জিনিসের দাম বাড়ায় পুড়ছে হাত
টিসিবির ট্রাকের পেছনে হ্রাসকৃত মূল্যে চাল, ডাল, তেল, চিনি কিনতে মধ্যবিত্ত লাইন দিচ্ছে, এ দৃশ্য অনেক দিনের। এবার মারামারি, চলন্ত ট্রাকে পণ্য প্রত্যাশী ঝুলন্ত নারীর ভিডিও ভাইরাল।
করোনার প্রভাব ছিল, এবার এলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এবং শুরু হয়েছে রমজানের হাওয়া। আগে থেকেই নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা। এবার রোজার হাওয়া অস্থিরতাকে কোন মাত্রায় পৌঁছে দেয় সেটা দেখার পালা। অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক। ২০২০- সালে করোনা শুরুর ঠিক আগে আগে ফেব্রুয়ারি মাসের ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে চাল, তেল, মুরগি, এলপি গ্যাসের দাম ১৮ থেকে ৮২ শতাংশ বেড়েছে।
গত ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনাসভায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার বাজার মনিটর করছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাজার তদারকির কথা আমরা সব সময়ই শুনে আসছি। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রভাব আমরা দেখিনি। বাজারে নজরদারি প্রয়োজন এবং প্রধানমন্ত্রী নিজেই যখন সেটা বললেন তখন এর গুরুত্ব পাওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে এখানেও সে প্রভাবটা পড়ে; আর কিছু সুবিধাভোগী শ্রেণি রয়েছে এ সুযোগটা নেওয়ার জন্য।
বাজার তদারকির গুরুত্ব বুঝতে হলে ব্যবস্থাপনায় যারা আছে যেমন বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় তাদের একটু গভীরে গিয়ে বিষয়টা জানতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে গা বাঁচানোর চেষ্টা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল প্রভৃতি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। দেখা যায়, দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চালের ভরা মৌসুমেও, এমনকি দাম সহনীয় রাখতে চাল আমদানি করার পরও বাজারে এর দাম ঊর্ধ্বমুখী।
বস্তুত বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী, যার পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এতেই স্পষ্ট হয় যে, কোথাও কোথাও একটা কারসাজি আছে যেটা প্রচার পেয়েছে সিন্ডিকেট নামে। জিনিসপত্রের দামের সাথে মানুষের বোঝা বাড়ছে অন্যদিক থেকেও। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম ও গণপরিবহনের ভাড়া নাগালের বাইরে চলে গেছে।
দুই বছর আগে পাঁচ লিটার ভোজ্য তেলের দাম ছিল ৫০০ টাকা, এখন তা ৮০০ টাকার বেশি। বাস্তবতা এটি যে, অনেক মানুষকেই কম খেয়ে বাঁচতে হচ্ছে যতই জিডিপি আর মাথাপিছু আয়ের বাড় বাড়ন্ত থাকুক না কেন। দুই বছর ধরে করোনা ভাইরাসের দাপট বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পরে ফের জ্বলে উঠেছে দপ করে, কারণ হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। চাল, তেল, পেয়াঁজ তো আছেই পটল, ঝিঙে, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ,বেগুন, টোম্যাটো ছুঁলেই হাত পুড়ছে সাধারণ মানুষের। ছেঁকা দিচ্ছে যেন, ঝলসে দিচ্ছে হাত। করোনা আবহে অধিকাংশ মানুষের উপার্জন কমেছে। অনেকেই আয়ের পথে পুরোপুরি পিরতে পারেনি। তার মধ্যে প্রায় সব ধরনের জিনিসই ক্রমশ মহার্ঘ হয়ে উঠতে থাকায় মধ্যবিত্তের হাঁসফাঁস দশা।
আমরা দেখছি ভোক্তা অধিদপ্তর কিছুটা সক্রিয় হয়েছে। আরো যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সরকার সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-সমুদ্র, স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পণ্য খালাস করা; ফেরি পারাপারে পণ্য পরিবহনে অগ্রাধিকার ও নিত্যপণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে জেলা পুলিশের সহায়তা; টিসিবির কার্যক্রমে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে সার্বিক সহযোগিতার নির্দেশ প্রদান প্রভৃতি। আমরা এসব উদ্যোগের যথাযথ বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করছি। কিন্তু এগুলো সবই প্রতিক্রিয়াধর্মী। অর্থাৎ সঙ্কট যখন হয়েছে তখন মাঠে নেমেছে, আগে থেকে সক্রিয় হয়নি।
