ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: কার দায়, সমাধান কী?

শহীদুল হক | প্রকাশিত: ১০:১১ এএম, ১২ মার্চ ২০২২

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। ষোল দিনের যুদ্ধে ইউক্রেনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অসংখ্য সৈন্য নিহত হচ্ছেন। নারী-পুরুষ ও শিশুসহ শত শত বেসামরিক লোকও নিহত ও আহত হচ্ছেন। ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ ধ্বংস হওয়া অব্যাহত আছে।

মানুষ প্রাণের ভয়ে ইউক্রেন ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের ষোলতম দিবস পর্যন্ত পঁচিশ লক্ষাধিক ইউক্রেনিয়ান নাগরিক প্রতিবেশি দেশ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, মলডোভা, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়ায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে।

শরণার্থীদের কাফেলা অব্যাহত আছে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে চরম মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা ব্যবস্থা সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্যে পড়ছে। এ যুদ্ধের ভবিষ্যত কি হবে তা এ মুহূর্তে বলা সহজ নয়।

কেন এই যুদ্ধ?
ইউক্রেন রাশিয়ার পর ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। আয়তন ৬,০৩,৬২৮ বর্গ কিলোমিটার। লোকসংখ্যা ৪০.৪ মিলিয়ন। প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষি ও শিল্পজাত সম্পদ রয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মনে করেন ইউক্রেন আসলে প্রাচীন রুশ ভূখণ্ড। তাঁর মতে আধুনিক ইউক্রেন প্রকৃতপক্ষে বলশেভিক কমিউনিস্ট রাশিয়ার সৃষ্টি। রাশিয়াই ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদের উম্মেষ ঘটিয়েছে। ইউক্রেনের সংস্কৃতি রাশিয়ারই সংস্কৃতি। ইউক্রেনের অধিকাংশ মানুষ রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে।

পুতিন মনে করেন ইউক্রেন কারো সাথে সখ্য বা জোট গড়তে চাইলে তা অবশ্যই রাশিয়ার সাথে হতে হবে। যেমনটা করেছে বেলারোস। পুতিনের কথায় যৌক্তিকতা থাকলেও ১৯৯১ সাল থেকে ইউক্রেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে। স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক বিধি-বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সকল সভ্য রাষ্ট্রেরই উচিত। জোর যার মুল্লুক তার এ নীতি আধুনিক বিশ্বের কোন রাষ্ট্রই সমর্থন করবে না।

মিডিয়ার ভূমিকা:
মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্ববাসী জানতে পারছে। পশ্চিমা মিডিয়া বিশ্ব মিডিয়া-জগৎ দখল করে আছে। ঐ সকল মিডিয়ার মালিক ও পরিচালকরাও পুঁজিবাদী ব্লকের ধনকুবেররা। তাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা প্রীতি ও পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রচারের অভিযোগও আছে। পরিস্থিতির বাস্তবতা অনুধাবনের জন্য পশ্চিমা মিডিয়া কর্তৃক প্রচারিত সংবাদের পাশাপাশি ইতিহাস ভিত্তিক কিছু তথ্যের বিশ্লেষণও প্রয়োজন। আমার এ ছোট লেখায় সেদিকে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।

ইউক্রেনের পশ্চিমা প্রীতি ও রাশিয়ার উদ্বেগ:
ইউক্রেন রাশিয়ার অতি প্রতিবেশি দেশ হলেও দেশটির শাসকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনক্সি ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হলে ন্যাটোর সামরিক ঘাটি ইউক্রেনে বসতে পারে। এতে রাশিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। পুতিনের সেন্টিম্যান্ট হল ইউক্রেন রাশিয়ারই ছিল। ১৯৯২ সালে রাশিয়াই ইউএসএসভুক্ত পনেরটি রাজ্যকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তখন শর্ত ছিল তারা ন্যাটো জোটভুক্ত হতে পারবে না এবং ন্যাটোও তাদের সামরিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে পারবে না।

