পোকামাকড়ের জাগরণ: চীনের তৃতীয় সৌরপদ
বেইজিংয়ে এখন ভোরের দিকে তামপাত্রা থাকে এক থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। সঙ্গে হালকা বাতাস। ফলে মোটামুটি শীত অনুভূত হয়। খুব সকালে ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার সময় অথবা অফিসে আসার পথে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হালকা জ্যাকেট গায়ে চড়াই। ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও’ বললাম, কারণ দুপুর নাগাদই এই জ্যাকেট গা থেকে নেমে হাতের বোঝা হয়। তখন তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ থেকে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সূর্যের আলো গায়ে পড়লে এই ১৬-১৭ ডিগ্রিকেই ২৫-২৬ ডিগ্রি মনে হয়। অন্যদের কথা জানি না, আমি এই সময়টায় বাসার বাইরে বের হওয়ার সময় পোশাক বাছাই করতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি।
চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদে (solar terms)। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এই ২৪টি সৌরপদ বা সোলার টার্ম হচ্ছে: লি ছুন (বসন্তের শুরু), ইয়ুশুই (বৃষ্টির পানি), চিংচ্য (পোকামাকড়ের জাগরণ), ছুনফেন (বসন্ত বিষুব), ছিংমিং (তাজা সবুজ), কুইয়ু (শস্য-বৃষ্টি), লিসিয়া (গ্রীষ্মের শুরু), সিয়াওমান (কম পূর্ণতা), মাংচুং (ফসল বোনার সময়), সিয়াচি (উত্তরায়ন), সিয়াওশু (কম গরম), তাশু (বেশি গরম), লিছিয়ু (শরতের শুরু), ছুশু (গরমের শেষ), পাইলু (শুভ্র শিশির), ছিউফ্যন (শারদীয় বিষুব), হানলু (ঠান্ডা শিশির), শুয়াংচিয়াং (প্রথম হিমেল হাওয়া), লিতুং (শীতের শুরু), সিয়াওসুয়ে (ছোট তুষার), তাসুয়ে (বড় তুষার), তুংচি (দক্ষিণায়ন), সিয়াওহান (কম ঠান্ডা), তাহান (বেশি ঠাণ্ডা)।
বসন্তকালীন চাষবাস
প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোনো সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। এখন চলছে সৌরপদ চিংচ্য বা ‘পোকামাকড়ের জাগরণ’। এটি চীনা চান্দ্রপঞ্জিকার তৃতীয় সৌরপদ। এবার এই সৌরপদের ব্যাপ্তি ৫ মার্চ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত।
তৃতীয় সৌরপদে ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়বে এবং কোথাও কোথাও বৃষ্টিপাতও হবে। অভিজ্ঞতা এমনটাই বলে। তাপমাত্রা যে বাড়ছে, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। সামনে বৃষ্টিপাতও হবে। চীনের কোনো কোনো জায়গায় হয়তো বৃষ্টিপাত হয়েছেও। চীন বিশাল দেশ। এখানে অঞ্চলভেদে আবহাওয়ার ভিন্নতা স্বাভাবিক। যাই হোক, বসন্তের এই সময়টা বসন্তকালীন কৃষিকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর এ সৌরপদের নাম থেকেই বোঝা যায়, এ সময় শীতনিদ্রা থেকে জেগে ওঠে বিভিন্ন প্রাণী। প্রাচীন কাল থেকেই এটা বিশ্বাস করা হয় যে, বসন্তকালীন বজ্রপাতের শব্দে বিভিন্ন পোকামাকড় ও প্রাণী শীতনিদ্রা থেকে জেগে ওঠে।
চিংত্য মাছ শিকারের স্বর্ণসময়
চীনের বিভিন্ন জায়গায় তৃতীয় সৌরপদ চলাকালে বসন্তের বজ্রপাত হতে দেখা যায়। চীনা প্রাচীন বচনে বলা হয়েছে: ‘যদি চিংচ্য সৌরপদ শুরুর আগেই বসন্তের বজ্রপাত হয়, তবে সে-বছর অস্বাভাবিক আবহাওয়া দেখা যাবে।‘চীনের কোথাও ৫ মার্চের আগে বজ্রপাত হয়েছে বলে শুনিনি। আশা করা যায়, এ বছর চীনের আবহাওয়ায় কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা যাবে না।
চিংত্য সৌরপদে বায়ুর গতিপ্রকৃতি দেখে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া যায়; প্রাচীনকালে তাই দেওয়া হতো। আর আধুনিক আবহাওয়া-বিজ্ঞান অনুসারেও, চিংচ্য-তে পৃথিবীর আর্দ্রতা বাড়ে এবং ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি গরম বায়ুর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এসময় উত্তর থেকে প্রবাহিত গরম ও আর্দ্র বায়ু ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ কারণেই তখন বসন্তের বজ্রপাত হয়। তবে, যেমনটি আগেই বলেছি, বিশাল দেশ হবার কারণে, চীনের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় বসন্তের প্রথম বজ্রপাত হতে দেখা যায়।
শিল্পীর তুলিতে সাদা বাঘ
প্রাচীনকাল থেকেই চীনা কৃষকরা চিংত্য সৌরপদকে খুব গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। বলা চলে, সারা বছরের কৃষিকাজের আরম্ভবিন্দু হচ্ছে এই সৌরপদ। এসময় চীনের অধিকাংশ এলাকায় তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকে; গড় তাপমাত্রা দাঁড়ায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। সূর্যালোকও পাওয়া যায় পর্যাপ্ত। সবমিলিয়ে কৃষিকাজের জন্য চমত্কার পরিবেশ। প্রাচীন চীনা বচনে বলা হয়েছে: ‘যখন চিংত্য আসে, তখন থেকে বসন্তকালীন কৃষিকাজে কোনো বিশ্রাম নেই।’
কৃষিকাজের পাশাপাশি, এসময়টা মাছ ধরার জন্যও উপযুক্ত সময়। এসময় পোকামাকড় যেমন শীতনিদ্রা থেকে জেগে ওঠে, তেমনি মত্স্যকূলেও চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। খাদ্যের সন্ধানে তারা গভীর পানি থেকে অগভীর পানিতে ছুটে আসে। মত্স্যকূলের জন্য প্রজনন সময়ও এটি। ফলে, মত্স্য-শিকারীদের জন্য সৃষ্টি হয় ভালো সুযোগ। যারা শহরে বাস করেন এবং মত্স্য-শিকারের ওপর যাদের জীবিকা নির্ভর করে না, তাদেরও কেউ কেউ শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি কাটিয়ে উঠতে এসময় মাছ-শিকারে বের হয়ে পড়েন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে অনেকেই শহর থেকে বিভিন্ন হ্রদে চলে যান স্বজনদের নিয়ে; মাছ ধরার পাশাপাশি উপভোগ করেন হ্রদের পানিতে সাঁতার ও সূর্যালোক।
দুরাত্মাকে প্রহার করা একটি প্রাচীন রীতি
চীনের চান্দ্রপঞ্জিকার প্রতিটি সৌরপদের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে এক বা একাধিক প্রাচীন আচার, যেগুলোকে কেউ কেউ কুসংস্কার বলে থাকেন। তৃতীয় সৌরপদও এর ব্যতিক্রম নয়। চীনের প্রাচীন রূপকথা অনুসারে: একটি সাদা বাঘ মানুষে মানুষে ঝগড়া-ফাসাদ সৃষ্টির জন্য দায়ী। তা ছাড়া, এ বাঘ চিংত্য সৌরপদে শিকারে বের হয় এবং কখনও কখনও মানুষের ওপর হামলা করে।
আর যদি কেউ এই বাঘের হামলার শিকার হয়, তবে সে জীবনে অনেক বাধা-বিপত্তি ও দুর্ভাগ্যের শিকার হয়। তাই, প্রাচীনকালে চীনারা এসময় সাদা বাঘের পূজা করতেন। আজও চীনের কোনো কোনো স্থানে এই রীতি চালু আছে। চিংত্য এলেই লোকেরা কাগজে সাদা বাঘের ছবি আঁকেন এবং বাঘের মুখে প্রাণীর রক্ত ও মাংস রাখেন। তারা বিশ্বাস করেন, এতে সাদা বাঘের ক্ষুধা দূর হবে এবং সে আর মানুষের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনবে না, মানুষের ওপর হামলা চালাবে না।
চিংত্য সৌরপদে প্রচুর নাশপাতি খেতে হয়
তৃতীয় সৌরপদের আরেকটি প্রাচীন রীতি হচ্ছে দুরাত্মা বা দুর্জনকে প্রহার করা। এই প্রথার শুরু থাং রাজবংশ আমলে (৬১৮-৯০৭)। এই প্রথা এখনও চীনের কুয়াংতুং ও হংকংয়ে জনপ্রিয়। প্রথা অনুসারে, একজন বয়স্ক নারীকে দুরাত্মা প্রহারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই নারী কাগজ কেটে একটি মানুষের মূর্তি ফুটিয়ে তোলেন এবং সেই মূর্তিকে জুতো ও লাঠি দিয়ে প্রহার করেন। লোকেরা বিশ্বাস করে যে, এতে দুর্ভাগ্য তাদের কাছ থেকে দূরে থাকবে এবং সৌভাগ্য কাছে আসবে। হংকংয়ের ওয়ান ছাই (Wan Chai) জেলার কজওয়ে বে (Causeway Bay) এলাকার একটি সেতু দুরাত্মা প্রহারের স্থান হিসেবে আজও খুবই জনপ্রিয়।
আগেই বলেছি, ভিন্ন ভিন্ন সৌরপদে চীনারা ভিন্ন ভিন্ন খাবারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। চিংত্য সৌরপদে তাদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায় নাশপাতি। আমি চীনে আসার পর এখানকার মুরুব্বিরা আমাকে যে-ফলটি সবসময় খেতে উত্সাহিত করেছেন, সেটি নাশপাতি। মোটামুটি সারা বছরই এখানে বিভিন্ন ধরনের নাশপাতি পাওয়া যায়। খেতেও মজা। তৃতীয় সৌরপদে আবহাওয়া গরম হতে থাকে, বাতাস হয়ে ওঠে তুলনামূলকভাবে বেশি শুষ্ক। এসময় তাই নাশপাতি খুবই কার্যকর, বিশেষ করে সর্দি-কাশির বিরুদ্ধে। চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাবিদ্যা অনুসারে, চিংত্য সৌরপদে প্রচুর নাশপাতি খাওয়া উচিত; চীনারা তা খায়ও বটে।
লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।
[email protected]
এইচআর/এএসএম