বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিই ছিল প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার ঘোষণা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ছিল প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা ঘোষণা করেছেন। দীর্ঘ ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসকদের শোষণে শোষিত বঞ্চিত দিশেহারা বাঙালি জাতি সেদিন খুঁজে পেয়েছিল আপন জন্মভূমির অস্তিত্বের ঠিকানা।
পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি দিকনির্দেশনা ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি।’ তিনি অল্প কথায় সব বুঝিয়ে দিলেন তখন কী করতে হবে তারও স্পষ্ট সমাধান দিয়ে গেছেন। প্রকৃত অর্থে ১ মার্চ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের কার্যক্রম বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে চলতে থাকে। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে উড়তে থাকে লাল সবুজের পতাকা। ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি না থাকলে- আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দিবেন। তাদেরও যদি হত্যা করা হয়, যিনি জীবিত থাকবেন, তিনিই নেতৃত্ব দিবেন। যে কোনো মূল্যে আন্দোলন চালাইয়া যেতে হবে- অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
এমন কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে সামরিক শাসকদের উদ্দেশ্যে চারটি শর্ত দিলেন- ১. মার্শাল ল’ প্রত্যাহার করতে হবে; ২. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে; ৩. এ কয়দিনে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে; ৪. নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে এবং ভাষণের শেষাংশে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষভাবে প্রদান করেন- আবার যুদ্ধে কীভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈধ রাষ্ট্রপ্রধানের মতোই একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সর্বজনীনতা এবং মানবিকতা। এ ভাষণটি পৃথিবীর যেকোনো নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য সব সময় প্রেরণা হয়ে কাজ করবে। ভাষণটিতে গণতন্ত্র, স্বাধিকার আদায়, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা বলা হয়েছে।
এটি কোনো লিখিত ভাষণ নয়। তিনি এদেশের মানুষের জন্য দীর্ঘকাল ধরে যে কাজ করেছেন সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকে কথাগুলো বলেছেন। সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলেছেন। সেসময় জনগণ যা জানতে চেয়েছেন তিনি তাই-ই বলেছেন। একটি ভাষণ সমগ্র বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন মহানায়ক, এই ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎস। ভাষণটি আজ দেশ কালের গণ্ডি পেরিয়ে আরও সর্বজনীন হয়েছে। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণটি ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ বা বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যা সমগ্র জাতির জন্য গৌরবের।
২.
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের বক্তব্য শেষ করেন ‘জয় বাংলা’ শব্দটি বলে। এই জয় বাংলাই হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র। এই স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন।
জয় বাংলা স্লোগানটি এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ‘৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান আন্দোলনের সময় থেকে চালু হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের ৭ জুন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় এই স্লোগানটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। তারপর থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি সভা-সমাবেশ-মিছিলসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের ব্যাপক ভাবে চালু হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করে এই স্লোগানকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন।
যে কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ও মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের পর তারাও ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করেছিলেন। পরে ১১ এপ্রিল ১৯৭১, অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমেদ তার প্রথম বেতার ভাষণে ‘জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংল’ বক্তব্য দিয়ে শেষ করেছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়েই সব জাতি একতাবদ্ধ হয়েছিল। এই স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়েই বীর বাঙালি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানের ৩ ও ৪ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় সংগীত, জাতীয় প্রতীক ও ১৫০(২) অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত আমাদের কোনো জাতীয় স্লোগান ছিল না। পৃথিবীর অন্ততপক্ষে ৬০টি দেশে জাতীয় স্লোগান আছে। আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারতের জাতীয় স্লোগান ‘জয় হিন্দ’ ও স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের জাতীয় স্লোগান ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ'। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের এতদিন পর্যন্ত কোনো জাতীয় স্লোগান ছিল না।
’৭৫ পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে চালু করেন পাকিস্তানি কায়দায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। জয় বাংলার পরিবর্তে চালু করে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। দীর্ঘসময় ‘জয় বাংলা’কে এক প্রকার নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।
‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার দাবিতে ২০১৭ সালে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী বশির আহমেদ। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট ২০২০ সালের ১০ মার্চ একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। রায়ে, সব রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বস্তরের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাত্যহিক সমাবেশ সমাপ্তির পর এবং সভা-সেমিনারে বক্তব্য শেষে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের জয় বাংলা স্লোগান বলতে ও দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। আদালত পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, ‘জয় বাংলা জাতীয় ঐক্যের স্লোগান। জয় বাংলা ৭ মার্চের ভাষণের সঙ্গে সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ের আলোকে গত ২ মার্চ সরকার ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে কেউ যদি না মানে সেখানে শাস্তির কথা বলা হয়নি। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেহেতু এটি সংসদ কর্তৃক পাসকৃত আইন নয়, আদালতের রায়। তাই শাস্তির কথা বলা না থাকলেও এটা যারা লঙ্ঘন করবেন তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা যাবে।
জয় বাংলা কোনো দলের স্লোগান নয়, এটা বাঙালির চেতনা, জাতীয় ঐক্য ও প্রেরণার প্রতীক। বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যক্তি কিংবা দল সবাইকে তা মানতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর জয় বাংলা এদেশের মানুষের হৃদয়ের সাথে মিশে আছে। ৭ মার্চের ভাষণের পর জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানকে বুকে ধারণ করে মুক্তিপাগল বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে, পাকিস্তানি হায়েনাদের পরাজিত করে ছিনিয়ে এনেছিল লাল সবুজের পতাকা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। প্রকৃত অর্থে ৭ মার্চের ভাষণটিই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/জেআইএম