বাজার ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে তথ্য। কোন পণ্যের কতটুকু চাহিদা, কতটুকু সরবরাহ আছে, কোন সময় কতটুকু বাড়ে, সংকট কখন তীব্র হয় এসব তথ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের কাছে থাকা উচিত। আর কয়েকটি কোম্পানির কাছে তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের পুরো বাজার জিম্মি হয়ে গেছে বলে যে কথা উঠছে তার ব্যাপারেরও সরকারের স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত জনগণ আশা করছে। এরা বাজারে দ্রব্য বিক্রি করে, এরাই আবার মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সাথে বসে নিজেদের মতো করে দাম বাড়িয়ে নেয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটাই স্বচ্ছ নয়। বিষয়টা অনেকটা এমন যে, মাঠে যারা খেলছে তারাই আবার রেফারির ভূমিকায় আছে।
বাজারের প্রভাব রাখার আরেকটি কারণ চাঁদাবাজি যেটা ব্যবসায়ীরা হর-হামেশা বলে থাকেন। প্রান্তিক অঞ্চল থেকে একটি পণ্য বড় শহর ও ঢাকায় পৌঁছুতে নানা স্তরে চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা নেয় বাজারের সাথে জড়িত মধ্যস্বত্বভোগী চক্র, রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল, পরিবহন মাফিয়া, কাঁচাবাজার নিয়ন্ত্রণকারী মাস্তানচক্র এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সরকার টিসিবির ট্রাকে করে কম দামে পণ্য বিক্রি করছে। কিন্তু টিসিবির ট্রাকের মালামাল মানুষের চাহিদার তুলনায় কম। তাই প্রায় প্রতিদিনই বিশৃঙ্খলার চিত্র উঠে আসছে গণমাধ্যমে। একটা স্থায়ী ব্যবস্থাপনার দিকে যাওয়া প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবারগুলোকে সরকার রেশন দিতে পারে কিনা সেটা ভাবা দরকার।
আরেকটি বিষয় হলো সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কঠোরতা প্রদর্শন। একশ্রেণির ব্যবসায়ী স্বেচ্ছাচারী কায়দায় দাম বাড়িয়ে থাকেন। বিশেষ করে ভোজ্যতেলের মতো আমদানি পণ্যের দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে থাকেন তারা। একশ্রেণির ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম কেজিতে ২ টাকা বাড়লে দেশীয় বাজারে ৫ টাকা বাড়িয়ে দেন। এদের ব্যাপারে কঠোর হওয়া প্রয়োজন।
ব্যবসায়ীদের কারসাজি কিংবা পরিবহনের চাঁদাবাজি—যে কারণেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ুক না কেন, সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখা সরকারের দায়িত্ব। বাজার তদারকি জোরদার করার কথাটা বারবারই আসছে বিশেষজ্ঞদের কাছে থেকে যাতে কেউ বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দিতে না পারে।
সরকারের উচিত হবে নিজস্ব চ্যানেলে কম দামে খোলাবাজারে প্রচুর পণ্য বিক্রি করে। বর্তমানে টিসিবির মাধ্যমে যে অল্প পরিমাণ পণ্য বিক্রি করা হয়, তা বাজারে কোনো কোনো প্রভাবই ফেলতে পারছে না। গুটিকয় শহর এলাকায় নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত খোলাবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। সামনে রোজায় কোনো সিন্ডিকেট যাতে নতুন করে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে, সে বিষয়ে এখনই সজাগ হতে হবে। আর গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো থেকেও সরকারকে আপাতত বিরত থাকতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/এএসএম