ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কী অদ্ভুত বৈপরীত্য!

মোকাম্মেল হোসেন | প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ১৮ মার্চ ২০২২

ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেছে। রাজনীতির মাঠ এখন শান্ত। কাজেই রাজনৈতিক আগুন এ ধোঁয়ার উৎসমূল নয়, তা স্পষ্ট। প্রভাবশালীদের ভাড়াটে লোকজনের দেয়া আগুন মাঝেমধ্যেই রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি খেয়ে ফেলে। এ ধোঁয়ার উৎপত্তিস্থল কি কোনো বস্তি?

আশেপাশে কোনো বস্তি আছে কি-না, মনে করার চেষ্টা করলাম। মনে পড়ছে না। আগে এখানে একটা বস্তি ছিল। এর নাম ছিল টিক্কাপাড়া বস্তি। আদাবর এলাকার সেই টিক্কাপাড়া বস্তি এখন খেটে খাওয়া কিছু সাধারণ মানুষের কষ্টস্মৃতি। টিক্কাপাড়া বস্তিকে আগুন গিলে খাওয়ার পর সেখানে কয়েকটা সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ করা হয়েছে। বস্তির বাইরে আগুনের শিকার হওয়ার তালিকায় রয়েছে পোশাক কারখানার নাম।

এ এলাকায় বেশ কয়েকটা পোশাক কারখানা রয়েছে। সেখানে কি কোনো দুর্ঘটনা ঘটল? এসবের বাইরে ইদানিং তালিকায় যুক্ত হয়েছে গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে আগুন লাগার ঘটনা। ধোঁয়ার জন্মস্থান আমার নিজের রান্নাঘর নয় তো! এ রকম নানা আশংকা মাথায় নিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দেয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি, দরজায় লবণ বেগমের ছায়া পড়ল। ভ্রাম্যমাণ তরকারি বিক্রেতার কাছ থেকে কিনে আনা আনাজপাতি মেঝের ওপর রেখে হা করে দম ছেড়ে লবণ বেগম বলল-
: একটু যে নিচে যাবা...
তরি-তরকারিগুলোর দিকে তাকালাম। প্রায় এক মিন্তির বোঝা। নিচতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত এসব বয়ে আনা একজনের পক্ষে সহজ কাজ নয়। আহা রে! বেচারির নাক ও কপাল থেকে ঘাম ঝরছে। নীরবে গড়িয়ে পড়া ঘামের মিছিল দেখে অপরাধবোধে আক্রান্ত হলাম। আদ্র গলায় বললাম-
: বল নাই তো!
: বললে মনে হয় চাইরতলা থেইকা লাফ দিতা!
: লাফ না দিলেও দৌড় দিতাম, এইটা নিশ্চিত।

চোখের নিজস্ব একটা ভাষা আছে, যে ভাষার আশ্রয় নিয়ে মানুষের চোখ রাগ-অনুরাগ, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-ভয়, অনুযোগ-অভিযোগ-উপহাস ইত্যাদির প্রকাশ ঘটায়। লবণ বেগম চোখের ভাষায় উপহাসের প্রকাশ ঘটিয়ে বলল-

: বলব, তার পরে দৌড় দিবা! বিষয়টা মন্দ না। টেলিভিশনে একবার দেখছিলাম, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিউবা সফরকালে তার বউয়ের মাথায় ছাতা ধইরা রাখছে। ওবামার বউ নিশ্চয়ই তার স্বামীরে বলে নাই- প্রিয়নাথ, আমার মাথার উপরে ছাতা ধরো। বিশ্বের এক নম্বর দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করার পরেও বউয়ের প্রতি তার কী কর্তব্য, সেইটা ওবামারে বইলা দিতে হয় না। আর তুমি মগন লাল ঠাকুর- তোমারে আগে নোটিশ করন লাগব; তার পর তুমি আমার দিকে হাত বাড়াবা!

জীবনের বাঁকে-বাঁকে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন ধরনের উপাধি ও বিশেষণ পেয়েছি। এই প্রথম ঠাকুর উপাধি পেলাম। নতুন উপাধি পেয়ে খারাপ লাগছে না। ঠাকুরদের বরাবরই রমরমা অবস্থা। নতুন উপাধি লাভ করার উসিলায় পাতে দুধের সর, মাখন ইত্যাদি পড়লে মন্দ হবে না ভেবে সুখ অনুভব করছি, এ সময় লবণ বেগম বাতাসে নাক শুঁকতে শুঁকতে বলল-
: তুমি আবারও ময়লার ঝুড়িতে বিড়ির মুতা ফেলছো?
: আরে ধুর! আমি ওইসবের ধারেকাছেও যাই নাই।
: সত্য?
: অবশ্যই সত্য।

লবণ বেগমের সংশয় তবুও কাটে না। ছেলেরা যতক্ষণ থাকে, তততক্ষণ বাসা ধূমপানমূক্ত এলাকা। ছেলেরা এখন স্কুলে। বাসা ফাঁকা পেয়েও তামাক দেবীর ভজন করিনি; মনে হচ্ছে, এটা মানতে লবণ বেগমের কষ্ট হচ্ছে। সে হঠাৎ আমার মুখের কাছে তার মুখ এনে বলল-

: হা কইরা দম ছাড়ো তো।
নির্দেশ পালন করলাম। ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় ধূমপানের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। লবণ বেগমের কাজকর্ম দেখে খুব হাসি পাচ্ছে। তাকে বললাম-
: ভালুকের মতো মানুষের নাক-মুখ না শুঁইকা রান্নাঘরে যাইয়া ময়লার ঝুড়ি দেখলেই তো হয়!
লবণ বেগম রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল-
: উহুঁ! এইখানে আগুন নাই।

আগুন ও ধোঁয়া একই মায়ের পেটের যমজ দুই ভাই। আগুনের অস্তিত্ব না থাকলে ধোঁয়াও থাকার কথা নয়। তাহলে ধোঁয়াটা আসছে কোথা থেকে? এ ঘর ও ঘর তালাস করে বারান্দায় আসার পর বিষয়টা পরিষ্কার হলো। লবণ বেগমকে ডাক দিলাম। সে বারান্দায় আসার পর বললাম-
: দেখো, ধোঁয়ার বাড়ি কোথায়?
ধোঁয়ার বাড়ি হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের উন্মুক্ত ডাস্টবিন। সকাল থেকে এ পর্যন্ত ডাস্টবিনে যত ময়লা জমা হয়েছে, সেগুলো আবর্জনাবাহী যানবাহনে ভরে সরানোর চেয়ে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলার সহজ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। এভাবে জনবহুল আবাসিক এলাকার ডাস্টবিনে জমা হওয়া আবর্জনা পুড়িয়ে ছাই করার নজির বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। পাশ থেকে লবণ বেগম বলল-

: ডাস্টবিনটা আগে এইখানে ছিল না। এইখানে আনছে কী জন্য?
প্রতিটি স্থানান্তরের একটি ইতিহাস থাকে। এ ডাস্টবিনেরও আছে। ডাস্টবিনটা আগে ছিল হক সাহেবের গ্যারেজ বলে পরিচিত এলাকার সামনের একটা ফাঁকা জায়গায়। একদিন দেখা গেল, সেখানে একটা সুপার শপের পত্তন হয়েছে। গুটিকয় বিত্তশালীর নাক এবং সুপার শপ মালিকের ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে ডাস্টবিনটা এমন জায়গায় এসে আসন গেড়েছে, যার পাশে রয়েছে একটা বিদ্যালয়। যারা ম্যানেজ করেছেন এবং যারা ম্যানেজড হয়েছেন, কেউই এ বিদ্যালয়ের কথা, শিক্ষার্থীদের কথা ভাববার প্রয়োজন মনে করেননি। কী আশ্চর্য কথা!

লবণ বেগম কি আমার ভাবনা টের পেয়ে গেল! আমার ভাবনাগুলোর সঙ্গে তার মুখের কথা মিলে যাওয়ায় অবাক হলাম। লবণ বেগম বলল-
: একটা স্কুলের গেটের পাশে এইরকম উন্মুক্ত ডাস্টবিন বসাইছে। সেখান থেইকা ময়লা-আবর্জনা উপচাইয়া পড়তেছে। আর এর মধ্য দিয়াই স্কুলের পোলাপান নাক-মুখ চাইপ্যা সকাল-বিকাল আসা-যাওয়া করতেছে। এইসব দেখার জন্য একজন মানুষও কি এই দেশে নাই? আইচ্ছা, মানুষের কথা বাদ দিলাম। আমাদের নির্বাচিত মেয়রসাব কার মাথার উঁকুন বাছেন, যে এইসবের তত্ত্ব-তালাস করার সময় পায় না?

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অভিভাবক এখন দু’জন। এক বধূর দুই স্বামী থাকলে সেই বধূকে ঘিরে তাদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার প্রতিযোগিতা লেগে থাকে, ঢাকার ক্ষেত্রেও তাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। দুই প্রেমিকই চান-তাদের ভালোবাসার ধন ভালো থাকুক, সুন্দর থাকুক। ঢাকাকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে দু’জনই আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। নগরবাসীকে ময়লামুক্ত থাকার তালিম দিচ্ছেন। অথচ ময়লা-যন্ত্রণায় একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিত্যদিন দগ্ধ হচ্ছে, এটা দেখার সময় বা ব্যবস্থা, কোনোটাই নগরপিতাদের নেই। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! এ ধরনের বৈপরীত্য মনে হয় কেবল এদেশেই সম্ভব।

আগের কথার সূত্র ধরে লবণ বেগম বলল-
: নির্বাচনের আগে 'ঢাকা আমার ঢাকা, ঢাকা ছাড়া সবই ফাঁকা' বইলা এই যে মেয়রসাবরা নির্বাচিত হইলেন, তাদের কাজকর্ম আর অতীতের কাজকর্মের মধ্যে তো কোনো তফাৎ দেখতেছি না। এখনও দিনের বেলায় যখন-তখন ময়লার গাড়ি লেদাইতে লেদাইতে জনাকীর্ণ রাস্তা দিয়া হামাগুড়ি দেয়।

প্রতিটা ডাস্টবিনে আগের মতোই ময়লা উপচাইয়া পইড়া থাকে। সেইখানে কুকুর-বিলাই, কাউয়া ও মানুষ পাড়াপাড়ি করে। ফুটপাত-রাস্তা আগের মতোই বেদখল। ড্রেন থেইকা উঠানো ময়লা আগের মতোই রাস্তার পাশে পইড়া থাকতে থাকতে আবার ড্রেনে গড়াইয়া পড়ে। এই যে এতসব স্লোগান, এতসব গান-বাজনা, ভাষণ-অভিভাষণ হইল, তার রেজাল্ট কী?
: ধৈর্য ধরো। রেজাল্ট পাইবা।
: কবে?
: পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটা শেষ করতে দেও। পরিকল্পনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন শুরু হইয়া যাবে।
: ততদিনে তো পাঁচ বছর চইলা যাবে!
: তাতে কোনো সমস্যা নাই। পাঁচ বছর পরে আবার পাঁচ বছর আসবে। আবার তারা বাদ্য-বাজনা সহকারে ভোটারদের বোঝাবেন-ভাইসব, শত বছরের পুরাতন জঞ্জাল পরিষ্কার করা খুব কঠিন কাজ। বিগত পাঁচ বছর এইসব লইয়াই ঘাম ঝরাইছি। কোনদিক দিয়া যে পাঁচ বছর কাটছে, টেরও পাই নাই। তবে এইবার আর কোনো টেনশন নাই। পরিকল্পনা কমপ্লিট। এইবার শুধু বাস্তবায়নের পালা। শুধু কাজ আর কাজ। ব্যালটের মাধ্যমে আমাদের কাজ করার সুযোগ দেন; দেখবেন, কাজ কইরা ফাটাইয়া ফেলব।
লবণ বেগম চিন্তিত মুখে বলল-
: কী ফটাইয়া ফেলবে?
: এইটা তো বলা যাবে না। বুইঝা নিতে হবে।
: বুঝতে পারতেছি না।
আপনমনে কিছুক্ষণ হাসলাম। তারপর লবণ বেগমের সহজ-সরল মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম-
: না বুঝতে পারলেও ক্ষতি নাই। সবাইকে সবকিছু বুঝতে হবে, এমন কথা কি আমাদের সংবিধানের কোথাও লেখা আছে?

লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।
[email protected]

এইচআর/এমএস