আমলাতন্ত্রের যাঁতাকলে টিসিবি-বিআরটিএ?
রাজন ভট্টাচার্য
নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ায় আলোচনায় ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। প্রতিদিন টিসিবির ট্রাক সেলে বাড়ছে মানুষের দীর্ঘ লাইন। যুক্ত হচ্ছে পণ্যের দামে নাভিশ্বাস ওঠা মধ্যবিত্তের নতুন নতুন মুখ। সয়াবিন তেল, আটা, চিনি, ডাল নিয়ে প্রতিদিন রীতিমতো কাড়াকাড়ি চলছে। প্রতিটি ট্রাকসেলে ১০ ভাগের এক ভাগ মানুষও পণ্য পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির সেবার পরিধি বাড়ানোর দাবি উঠেছে সব মহল থেকেই। অথচ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ টিসিবি বলছে জনবল সংকটের কথা।
দেশজুড়ে ভাড়া নৈরাজ্য, একের পর াকে সড়ক দুর্ঘটনা আর গণপরিবহন ব্যবস্থাপনায় চরম বিশৃঙ্খলার অভিযোগে সমালোচনার তুঙ্গে রাষ্ট্রীয় পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিআরটিএ)। অথচ সবার অজান্তেই মালিক পক্ষের ইচ্ছেমতো কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেওয়া প্রতিটি রুটের ভাড়ার তালিকা স্বাক্ষর করছে বিআরটিএ। এতো গেলো এক ধরনের বাড়তি ভাড়া আদায়ের কৌশল। এবার বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিয়েও ভাড়ার তালিকা বাসের দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করাতে পারছে না।
এ সুযোগে তালিকার চেয়ে বাড়তি ভাড়া যাত্রীদের থেকে বছরের পর বছর আদায় করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। অথচ লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে দায় সারতে চায় বিআরটিএ। ভাড়া নৈরাজ্য, সড়ক দুর্ঘটনা, গণপরিবহনে যখন গণবিশৃঙ্খলা নিয়ে বেশি হইচই হয় তখন প্রতিষ্ঠানটি লোকবল সংকটের দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করে।
অর্থাৎ দায় এড়াতে টিসিবি ও বিআরটিএ দুটি প্রতিষ্ঠানের কৌশল একই ধরনের। যে দেশে ১৮ কোটি মানুষ, ঘরে ঘরে বেকার। সে দেশে জনবল সংকটের কারণে কোনো প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না এটা কি বিশ্বাস যোগ্য? একটি স্কুলপড়ুয়া শিশুও একথা মানতে চাইবে না। এটাই স্বাভাবিক।
প্রশ্ন হলো বছরের পর বছর এরকম কাল্পনিক, মনগড়া দোহাই দিয়ে সময়ক্ষেপণ করলেও এসব প্রতিষ্ঠানকে বলার মতো কি কেউ নেই। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে তদারকির দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের কানে কি এই বার্তা যায় না? নাকি ভেতরে অন্য কিছু ঘটনা রয়ে গেছে, যা কোনো অবস্থায়ই মিটিয়ে জনস্বার্থে পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তি ও সমষ্টিগত স্বার্থে চাপিয়ে রাখা হচ্ছে? যেন সুযোগে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা যায়। যদি তাই হয় তবে বদনামের ভাগি কিন্তু কেউ হবে না। দায় সরকারের ওপরই এককভাবে বর্তাবে। অথচ ইচ্ছা করলেই কিন্তু জনবল সংকট মিটিয়ে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট এই দুটি প্রতিষ্ঠান সব মানুষকে সেবার আওতায় আনতে পারে। সঠিক দায়িত্ব পালনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার পাশাপাশি চলমান সব সংকট অনেকাংশে নিরসন করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ এর হিসাব বলছে, দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। শ্রমশক্তির মোট পরিমাণ ৫ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে ৫ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার জন। এর অর্থ বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ ৮০ হাজার। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির তথ্য মতে দেশে বেকারত্বের যে হার দেখানো হয়, সেটা সঠিক নয়। ১৮-২৮ বছর বয়সী যে সংখ্যক যুবক আছেন, তাদের তিনজনে একজন বেকার। শিক্ষিত বেকার হয়তো দুজনে একজন।
লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুজনে একজনের নাম বেকারের খাতায়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে।
দেশে কোভিড পরিস্থিতি সামলাতে সবার জন্য গণটিকা কার্যক্রম শুরু করে সরকার। ইতোমধ্যে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষকে করোনার দুই ডোজ বা সম্পূর্ণ টিকা দেওয়া হয়েছে। গত ১০ মার্চ পর্যন্ত সম্পূর্ণ টিকা পেয়েছে ৫১ দশমিক ৫৪ শতাংশ মানুষ। লক্ষ্যমাত্রার জনসংখ্যার মধ্যে সম্পূর্ণ টিকার আওতায় এসেছে ৭৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ টিকার (জন হিসাবে) বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশ আট নম্বরে উঠে এসেছে। সরকারি হিসাবে দেশে মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩ লাখ ১৭ হাজার ৭৭ জন।
দেশে তো এত ডাক্তার নেই, নার্স নেই, স্বাস্থ্যকর্মী নেই। তাহলে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে টিকাদানে কীভাবে সফলতা এলো? গণটিকা কার্যক্রমের শুরু থেকেই এর সঙ্গে স্কাউট, বিএনসিসি, রেডক্রসসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে যুক্ত করা হয়েছে। যার ফলাফল এই অর্জন।
জাতীয় যে কোনো সংকট, দুর্যোগে সবাই মিলে কাজ করতে হয়। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য, দুর্ঘটনা, সড়কে বিশৃঙ্খলা এটিও জাতীয় সমস্যা। এটিকে কোনো ভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আর নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কোভিডে চাকরি হারানো আড়াই কোটিসহ নাভিশ্বাস ওঠেছে স্বল্প আয়ের মানুষের। এটিও জাতীয় সংকট। কুপি বাতি দিয়ে যেমন মুক্তাঞ্চল আলোকিত হয় না তেমনি সামান্য কটা ট্রাক সেল দিয়ে সব মানুষের কাছে দামি পণ্য পৌঁছানো যাবে না। এতে প্রতিদিনের ঘটনা মারামারি হবেই। পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরবে বেশি মানুষ।
রাজধানী ঢাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস। এই শহরে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ট্রাকসেল পয়েন্ট ৫৯টি। দক্ষিণে মাত্র ৭৭টি। এর মধ্যে ট্রাক আসার নির্দিষ্ট সময় থাকে না। প্রতিদিন এক জায়গায় আসছে তাও সঠিক নয়। তাই ট্রাকসেল বাড়ানো জরুরি এতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও টিসিবি বলছে, রমজানে গুরুত্বপূর্ণ চারটি নিত্যপণ্য কোটি মানুষের হাতে তুলে দিতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।
কথা হলো জনবলের যদি ঘাটতি থাকে তবে তখনও থাকবে। এখন না পারলেও আগামী দিনে পেরে ওঠা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। তবে রমজানে পারলে এখন কেন নয়? সবচেয়ে বড় কথা হলো টিসিবি বা বিআরটিএ কারা চালায়? আমলাদের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু। দুটি সেবা সংস্থার কাজের পরিধি বাড়াতে রাজনৈতিক চাপ মাঝে মধ্যে সৃষ্টি হলেও আমলাদের কলম ঘুরে অফিসের নিয়ম আর স্বার্থের হিসেবে। নিয়মের মারপ্যাচে সমস্যার আর সুরাহা হয় না। প্রতিষ্ঠানে জনবল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখে না। এভাবেই চলে আসছে বছরের পর বছর। তাহলে কি তারা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসব সমস্যা জিইয়ে রাখতে চায়। এমন কি হতে পারে সংকটের সমাধান না করে পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের উদ্দেশ্য রয়েছে?
তা না হলে লোকবল বাড়াতে আসলে সমস্যা কোথায়? প্রতিষ্ঠানে জনবল বাড়ালে কাজের বিকেন্দ্রীকরণ হয়। এতে সেবার সুবিধাভোগী বাড়ে। আর সংকট থাকলে কাজের চাপ বেশি থাকে। মানুষ দুর্ভোগের শিকার হয়ে তিন টাকার বৈধ কাজ ৫০০ টাকায় করাতে বাধ্য হন। এতে নিজের স্বার্থ হাসিল হয়। নিজের লোকজনও ভালো থাকে।
এই সিন্ডিকেট চক্রকে আসলে ভাঙতে হবে। তারা যতোই শক্তিশালী হোক, সবার আগে দেশ ও মানুষের স্বার্থ। আমলানির্ভর মানসিকতায় সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হবে? বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে এটা তো মেনে নেয়া যায় না।
আমলাদের যদি স্বার্থই না থাকে তবে দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার চাকরির আশায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে না। রাষ্ট্রের যদি আর্থিক সংকট থাকে তবে চাকরি স্থায়ী না করে প্রকল্পের আওতায় তো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
পরে পর্যায়ক্রমে তাদের রাজস্ব খাতে নেওয়া কঠিন কিছু নয়। ফলে শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বেকারত্বের অভিশাপ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারে। হতাশার জীবন চক্র থেকে বেরিয়ে আলোর দিকে আসতে পারে। পরিবার হতে পারে সচ্ছল তেমনি সবার মুখে হাসি ফোটানো যায়। তাই আমলাতান্ত্রিক ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে দুটি প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি জনস্বার্থে কাজে লাগানো এখন সময়ের দাবি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম