জাটকা নিধন প্রতিরোধ নাকি জেলে নির্মূল কর্মসূচি
মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দিনোত্তর উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন নতুন পদক্ষেপ এ অর্জনের পথ প্রশস্ত করেছে। অবশ্যই এজন্য সরকারি উদ্যোগকে প্রশংসা করতে হয়।
এর মধ্যে চাষের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদনে ঈর্ষণীয় অবস্থানে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি বিশ্বের দ্বিতীয় স্থান লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বের ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে। বাংলাদেশের ইলিশ স্বাদেও অনন্য। দেশীয় চাহিদা পূরণে এখন আর ঘাটতি থাকে না।
সবই আমাদের দেশের সরকারি উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টার ফল। সুতরাং এই প্রশংসাটুকু আমাদের করতে দ্বিধা হওয়ার কথা নয়। একই সঙ্গে বলতেই হবে, এই মৎস্য সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া এবং ডাইনিং টেবিলে নিয়মিত মাছের সরবরাহের পেছনে আমাদের জেলেদেরও ভূমিকা বিশাল। জেলেদের অবস্থান কোথায়?
দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, আমাদের জেলেদের প্রশংসার পরিবর্তে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। যেমন ৭ মার্চ গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদে জানা গেলো কীভাবে জেলেদের ওপর স্টিমরোলার চালানো হচ্ছে। সরকার মার্চ মাসের প্রথম দিন থেকে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে, মূলত জাটকা নিধন নিরোধ করার জন্য। এক দশককালেরও বেশি সময় ধরে চালু হওয়া এ নিষেধাজ্ঞা আমাদের মৎস্য সম্পদকে সমৃদ্ধ করেছে। এখন অন্তত বাজারে মানানসই সাইজের ইলিশ পেতে সমস্যা হয় না। ছোট আকারের মাছ নেই বললেই চলে। এ কারণে মাছের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বিশেষ সুবিধাও অর্জন হয়েছে। কিন্তু সচ্ছল মানুষের ডাইনিং টেবিলে সুস্বাদু ইলিশ জোগান দিতে গিয়ে খেটে খাওয়া জেলেদের জীবনকে জিম্মি রাখতে হবে এ কেমন বিধান?
প্রতি বছরই এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। সরকার একইসঙ্গে জেলেদের বিষয়টিও চিন্তা করেছে। নিঃসন্দেহে এ সিদ্ধান্তটি সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট সহায়ক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, জেলেদের আইন অনুযায়ী চলতে যে সহযোগিতা প্রয়োজন সেটা কি সরকার বাস্তবায়ন করছে? গণমাধ্যমে দেখলাম শুধু ভোলায়ই ৭ মার্চ দুপুর পর্যন্ত ১৯৭ জন জেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৩০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেলও দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতার এবং জেল জরিমানা এখানেই শেষ নয়। এ অভিযান চলবে মার্চ ও এপ্রিল মাস ধরে। সুতরাং গ্রেফতার এবং কারাবাস বাড়তে থাকবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
টেলিভিশনে সেসব জেলের ছবি প্রচার হয়েছে। অত্যন্ত লজ্জাজনক সেই দৃশ্য। আমার দেশের খেটে খাওয়া এই মানুষগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে চোর-খুনির মতো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই দৃশ্যটি দেখার পর ভোলার একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয়। রীতিমতো অবাক হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা। জানতে পারি ভোলার প্রায় ২ লাখ জেলের মধ্যে মাত্র ১ লাখ ৪২ হাজার জেলে নিবন্ধিত হয়েছেন।
নিবন্ধিত জেলেদের ১ মার্চ থেকে মাসে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা সরকারের। অথচ যে মুহূর্তে তাদের আইন অমান্য করার দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে তখনও তাদের কেউই এক মুষ্ঠি চালও পায়নি। সাতদিন চাল না পেয়ে জেলেরা পেটের দায়ে নদীতে নামে আর তাদের গ্রেফতার করে কাউকে জরিমানা কাউকে জেলে পাঠানো হয়েছে। অভিযোগ তারা আইন অমান্য করেছেন।
মৎস্য অধিদফতর বলছে, তারা আইন অনুযায়ী এটা করতে বাধ্য। প্রশ্ন হচ্ছে-আইন অমান্যকারীকে তাদের যেমন আইনে সোপর্দ করতে বাধ্য তেমনি জেলেদের বরাদ্দ করা চালও তাদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটাও যে তাদেরই। তারা কি সেই কাজটি করেছে? স্পষ্ট জবাব হচ্ছে, কাগজপত্রে চাল বরাদ্দ হলেও ৭ মার্চ পর্যন্ত এক কেজি চালও বিতরণ হয়নি।
জেলেদের এক কথা, তারা সরকারের আইন মানতে রাজি। তারা এও বলছে, এ আইন তাদের আখেরে সুবিধাই প্রদান করছে। কিন্তু ঘরে খাবার না থাকলে কি তারা বসে থাকতে পারে? একজন জেলেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তার স্ত্রীকে দেখা গেলো নদীঘাটে দৌড়ে গেছেন। কোলে তিন মাসের এক শিশু।
শিশুটিকে নিয়ে তার মা হাসপাতালে ছিলেন। অসুস্থ ছেলের চিকিৎসা ব্যয় চালাতে এই জেলে আইন অমান্য করে নদীতে গেছেন মাছ ধরতে। আর সেই অবস্থায়ই মোবাইল কোর্টের সামনে পড়েন তিনি। টিভি সংবাদে দেখা গেলো ভোলার সেই আব্দুল আলী স্পষ্ট বলছেন, তিন মাসের শিশুর চিকিৎসা ব্যয় চালাতে না পেরে তিনি বাধ্য হয়ে নদীতে গেছেন।
অন্য জেলেদের অবস্থাও একই। তাদের কথা, সরকার আমাদের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে আমরা যে বেকার থাকবো এই সময় আমাদের সংসার কীভাবে চলবে তার কি ব্যবস্থা করেছে? আমরা আইন মানতে গিয়ে কি উপোশ থাকবো? চাল বরাদ্দের শুকনো কথায় কি আমাদের চুলোয় হাঁড়ি বসবে?
উপরের হিসাবটা শুধু ভোলা জেলার। এর বাইরে চাঁদপুর, বরিশাল ও শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন এলাকা রয়ে গেছে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী ভোলায়ই প্রায় ৬০ হাজার জেলে এখনও নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে। ভোলার জেলেদের জন্য ইতোমধ্যে সাড়ে ৭ হাজার টন চাল বরাদ্দ হয়েছে।
হয়তো একসময় এই চাল বিতরণ করা হবে। তখনও বঞ্চিত থাকবে অর্ধলক্ষাধিক জেলে পরিবার। অন্য জেলায় যে ভিন্ন চিত্র হবে না তা সহজেই অনুমান করা যায়। ধরা যাক দু-একদিনের মধ্যে বরাদ্দ করা চাল দেওয়া শুরু হবে। সেই চাল তো পাবে নিবন্ধন হওয়া জেলেরা। বাকি জেলেরা কীভাবে চলবে এই সময়। তাদের আইন মানতে বাধ্য করা কি নির্যাতনের শামিল হবে না?
প্রতিটি জেলেকে জীবন বাঁচাতে এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়। মাছ ধরতে না পারলে এনজিওর ঋণ পরিশোধ বন্ধ থাকে না। কাবুলিওয়ালার মতো এনজিও কর্মীরা যখন জেলের বাড়িতে যায়, তখন সে বলতে পারে না আমি নদীতে যেতে পারি না মাছ মারার জন্য। তাই ঋণ আদায় স্থগিত করা হোক। এমন কথা জেলেরা বলতে পারে না।
৪০ কেজি চাল যদি পায় তাহলে হয়তো তাদের ঘরের ভাতের ব্যবস্থাটা হবে। যদি ওই লোকটির আয় বন্ধ হয়ে যায়, নগদ টাকা তার হাতে না থাকে তাহলে শুধু আব্দুল আলীই নয়, তার মতো অন্যরাও হবে অনিশ্চিত অবস্থার মুখোমুখি।
জেলেরা আইন অমান্য করে মাছ ধরে অন্যায় করেছে। কর্তৃপক্ষ আইন অমান্যকারীদের শাস্তি দিয়েছে, আইন মানতে বাধ্য করার জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে, আইন বাস্তবায়নের জন্য যে চাল দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে সরকার, তা কেন এখনও বিতরণ হলো না। ১ মার্চ থেকে মাছ ধরা নিষেধ হবে এটা কি তাদের জানা ছিল না?
জানা থাকার পরও আইন কার্যকর হওয়ার আগেই সেই চাল বিতরণ হলো না কেন। আইন অমান্য করার দায়ে নিরীহ জেলেদের কারাগারে পাঠানোর পেছনে কি এই ব্যর্থতা দায়ী নয়। সুতরাং আইন অমান্য করার জন্য যদি জেলেদের গ্রেফতার করা হয় আর আইন অমান্য করতে বাধ্য করার জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তি কি হবে? জেলেদের খাবারের ব্যবস্থা না করে তাদের আইন মানতে বাধ্য করা আর হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে বলার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
আইন কার্যকর করতে হলে এই মুহূর্তে নিবন্ধনের বাইরে থাকা জেলেদের দ্রুত নিবন্ধনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরও খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। যতদিন জেলেদের খাবারের ব্যবস্থা না হবে ততদিন আইন প্রয়োগ তাদের আহার কেড়ে নেওয়া বলে গণ্য হবে। সেই অধিকার নিশ্চয়ই কাউকে দেওয়া হয়নি। যেসব জেলে আইন অমান্য করার দায়ে কারাগারে গেছেন তাদের মুক্তির বিষয়টিও ভাবতে হবে।
দরিদ্র জেলেদের কাউকে হয়তো এক হাজার কাউকে হয়তো দুই হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। এই টাকাটা তাদের ঋণের টাকা। আইন প্রয়োগকারীরা আইন অনুযায়ী কাজ করেছেন, তাই যাদের ব্যর্থতা কিংবা অবহেলার কারণে এই জেলেরা আইন অমান্য করতে বাধ্য হয়েছে সেই অবহেলাকারীদের কাছ থেকে জরিমানার টাকা আদায় করে জেলেদের দেওয়া হোক। এমনটা হলে নিরীহ জেলেদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর সুযোগ তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে-পেটে ভাত না থাকলে ইবাদতেও মন বসে না, আইন অমান্য করাটা ক্ষুধার্থদের কাছে বড় কিছু মনে হয় না।
ইলিশ ও অন্যান্য মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ওজন বৃদ্ধির প্রয়োজনে সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে পালন হোক। এতে আমাদের কোনো দ্বিধা থাকা ঠিক নয়। একইসঙ্গে বেকার জেলেদের জীবনযাত্রা সচল করতে তাদের নগদ অর্থ সহযোগিতাও প্রয়োজন। তা না হলে আইন ও আইনের সুফল পাওয়ার মধ্যে পার্থক্যটা বাড়তে থাকবে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
এইচআর/এএসএম