সেই শর্ত অনেকেই লঙ্ঘন করছে। কিন্তু ইউক্রেনের বেলায় রাশিয়া তা মেনে নিতে পারছে না। পুতিন তাঁর দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি কমানোর জন্য ইউক্রেনকে সামরিক শক্তি ও ইহুদীবাদের আধিপত্য থেকে মুক্ত রাখতে চায়। সহজ কথায় এ জন্যই রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায়।

রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখল:
রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের টানাপোড়েন সম্পর্কের কারণে ২০১৪ সালে রাশিয়া তার সীমান্ত সংলগ্ন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল উপদ্বীপ ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। ঐ সময়েই রাশিয়ার মদদেই ইউক্রেনের বিদ্রোহীরা দেশের পূর্বাঞ্চল দোনেটৎস্ক এবং লুহানস্ককের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারা ইউক্রেন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। বর্তমান সংকটের সময় রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল দোনেৎস্কো ও লুহানস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইতিমধ্যে স্বীকৃতিও দিয়েছে।

রাশিয়া কেন ক্রিমিয়া দখল করল?
নৌবাহিনীর জাহাজের মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগরে আধিপত্য বজায় রেখে দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রাশিয়ার ক্রিমিয়া উপদ্বীপটি অপরিহার্য। উপদ্বীপটি রাশিয়ারই ছিল। ইউক্রেন যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল রাশিয়া তখন ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের নিকট দিয়ে দেয়। রাশিয়ার অভিযোগ ক্রিমিয়াকে ব্যবহার করার জন্য ইউক্রেনের জাহাজ রাশিয়ার জলসীমা অতিক্রম করে। তাই ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের তিনটি নৌ যুদ্ধ জাহাজ জব্দ করে এবং জটিকা অভিযান করে ক্রিমিয়াকে তাদের দখলে নিয়ে নেয়। তখন থেকে ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার তিক্ততা বাড়তেই থাকে।

ইউক্রেনের সামরিক শক্তির বৃদ্ধি:
রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখল করার পর ইউক্রেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর সহায়তায় তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং সেনা সদস্যদেরকে আধুনিক প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। রাশিয়া ইউক্রেনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টি ভালভাবে দেখেনি।

যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসী:
বিশ্বের প্রায় সকল দেশই এ যুদ্ধের বিপক্ষে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে নিন্দাসহ যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবের পক্ষে ১৯৩ দেশের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৪১ দেশ ভোট দেয়। বিপক্ষে ভোট দেয় রাশিয়াসহ ৫টি দেশ। তারা হল বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, ইরিত্রিয়া ও সিরিয়া। ভোটদানে বিরত থাকে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও পাকিস্তানসহ ৩৫টি দেশ। এতে বুঝা যায় বিশ্ব বিবেক যুদ্ধ ও আগ্রাসনের বিপক্ষে।

অবিলম্বে ইউক্রেন থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে অধিশেন সমাপ্ত হয়। রাশিয়া জাতিসংঘের এ আহ্বানে সাড়া না দিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। দেশে দেশে সাধারণ জনগণও ইউক্রেনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছে। খোদ রাশিয়াতেও যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে।

ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সহায়তা:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের কতিপয় দেশ ইউক্রেনে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং আর্থিক ও লজিস্টিক সাপোর্ট সরবরাহ করলেও তারা নিজ দেশের সৈন্য পাঠিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এমনকি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট অনুরোধ করেছিলেন ইউক্রেনের আকাশ নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করতে। ন্যাটো ও পশ্চিমা বিশ্ব তাতে রাজি হয়নি। তাদের যুক্তি রাশিয়া নো-ফ্লাই জোন নীতি মানবে না। মানাতে হলে ন্যাটো ও মেম্বার দেশগুলোকে সংঘাতে জড়াতে হবে। এতে বিশ্ব যুদ্ধের আশংকা থাকবে।

কোন রাষ্ট্রই চায় না তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাক। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে যাতে রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তাদের অর্থনৈতিক কাঠিামো চরমভাবে ভেঙে পড়ে। তাদের ধারণা এতে অভ্যন্তরীণভাবে জনরোষ সৃষ্টি হবে এবং পুতিন সরকার চাপের মুখে থাকবে।

আমেরিকা কেন সৈন্য পাঠিয়ে যুদ্ধে জড়াতে চায় না?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একজন গণতান্ত্রিক মানসিকতার রাজনীতিবিদ। তিনি সংঘাত নয়, শান্তি চান। তিনি সামরিক হস্তক্ষেপ নীতিতে বিশ্বাসী নন। তাই তিনি পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র কোন যুদ্ধে জড়াতে চায় না কারণ সামরিক হস্তক্ষেপের অতীত ইতিহাস তাঁর জানা আছে। ১৯৯০ সালের বলকান অঞ্চলের জাতিগত যুদ্ধে আমেরিকার হস্তক্ষেপ, ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ, ১৯৯৫ ও ১৯৯৯ সালে যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, ইরাক, লিবিয়া ও আফগানিস্তান যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ এবং তার পরিণতি তাঁর জানা আছে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ ১৯৫৫ হতে ১৯৭৫ পর্যন্ত চলে। ঐ যুদ্ধে যুক্তরাষ্টের নেতৃত্বাধীন জোটের শোচনীয় পরাজয় হয়। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ষাট হাজার সৈন্য নিহত এবং তিন লক্ষাধিক সৈন্য আহত হয়। অর্থ-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি তো অসীম। ২০০১ হতে ২০২০ পর্যন্ত আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হয় ৭৮০ মার্কিন ডলারের বেশি। মার্কিন সৈন্য নিহত হয়েছে ২৩০০ জন। আহত হয়েছেন বিশ হাজারের বেশি। বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। বিশ্ববাসীর কাছে যে ম্যাসেজ গিয়েছে তা হল আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। তালেবানের বিজয় হয়েছে।

মার্কিনীদেরও এ সকল যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও ফলাফল সুখকর ছিল না। তাই মার্কিনীরা বিদেশের মাটিতে নিজ দেশের সৈন্য পাঠিয়ে যুদ্ধ করতে আগ্রহী নয়। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার মত পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে গেলে গোটা পৃথিবী মহাসংকটে পড়বে। প্রকৃতপক্ষে কোন দেশই যুদ্ধ-বিগ্রহ চায় না। যুদ্ধে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় তা বহন করার সামর্থ্য অনেক রাষ্ট্রেরই নেই। এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিতে চায় না।

এছাড়া রাশিয়ার আগ্রাসনকে প্রতিহত করা ব্যতিত যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ানোর পক্ষে কোন জোরালো যুক্তিও নেই। ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রতিবেশি রাষ্ট্র নয়। ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিও নেই। ইউক্রেনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বা অন্য কোন কৌশলগত স্বার্থও নেই।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন স্বাধীনতাকামী কোন ব্যক্তিই সমর্থন করে না। কোন রাষ্ট্রই তার স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের উপর আক্রমণকে কিছুতেই মেনে নিবে না। নিজ দেশের উপর আক্রমণকে জীবন দিয়ে প্রতিহত করবে যা ইউক্রেনের জনগণ করছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়াই কি এককভাবে দায়ী?
সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন:
১৯১৭ সালে ভ্লাদিমির লেলিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ১৯১৮ সালে রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলুরাশিয়া (বর্তমানে বেলারুশ) নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, এ্যাস্তোনিয়া, জর্জিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিস্তান, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, মলডোভিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, এবং উজবেকিস্তান প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট প্রজাতন্ত্র দাঁড়ায় ১৫টিতে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে অনুসরণ করে আরো কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ধারক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে যায়।

ন্যাটো ও ওয়ারশ ফ্যাক্ট:
সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিপক্ষ করে ১৯৪৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্ঘানাইজেশন সংক্ষেপে ন্যাটো গঠিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পাল্টা সামরিক জোট ওয়ারশ ফ্যাক্ট আবির্ভাব হয় ১৯৫৫ সালে। প্রাথমিকভাবে ন্যাটো জোটের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ছিল ১৫টি। ওয়ারশ জোটের সদস্য সংখ্যা ছিল ৮টি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন ও ন্যাটোর সম্প্রসারণ:
১৯৯১ সালে সোভিযেত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর পরই ওয়ারশ জোটও ভেঙে যায়। তখন পশ্চিমা দেশগুলো বলেছিল ন্যাটো জোটের আর প্রয়োজনীয়তা নেই। তারা অঙ্গীকার করেছিল ন্যাটো জোট আর সম্প্রসারণ করা হবে না। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা তাদের কথা রাখেনি। তারা একের পর এক ন্যাটোর সম্প্রসারণ করেই চলেছে। ১৯৯১ সালের পর ন্যাটোর সদস্য দেশের সংখ্যা বেড়ে ২০২০ সালে হয়েছে ৩০টি। ১৯৯১ সালের পর ১৮টি নতুন দেশকে ন্যাটোভুক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে ৭টি রাষ্ট্র ওয়ারশ জোটের সদস্য ছিল। ন্যাটোর ভবিষ্যত পরিকল্পনা আছে ইউক্রেন, জর্জিয়া, বসনিয়া-হার্জেগনিয়া, ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও সার্বিয়াকে পর্যায়ক্রমে ন্যাটো জোটভুক্ত করে নেওয়ার।

রাশিয়ার উদ্বেগ ও প্রতিবাদ:
রাশিয়া বরাবরই ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে। রাশিয়ার কথা পশ্চিমারা রাশিয়ার চতুর্দিকের সকল রাষ্ট্রকে ন্যাটো জোটভুক্ত করে রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার কথা আমলে নিচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও ন্যাটো সম্প্রসারণের বিপক্ষে কথা বলছেন এবং রাশিয়ার উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরছেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষজ্ঞদের মতামতের প্রতিও কর্ণপাত করছেন না। এতে রাশিয়ার মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠে।

এ কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাঁধার পিছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম দেশগুলো দায় এড়াতে পারে না।

যুদ্ধ কোন দিকে যাচ্ছে?
আজ ১১ মার্চ যুদ্ধের ১৬তম দিবস। রুশ বাহিনী ইউক্রেনের কয়েকটি বড় বড় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখল করতে পারলেও এখনও রাজধানী শহর কিয়েভে প্রবেশ করতে পারেনি। কিয়েভ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে রুশ বাহিনী অবস্থান নিয়ে আছে। আপাত দৃষ্টিতে তাদের রণ-কৌশল সুস্পষ্ট নয়। তবে তারা যে ইউক্রেন সেনাবাহিনী দ্বারা এত প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে তা বোধ হয় অনুধাবন করতে পারেনি। ইউক্রেন পূর্বেই বুঝতে পেরেছিল রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারে। তাই তাদের কিছু প্রস্তুতি ছিল। সে কারণেই ইউক্রেন এখন পর্যন্ত একাই রাশিয়ার মত বৃহৎ শক্তির মোকাবেলা করে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধে সরাসরি জড়িত হচ্ছে না এবং জড়িত হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তারা ইউক্রেনকে আর্থিক, সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তারা ইউক্রেনে অস্ত্র-শস্ত্র ও অর্থ সাহায্য পাঠাচ্ছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা:
রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য কঠিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচ হাজারেরও বেশি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আমেরিকা ও বৃটেন ইতিমধ্যে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তৈল আমদানির উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপও করেছে।

অপরপক্ষে চীন রাশিয়ার সাথে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। রাশিয়া এসব কিছু মাথায় রেখেই বিগত কয়েক বছর প্রস্তুতি নিয়ে ইউক্রেন আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছে। তাই পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়া কয়েক মাস সহজেই সংকট মোকাবেলা করতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

কূটনৈতিক আলোচনায় যুদ্ধের অবসান কি সম্ভব?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল পশ্চিমা দেশগুলো সতর্ক ও দায়িত্বশীল আচরণ করছে যাতে পরিস্থিতি বিশ্বযুদ্ধের দিকে মোড় না নেয়। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনাও চলছে। সর্বশেষ রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের জন্য তিনটি শর্ত দিয়েছে। ১. ইউক্রেনকে সংবিধানে সংযোজন করতে হবে তারা ন্যাটো জোটের সাথে যাবে না। ২. ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে মেনে নিতে হবে। এবং ৩. ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল দোনেটৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীনতা দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে ইউক্রেন বাস্তবতার আলোকে ও দেশের নিরাপত্তা এবং জনগণের জানমাল ও সম্পদের কথা চিন্তা করে শর্ত তিনটির প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রাশিয়ার সাথে আলোচনায় বসতে পারে। ইউক্রেনের ন্যাটো জোটে গিয়ে কি লাভ বা লোকসান তাও ইউক্রেনের হিসাব-নিকাশ করা প্রয়োজন। পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে থাকলেও সহসাই যুদ্ধ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। রাশিয়া একটা সম্মানজনক সমাধান ছাড়া ইউক্রেন ছাড়বে না। আর রাশিয়াকে যুদ্ধে হারিয়ে দিবে ইউক্রেনকে এত আশাবাদী হওয়া কতটুকু বাস্তবসম্মত তাও ভেবে দেখতে হবে। আর পশ্চিমারা তো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ করে কখনও বিশ্বযুদ্ধ বাঁধাতে চাইবে না।

ক্রিমিয়া তো রাশিয়ার দখলেই আছে। রাশিয়া ক্রিমিয়াকে ত্যাগ করবে বা ইউক্রেন যুদ্ধ করে ক্রিমিয়া পুনঃদখল করবে এ বিশ্বাস করাও ইউক্রেনের পক্ষে বাস্তবতাবর্জিত। পূর্বাঞ্চল ইউক্রেনের জন্য বিষফোঁড়া। স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীদের দমাতে ইউক্রেন অনেক লোক হত্যা ও নির্যাতন করেছে। কিন্তু বিদ্রোহ দমন করতে পারেনি। তাই বিষফোঁড়া ফেলে দেয়াই ভাল। আলোচনায় বসলে দর কষাকষির মাধ্যমে ইউক্রেন হয়ত আরো সুবিধা আদায় করতে পারে।

উভয় পক্ষের যুদ্ধ বিরতির শর্ত পুরোপুরিভাবে মেনে নিয়েই আলোচনায় বসতে হবে। দুই পক্ষের সদিচ্ছা ও সম্মেলিত কিংবা জাতিসংঘ অথবা তৃতীয় কোন নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এ আলোচনা হলে হয়তো ফলপ্রসূ অগ্রগতি হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে সার্বিক বিষয় বিবেচনায় এনে উভয়েরই বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে উভয়কেই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। রাশিয়াকেও ইউক্রেনের জনগণের স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। ইউক্রেনের শাসকদের নিজ দেশ ও জনগণের স্বার্থ বুঝতে হবে। কারো প্ররোচনায় ভুল সিদ্ধান্ত নিলে নিজেদেরই ক্ষতি হবে।

যুদ্ধ নয় কূটনৈতিক আলোচনায় সংঘাতের শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধান আসতে পারে। বিশ্ববাসী সে প্রত্যাশাই করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান হোক, বিশ্ববাসী শান্তিতে বসবাস করুক এটাই সকলের কাম্য।

লেখক: সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন