ইউক্রেন পরিস্থিতি ও নিজ চরকায় মনোনিবেশ ভাবনা
ইউক্রেনে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সরগরম এখন বিশ্ব মিডিয়া। গরম গরম সব পোস্টে সরগরম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও। যুদ্ধের উত্তাপ সুদূর ইউরোপ থেকে এমনকি এই বাংলাদেশেও ইদানীং এমন উত্তাপ ছড়াচ্ছে যে আমাদের দেশের শীতকালীন নব্য কালচার ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলগুলোতেও ঘুরে-ফিরে উঠে আসছে ইউক্রেন প্রসঙ্গ। সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে বাঙালির উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত চটকদার সব জোকস। এর মধ্যে একটা জোকস ভালোই মার্কেট পেয়েছে বলে ধারণা করছি, কারণ এটিকে একাধিক গ্রুপে শেয়ার হতে দেখলাম।
জোকসটা অনেকটা এরকম- রাশিয়ান মিলিটারির ৪০ কিলোমিটার লম্বা একটা আর্মড কলাম ঢাকার দিকে ধেয়ে আসছে। গাজীপুরে পৌঁছাতেই থমকে গেল কলামটি। প্রচণ্ড জ্যামে পড়ে ভেস্তে যাওয়ার দশা রুশদের ঢাকামুখী সামরিক অভিযাত্রার।
অন্য আরেকটি জোকসও বেশ চটকদার, তবে সম্ভবত ততটা মার্কেট পায়নি। জোকসটি হচ্ছে করোনার কারণে মার্কিনি আর ইউরোপিয়ানরা ঘরে বসে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হুজুররা অন্যদিকে বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে ভারী ভারী সব বয়ান করছেন, যার মূল প্রতিপাদ্য প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের সমর্থক ইউক্রেনের রাশিয়ার কাছে অমন ধোলাই খাওয়ায় তারা বেশ পুলকিত। কিছু কিছু ওয়াজ শুনে মনে হয়েছে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন যদি এই মুহূর্তে ঢাকায় আসতেন তবে লাখো তৌহিদি জনতার ভালোবাসায় তাকে অতি অবশ্যই সিক্ত হতে হতো।
আমাদের দেশে রুশ-ইউক্রেন সাম্প্রতিক এই কনক্লিক্টে সমর্থনের পাল্লাটা রুশদের দিকেই অবশ্যই ভারী। যার কারণটা সহজবোধ্য হলেও, কখনো কখনো আবার দুর্বোধ্যও বটে। এমনিতেই একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে রুশদের নিস্বার্থ অবস্থান, বাংলাদেশের সপক্ষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রুশ ভেটো আর শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানকে বাঁচাতে যখন বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর, তখন তাদের বিরুদ্ধে রুশ নৌবহরের বঙ্গোপসাগরের দিকে ধেয়ে আসা কিংবা যুদ্ধ-পরবর্তী সময় পাকিস্তানিদের পেতে রাখা মাইনে অচল চট্টগ্রাম আর মংলা সমুদ্রবন্দরগুলোকে মাইনমুক্ত করে পুরনায় চালু করায় সোভিয়েতদের অবদান, এসব কোনো কিছুই বাঙালি ভুলে যায়নি।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই তাই ‘বাই ডিফল্ট’ রুশ সমর্থক। তাছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক মোড়লগিরি, ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়ার সাজানো সংসার তছনছ করে দেয়া মার্কিন পলিসি কিংবা ইসলায়েলের পক্ষে তাদের একচোখামী, এসবের কোনো কিছুই বিশ্বের অন্যান্য আরও অনেক অঞ্চলের মতোই এদেশের মানুষও ভালোভাবে নেয়নি।
দুই.
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি আছে বিস্তর। সেই যুক্তি-তর্ককে আরেকটু উসকে দেওয়াটা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি সরলভাবে যেটুকু বুঝি, প্রত্যেক রাষ্ট্রই চাইবে তার নিজের ভালোটা বুঝতে, নিজের পাওনাটা কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিতে। নিজ স্বার্থটাকে সংরক্ষণ করে বৃহৎ প্রতিবেশীর সাথে ভারসাম্য রেখে চলার জন্য প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দক্ষতার। বিশেষ করে যেসব দেশের অবস্থান ভৌগোলিকভাবে ইউক্রেনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ, তাদের জন্য এ বিষয়টি অনেক বেশি প্রযোজ্য।
আমি কোনো পক্ষ-বিপক্ষ আর যুক্তি-তর্কে না গিয়ে যা মনে করি তা হচ্ছে ইউক্রেনের আজকের পরিণতির জন্য অনেকাংশেই দায়ী দেশটির অদূরদর্শী নেতৃত্ব। একজন কমেডিয়ান মানুষকে আমোদিত করতে পারেন ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা আর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বকে যদি তিনি কমেডি বলে মনে করে বসেন তাহলে সে দেশের পরিণতি ইউক্রেনের চেয়ে ভালো কিছু হওয়ার কথা নয়। রাশিয়ার কোলের ভেতর বসে ইউক্রেনের কমেডিয়ান টার্নড রাষ্ট্রপতি জেরুলস্কির মতো ন্যাটোতে যোগ দিয়ে মার্কিনিদের জন্য মস্কোর রাস্তাটা অমন মসৃণ করার উদ্যোগ নেন তখন সম্ভবত আর কোনো যুক্তি-তর্কেরই ধোপে টেকার সুযোগ থাকে না।
তিন.
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ইউক্রেনের চেয়েও স্ট্রাটেজিক। দুপাশে দুই উদীয়মান পরাশক্তিকে ভারসাম্যে রেখে দেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ভারসাম্যটা কোন কারণে বিনষ্ট হলে তা এদেশের জন্য কখনই মঙ্গলকর হবে না। ইদানীং ইউক্রেন নিয়ে আমাদের বলাবলি আর লেখালেখিগুলো অনেক সময়ই এই ভারসাম্যের জন্য কিছুটা হলেও ক্ষতিকর বলে অনেক সময়ই মনে হয়।
অনেককেই দেখছি ইদানীং খুঁচিয়ে গন্ধ ছড়ানোর চেষ্টা করতে। সংবাদ সম্মেলন করে বন্ধুপ্রতীম দেশের রাষ্ট্রদূতকে বাঁকা-চোখা প্রশ্ন করে সস্তায় পয়েন্ট কামানোর ফলাফল সব সময় ভালো নাও হতে পারে। আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা নিজের স্বার্থে এই ইস্যুটিকে ইস্যু বানাতে গিয়ে কখন যে কোনো বিপদ ডেকে আনেন কে জানে? আমাদের কপাল ভালো আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জেরুলোস্কি নন। দেশ সামলানোর কাজটা তার কাঁধে ছেড়ে দিয়ে বাকিরা আপাতত যদি নিজ নিজ চরকায় তেল দেই, সেটাই বোধকরি আমাদের সবার জন্য মঙ্গলজনক।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম