জাহাঙ্গীরনগরের ‘বিতর্কিত নৃত্য’ শ্লীল নাকি অশ্লীল?
এখন ভিডিও ভাইরালের যুগ। আবার বাজে জিনিসে লোকের আগ্রহের মাত্রাও বেশি। তাহলে কী নিয়ে এতো মাতামাতি? কী হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে?
খোঁজ নিয়ে জানলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগ-ডেতে তরুণ তরুণীরা আনন্দ করেছে। নৃত্য করেছে। কাপল ড্যান্স। অনেকটা ব্যালের ধাঁচে পশ্চিমা ঢঙে। তাই নিয়ে এমন মাতামাতি। কানাকানি, ফিসফাঁস। আবার উচ্চস্বরে রীতিমতো ঢি ঢি।
অশ্লীলতার অভিযোগ। কেউ কেউ তো প্রতিবাদে নিজেই ফেটে পড়ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা লেখা উচিত, যা লেখা উচিত নয়- সবই লিখছেন। নৃত্যরত তরুণীর পোশাক নিয়ে, কাপড়ের ভাঁজে কী কতটুকু দেখা গেলো আর গেলো না তা নিয়ে কেউ কেউ নাকি বাজিও ধরেছেন নিজেদের মধ্যে। ক্লোজ করে কাছে এনে দেখছেন বার বার।
আমিও দেখেছি। পারফর্মিং আর্টের একজন সমঝদার হিসেবে। তাদের মতো করে নয়, যারা নৃত্যদৃশ্যের স্ত্রিরচিত্র ক্লোজ করে বার বার কাছে এনে দেখেছেন। বরং যারা এই ‘ক্লোজধারী’ তারা অনেক বেশি অশ্লীল। কেননা, তারা এই নৃত্যে, তরুণীর পশ্চিমা পোশাকের ফাঁকফোকরে, কোণা কাঞ্চিতে অন্য কিছু খুঁজেছেন। তারা আসলে সবসময় খোঁজেন। কোনো মেয়ে শাড়ি-কামিজ পরলে খোঁজেন, জিন্স-টি শার্ট পরলে খোঁজেন, হিজাব-বোরকার ভেতরে-বাহিরেও খোঁজেন। তাদের খোঁজার কোনো অন্ত নেই। তারা দিনেও খোঁজেন। রাতেও খোঁজেন। ঘুমিয়েও খোঁজেন। খোঁজেন জেগে থেকেও। যার যা স্বভাব সে তা-ই করবেন।
বরং আমার কাছে এই নৃত্যদৃশ্য মোটেও অশ্লীল লাগেনি, উপরন্তু উপভোগ্য মনে হয়েছে অনেক বেশি। ব্যালের সঙ্গে তারা যুক্ত করেছে অ্যাক্রোবেটিক। কাজটি কঠিন। শারীরিক এই কসরত এত সহজ নয়, গাল দেয়া যত সহজ। এজন্য অনুশীলনের প্রয়োজন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগ-ডেতে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মতো করে আনন্দ করবে, মজা করবে, বিনোদন করবে-স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে সব কিছুতে ‘অশ্লীলতা’ খুঁজতে যাওয়াটাও অশ্লীল।
যে সমাজে আমরা বাস করি তা ভানভনিতায় ঠাসা। কৃত্রিমতায় ভরপুর। কদর্যতায় টইটুম্বর। তাবৎ অপকর্ম হচ্ছে ‘কথিত বড় মানুষদের’ ছত্রছায়ায়, পৃষ্ঠপোষকতায়। তা নিয়ে টুঁ শব্দ নেই। কেননা, সেসব হতে দেওয়ার মধ্যে পুঁজি ও বাণিজ্য জড়িত। লাভালাভ জড়িত। সে লাভের বখরা পেতে হবে তো। ফলে সেই অশ্লীলতাকে অশ্লীল বলা যাবে না। তাকে বরং মহৎ, মহান, সংগ্রামী, প্রতিবাদী বানাতে হবে। কেননা সেই অশ্লীলতার সঙ্গে রাজনীতি ও বহুলোকের জীবিকা জড়িত। হঠাৎ করেই ডেভিড কপারফিল্ডের ম্যাজিকের মতো একশ মদের বোতল এর ৯০ শতাংশ পানি ভর্তি হয়ে গেলেও তা আমাদের কাছে মানবিক ও ভীষণ শালীন।
সমাজে কত শত অশ্লীলতা ‘ওপেনসিক্রেট’ চলছে তার তালিকা প্রকাশ করতে গেলে এমন একশ লেখা লাগবে, তাও শেষ হবে কি না সন্দেহ। তাতে আমাদের কোনো যায় আসে না।
বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তার জায়গা, উদারতার জায়গা। গণতন্ত্রের চর্চার জায়গা, সেখান থেকে একজন মানুষ অনেক বেশি সহনশীল, যুক্তিপ্রবণ ও মানবিক হয়ে বিশ্ববীক্ষা নিয়ে আগামী দিনের পথে এগিয়ে যাবে। সেই শিক্ষার্থীদের যখন আপনি ‘সামান্য’ কোনো অজুহাতে অভিযোগের তীর ছুড়বেন, ‘অশ্লীল’ বলে ট্যাগ দেবেন তখনই সে হীনম্মন্যতায় ভুগবে, এই হীনম্মন্যতা তাকে বড় কিছু করতে প্রণোদিত করবে না।
যদি তাদের কিছু বলতেই হয় তবে তার ভাষা ভিন্ন। আপনারা যে অশ্লীলতার পথ বেছে নিয়েছেন সেই পথ অভিভাবকত্বের পথ নয়। এই পথ আপনাদের ব্যক্তিগত, বিকৃতকাম, গোপন পুলকের পথ।
ভিন্ন দেশীয় সংস্কৃতিকে রপ্ত করতে, পরিবেশন করতে চাইছে আমাদের শিক্ষার্থীরা, মন্দ নয় ভালো। তবে আরও ভালো হতো, দেশীয় নৃত্যের বা সাংস্কৃতিক আবহের কোন পরিবেশনায় যদি তারা যেত, তাদের সঙ্গে আরও বেশি আনন্দ ভাগ করে নিতাম আমি নিজেও।
লেখক: সম্পাদক, আজসারাবেলা, সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/এমএস