আকার ছোট করে ফেলে, অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে ফুসফুস অ্যাবনরমাল করে ফেলে|

এসব সমস্যা আজীবনের জন্য রয়ে যাবে বা কতদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে সে সম্পর্কে এখনো সঠিক কিছু জানা যায়নি, গবেষণা চলছে| লং কোভিড আক্রান্ত রোগীর ডায়াবেটিকস, আয়রন ঘাটতি এবং থাইরয়েড ফাংশন কাজ করছে কিনা বা অন্য কোনো রোগের কারণে এমনটি হচ্ছে কিনা তা পরখ করে নেওয়ার পরেই একজন রোগীর লং কোভিড আছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়|

লং কোভিড কেন হয় এর ব্যাখ্যায় যেটা জানা যায় তা হলো কেউ কেউ প্রাথমিকভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যায় যেখানে ভাইরাস সরাসরি কোন কোন অঙ্গকে আক্রমণ করতে পারে| ভাইরাস যেমন আমাদের কষে ঢুকে কোষকে নষ্ট করে দিচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন লক্ষণ যেমন স্বাদে এবং গন্ধে পরিবর্তন আসা, রক্তের ভেসেল নষ্ট করলে যেমন হার্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে ইত্যাদি| করোনাভাইরাসের মত লং কোভিড কোন ছোঁয়াছে রোগ নয়|

এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে ১৯.৫ লক্ষ এর বেশি সরকারি হিসাব অনুযায়ী শনাক্ত হলেও এদের মধ্যে কোন শ্রেণী, পেশা বা বয়স গ্রুপের মধ্যে লং কোভিড বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে সেটি নিয়ে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণার ফলাফল জানা যায়নি| তবে যুক্তরাজ্যে এক গবেষণায় দেখা গেছে চার সপ্তাহ বা তার বেশি ধরে লং কোভিড এর লক্ষণ গুলো ছিল এমন ১৫ লক্ষ লোকের মধ্যে ৭১% লোকেরই লক্ষণ ১২ সপ্তাহের বেশি ধরে চলছিল, এবং ৪৫% লোকের মধ্যে ওই লক্ষণগুলি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছিল|

আরও দেখা গেছে লং কোভিড এ আক্রান্তদের বেশিরভাগই ছিল ৩৫ থেকে ৪৯ বয়সি, অধিকাংশই মহিলা, এমন সব লোকের সংখ্যাই বেশি যাদের শারীরিক সক্ষমতা আগে থেকেই কম ছিল, এবং যারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক কল্যাণ বা সেবা খাতে চাকুরিরত ছিল, ও যারা দরিদ্র অঞ্চলে বসবাস করত|

অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে ১৮-৪৯ বয়সের করোনা আক্রান্তদের মধ্যে প্রতি ১০ জনে একজন লং কোভিড এ আক্রান্ত হন, যেটি ৭০ বছরের বেশি বয়সিদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে একজন| অমিক্রণ এর আগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে করোনাভাইরাসের আক্রান্তদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত লং কোভিড এ আক্রান্ত হয়| তবে অমিক্রণ সমকালীন পর্বে এ ধরনের গবেষণার ফলাফল এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি|

শিশুরাও লং কোভিড এ আক্রান্ত হতে পারে তবে তাদের তুলনামূলক হার একেবারেই কম| তবে অমিক্রণ এ কারণে ধারাও ভাবে সবাই আক্রান্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে নিতান্তই কম নয়| যুক্তরাজ্যে ডেল্টা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কালীন সময়ের মধ্যে পরিচালিত দুই লক্ষ ১১ থেকে ১৭ বয়সী শিশুদের উপর চালিত এক জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে প্রায় চার হাজার থেকে ৩২০০০ জন শিশু ১৫ সপ্তাহের বেশি ধরে লং কোভিড লক্ষণ বহন করছিল|

লং কোভিড এ আক্রান্তদের যথাযথ শনাক্ত এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য অনেক দেশ তাদের দেশের ভিতরে অঞ্চলে অঞ্চলে আলাদা সেবা কেন্দ্র তৈরি করেছে| গুরুত্ব দিয়ে আমাদের দেশেও একই রকম লং কোভিড আক্রান্তদের শনাক্ত এবং চিকিৎসা সেবা চালু করলে মহামারি নিয়ন্ত্রণের আরেক ধাপ সফলতা অর্জন করা সম্ভব হতো|

অনেক গবেষণায় এটাও উঠে এসেছে যে করোনাভাইরাসের অন্তত ২ ডোজ টিকা গ্রহণ করলে গ্রহণকারীদের মধ্যে করোনাভাইরাস হলে লং কোভিড এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক (অর্ধেক বা তার বেশি) কমে যায়| করোনাকালীন সময়ের মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক টিকা দেওয়ার কারণে এ দিক থেকে আমরা হয়তো কিছুটা সুবিধা পেয়েছি|

আমাদের দেশের মতো বিশ্বের অনেক দেশে অমিক্রণ ভাইরাস এর (মূলত BA2 ধরনটি) ব্যাপকতা গত দুই মাসে কমতে কমতে অনেকটাই স্বাভাবিক হলেও গতবেশ কিছুদিন ধরে কিছু কিছু দেশে অমিক্রণ এর আবারো ব্যাপক বিস্তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে| চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইতালি, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ইত্যাদি দেশে|

অমিক্রন এর পরে নতুন কোন ভয়ংকর ভারিয়ান্ট এর কথা জানা না গেলেও সাম্প্রতিক বিস্তারের দ্রুত ধারা অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে| অনেক গবেষকদের মতে বিদ্যমান অমিক্রণ এর প্রভাবে এসব দেশে করোনার বিস্তার দ্রুত ঘটছে পিছনে থাকা নানা যৌক্তিক কারণে|

বিশেষ করে চীন, হংকং, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড করোনা মহামারী মোকাবেলায় সংক্রমণ বিস্তারের জিরো টলারেন্স নীতি বা জিরো কভিড স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করছিল অনেক আগে থেকেই, অনেক দেশে এখনো বিদ্যমান রয়েছে| অমিক্রণ এর অতি উচ্চ সংক্রমণ শীলতার বৈশিষ্ট্য এই সব দেশের জিরো টলারেন্স ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পেরেছে| যা অনেক আগে থেকেই প্রত্যাশিত ছিল|

ফলে বিস্তারের সূচনা দেরিতে হলেও ব্যাপক বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না| অন্য সব দেশে, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে এর ব্যাপক সুযোগ মিললেও চীনের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়ে প্রাকৃতিক এন্টিবডি তৈরি হবার কোনরকম সুযোগও মিলেনি| এরপরও জিরো টলারেন্স নীতি থেকে সরে না আসা হংকং কিংবা চীনের মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত বলে আমার কাছে মনে হয়|

এছাড়াও হংকংয়ে ৮০ বছরের বেশি অধিকাংশ মানুষ (৬৬%) এখনো কোন ধরনের টিকা গ্রহণ করেননি| ফলে অনেকের মধ্যে এখনো কোনো ধরনের এন্টিবডি তৈরি হয়নি| চীনের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি| চীনে বুস্টার ডোজ এর রেট কমের পাশাপাশি নিজস্ব টিকার কার্যকারিতার ব্যাপারে ধোঁয়াশা থাকায় সম্ভবত তা সঠিক হওয়ায় অমিক্রণকে ঠেকিয়ে দেবার ব্যাপারে প্রকৃতপক্ষে কার্যকরী হতে পারছে না|

যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার সহ পাশ্চাত্যের অন্য দেশগুলিতে ব্যাপক বিস্তারের পিছনে ধারণা করা হচ্ছে মানুষদের মধ্যে প্রাকৃতিক বা টিকা প্ররোচিত এন্টিবডি এর মাত্রা ক্রমশ কমে যাওয়া| কারণ এসব দেশে অনেক আগেই টিকা প্রদান শুরু হওয়ার পাশাপাশি অমিক্রণ এর সংক্রমণও ঘটেছে আগে| ফলে পুনরায় সংক্রমণ ঠেকাতে এই দেশগুলির অনেকে এখন চতুর্থ ডোজ টিকা দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে| পুনরায় ওমিক্রন এর সংক্রমণের বিস্তারের বৃদ্ধির কারণ গুলি সুচারুভাবে পরীক্ষা করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে|

শোনা যাচ্ছে আফ্রিকার দেশ গুলি যেন অবাধে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারত আফ্রিকার সাথে ইন্টার্নেশনাল ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট রোহিত করতে যাচ্ছে| টিকার অভাবের পাশাপাশি অমিক্রনের এক ধরনের আশীর্বাদের কারণেই ইতিমধ্যে আফ্রিকার প্রায় সব দেশে প্রাকৃতিক ভাবে এন্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে| এমতাবস্থায় এভাবে টিকা পাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া চোর পালালে বুদ্ধি দেওয়ার মতো এক হাস্যকর অবস্থার তৈরির নামান্তর|

লেখক: অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান, আই এস আর টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, আই এস আর টি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নির্বাহী কমিটি।

এইচআর/জেআইএম