ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহে বাংলাদেশি মিডিয়ার উদাসীনতা

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ১১:৩১ এএম, ১০ মার্চ ২০২২

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাশিয়া ইউক্রেনের দুটি বিচ্ছিন্নতাকামী অঞ্চলকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদেরকে হেফাজতের নামে ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকেই একটি প্রশ্ন নিকটজনদের কাছ থেকে নিয়মিত শুনে আসছি -ইউক্রেন যুদ্ধ কভার করতে যাচ্ছেন কি আপনি? বাংলাদেশি সাংবাদিকরা যুদ্ধ কভার করতে যাবে কিনা? যায় না কেন? ইত্যাদি।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের এই যুদ্ধে মিডিয়া যে সমস্ত সংবাদ পরিবেশন করছে কোনটা বিশ্বাসযোগ্য? ইউক্রেন কি পারবে যুদ্ধে জয়লাভ করতে? রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ করা আমাদের মত ছোট ছোট দেশগুলোর জন্য কি হুমকি নয়- এ জাতীয় নানা প্রশ্ন।

প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা প্রথমেই দিয়ে নিই। এর আগে ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়া (ক্রিমিয়া) দখল নিয়ে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে যখন গোলযোগ শুরু হয় তখন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডারের সঙ্গে কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিকাবের ডিনারে আমার দেখা হয়। তিনি রিপোর্টার হিসেবে আমার আফগানিস্তান এবং ইরাক যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহের কথা শুনে তখন ইউক্রেন যাওয়ার পরামর্শ দেন।

তার মতে সেখানে যে 'গৃহযুদ্ধ' চলছে সেটা কভার করতে আমার যাওয়া উচিত কারণ তার যুক্তি ছিল আফগানিস্তান, ইরাক থেকে ইউক্রেনের যুদ্ধে অনেক বেশি কভার করার বিষয় আছে। বিশ্বের সেখানে নজর দেওয়া দরকার। মিডিয়ারও নজর দেওয়া দরকার। আমি তাকে বলি যে এটি একটি ব্যয়বহুল কাজ, বাংলাদেশের মিডিয়ার পক্ষে এই ব্যয় বহন করা কঠিন। তাছাড়া আমি যেখানে কাজ করতাম সেই আজকের কাগজ বন্ধ। আমাকে পাঠাবে কে?

সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোর মধ্যে সবার যুদ্ধ কভারের পেছনে হাজার হাজার ডলার ব্যয় করার সামর্থ্য নেই। থাকলেও তারা পাঠাবে না, তারচেয়ে পাঠকদের জন্য পশ্চিমা মিডিয়ার আবর্জনাকে যুদ্ধ সংবাদ হিসেবে ছাপাতে এবং সম্প্রচার করতে আগ্রহী তারা। ইউক্রেন যুদ্ধের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রেও সিংগভাগ মিডিয়া তাই করছে। অথচ তারা ইচ্ছে করলে পূর্ব পরিকল্পনা নিয়ে সহজে নিজস্ব সাংবাদিক পাঠাতে পারতো ইউক্রেনে। খরচও এখন কম। লাইভ করতে আগের মতো স্যাটেলাইট লাগছে না স্মার্ট ফোনের যুগে।

তাই শুধু অর্থের কারণে বাংলাদেশি সাংবাদিকরা যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহে যেতে পারে না- এটা সমর্থন যোগ্য নয় আমার কাছে। ক্রিকেট কভার করতে বাংলাদেশ থেকে অনেক রিপোর্টার বাইরে যাচ্ছে, সেজন্য তারা স্পন্সর পাচ্ছে। যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও সেটি পাওয়া সম্ভব। ইরাক যুদ্ধের সময় চ্যানেল-আই তা পেয়েছিল। আজকের কাগজও প্রচুর সুনাম অর্জন করেছে।

আরো দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের যুদ্ধ কভার করার হুসটি হয় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, যখন যুদ্ধরত একটি দেশের পক্ষে সাংবাদিকদের ভিসা দেওয়া, স্বাগত জানানো সম্ভব না। তাছাড়া এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে যে বাংলাদেশের মতো দেশের সাংবাদিকদের জন্য হুট করে বিদেশ যাওয়া খুব কঠিন কারণ কে সাংবাদিক আর কে শ্রমিক বিদেশীদের কাছে লাল-সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে গেলে তারা ভেদাভেদ করে না।

সেই কারণে যুদ্ধ সংবাদ যদি কেউ সংগ্রহ করার ইচ্ছা পোষণ করে তাহলে অন্তত দু' এক মাস আগে থেকে প্রক্রিয়া শুরু করতে হয় যেটা আমাকে ইরাক যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে করতে হয়েছিল। ভিসার জন্য আবেদন করে প্রায় দুই মাস প্রতীক্ষা করতে হয়েছে। প্রচুর গবেষণা করতে হয়েছে যুদ্ধের নেপথ্যের ঘটনাবলি নিয়ে এবং সঠিক সময়ে প্রবেশ করা নিয়ে।

আমি ইরাক থেকে যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে ঢাকাস্থ ইরাকী দূতাবাসের মিশন প্রধানের সঙ্গে যখন আবার দেখা করলাম, তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঢাকার বেশ কয়েকজন সাংবাদিক যুদ্ধ সংবাদ কভার করার জন্য ইরাকি ভিসা চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন কাউকেই ভিসা দেওয়া সম্ভব ছিল না কারণ মধ্যপ্রাচ্যের এই সমস্ত দেশগুলোর নিয়মই হচ্ছে ভিসা আবেদনপত্র এম্বেসীগুলো তাদের দেশে পাঠালে নো অবজেকশন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক সরকারের পক্ষে তখন এগুলো দেখা সম্ভব না।

যেসব সাংবাদিক যুদ্ধের আগে সেখানে প্রবেশ করেছে তাদেরকে তারা টেককেয়ার করেছে ওই সময়। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে তারা কোনো বিদেশিকে দেশে ঢুকতে দেয়নি। যেসব সাংবাদিক তখন যুদ্ধ কভার করার জন্য জর্ডানে আশ্রয় নিয়েছিল, মাঝে মাঝে তারা সীমান্তে তৈরি করা তাঁবুতে যেত শরণার্থীদের নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য। সাংবাদিকদের সেখানে থাকার পরিবেশ ছিল না এবং সিংহভাগের অবস্থান ছিল আম্মানে, যেখান থেকে ইরাক-জর্ডান সীমান্ত ছিল ৩২০ কিলোমিটার দূরে। বাগদাদ থেকে এই সীমান্ত ছিল ৫৭৫ কিলোমিটার দূরে।

ইরাক যুদ্ধ শেষ হওয়ার ১০ দিন পরে বাংলাদেশের দুই জন সাংবাদিক বাগদাদ গিয়েছিলেন। জনকণ্ঠ থেকে ফজলুল বারী এবং মানব জমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। যুদ্ধের কারণেই তারা ইরাকে প্রবেশ করতে পারেননি। ইরাক যাওয়ার পর দুই দিনের মাথায় তারা আবার ফেরত গিয়েছেন জর্ডানে। মতিউর রহমান দেশে চলে এসেছিলেন আর ফজলুল বারী আবার আম্মান থেকে কয়েক দিনের জন্য বাগদাদ যান।

আর যুদ্ধের তিন সপ্তাহ পর আমার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে আজকের কাগজ থেকে সুজন সাত্তার যান। এটিএন-এর একজন রিপোর্টারও তার সঙ্গী ছিল। এই দুই জনের তখন বিধ্বস্ত বাগদাদের রাস্তার ধুলাবালি এবং মার্কিন ট্যাংক দেখা ছাড়া করার কিছু ছিল না। সুজনকে পেয়ে তাকে রেখে পরদিন দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। টানা ৫১ দিন থেকে পহেলা মে ২০০৩ সালে ঢাকায় পৌঁছেছি। দিন কয়েক পর তারাও ফিরে আসে। সুতরাং যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহের জন্য রিপোর্টারের পরিকল্পনা, প্রতিষ্ঠানের সদিচ্ছা এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

যুদ্ধ সংবাদ বিশ্বাস করার প্রশ্নে বলবো, পশ্চিমাদের থেকে বাংলাদেশের মিডিয়া যুদ্ধ সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে কম পক্ষপাতদুষ্ট নয়। আমার মনে আছে ইরাক যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগের দিন আমি সংবাদ পাঠালাম যে, সাদ্দামের পতন এখন ঘণ্টায় কাউন্টডাইন চলছে। আমাদের নিউজ এডিটর সেটা দেননি কারণ পাঠক নাকি সেটা হজম করতে পারবে না। সাদ্দামের ইরাকি বাহিনী আমেরিকার পতন ঘটাচ্ছে এমন হেডলাইনে নিউজ দিয়েছিল। পাঠক কি হজম করবে সেটার দায়িত্ব নিচ্ছে মূর্খ, বায়াস নিউজ এডিটর। পাঠককে সিদ্ধান্ত নিতে দিচ্ছে না, সবাই মিলে বিভ্রান্ত করেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধেও সে ধরনের নিউজ প্রাধান্য পাচ্ছে। ঢাকার মিডিয়ার কেউ কেউ জোর করে ইউক্রেনের বিজয় দেখাতে তৎপর, যেভাবে পশ্চিমা মিডিয়া দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে গ্রাউন্ড জিরোতে কোনো রিপোর্টার নেই বলে সবাই পশ্চিমা মিডিয়ার আবর্জনা পরিবেশন করছে। আবার ওয়েস্টার্ন মিডিয়ায় ইউক্রেনিয়ানদের নিয়ে হিউম্যানিটেরিয়ান রিপোর্টের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে 'মুক্তিযোদ্ধাদের' সংবাদ। যুদ্ধে সত্যিকার অর্থে এটাই সব মিডিয়ার প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। দুঃখজনক হচ্ছে ইরাক কিংবা আফগানিস্তানের যুদ্ধে এর ছটাকও দেখিনি পশ্চিমা মিডিয়ার যুদ্ধ সংবাদে।

এইসব মিডিয়া যে বর্ণবাদী তার চেহারাও ফুটে উঠছে তাদের রিপোর্টে। হিউম্যানিটেরিয়ান ক্রাইসিস নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে কিছু সংবাদদাতা 'তারা সোনালী চুলের, তারা নীল চোখের, তারা সাদা, তারা খ্রিস্টান, তারাতো ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া বা তৃতীয় বিশ্বের নয়, তারা সভ্য ইউরোপের'- এমন সব বর্ণবাদী শব্দ উচ্চারণ করছে।

আসলে যুদ্ধাবস্থায় মাঠের যুদ্ধের সঙ্গে মিডিয়ার যুদ্ধও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুদ্ধরত দু’পক্ষই প্রোপাগান্ডা ছড়ায় যুদ্ধ সাংবাদিকদের মাধ্যমেই। সেটা আবার পরিবেশনে বাধা দিলে একে অন্যের মিডিয়াকে ব্যান করে দেয়। `আমার প্রোপাগান্ডা দেখতে না দিলে তোমার প্রোপাগান্ডাও দেখতে দেব না'- এই নীতিতে। সে কারণে যুদ্ধরত দুটি দেশের সরকারি ভাষ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবর্জনা পরিবেশনের মতোই। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে মাঠের রিপোর্টারদের তাই দিতে হয়, নির্ভরযোগ্য সোর্স থেকে সেটার সত্যতা যাচাই সম্ভবও হয় না তাদের পক্ষে।

তাই বাংলাদেশি মিডিয়ার উচিত নিরপেক্ষ মিডিয়াকে সংবাদ সূত্র বানানো। পাঠক হিসেবে আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে আর বেশি। যুদ্ধরত দু’ পক্ষের সংবাদের মধ্যে কার কথা সত্য বুঝতে হবে নিজের কমনসেন্স ব্যয় করে। দেখতে হবে মিডিয়ার চরিত্রও। সেটি কি পশ্চিমা, নাকি তৃতীয় বিশ্বের, কতটা স্বাধীন মিডিয়া- সেসবও বিবেচনায় নিয়ে নিজের মত করে ভাবতে হবে।

‘কনফার্মেশন বায়াস’ বা নিজে যেটা বিশ্বাস করি সেটার সঙ্গে মিললে সেই মিডিয়াই সত্য সংবাদ পরিবেশন করছে- এই ভাবনার মনোজগৎ থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন