ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

৭ মার্চের ভাষণ: স্বাধীনতার মহাকাব্য

ড. মিল্টন বিশ্বাস | প্রকাশিত: ০৯:৩১ এএম, ০৭ মার্চ ২০২২

এই পৃথিবীর পাঁচ হাজার বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের মতো কোনো ভাষণ শোনা যায়নি। যদিও অনেকে এই মহাকাব্যিক ভাষণের তুলনা করে থাকেন আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গের ভাষণের সঙ্গে অথবা তুলনা দেয়া হয় মহাত্মা গান্ধীর ১৯৪১ সালের ৮ আগস্ট কুইট ইন্ডিয়া ভাষণের। কিন্তু লিংকন অথবা গান্ধীর শব্দ উচ্চারণ, ক্ষোভ প্রকাশ, মানব মুক্তির স্বপ্ন সবই ভিন্ন ছিল আমাদের জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণটি থেকে। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান ও বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই ভাষণটিকে কেন্দ্র করে নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ কবিতার পংক্তিমালায় যথার্থই উপস্থাপিত হয়েছে- ‘লাখ লাখ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে।’

Jakob F. Field সম্পাদিত `We Shall Fight on the Beaches: The Speeches that Inspired History’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইতিহাসের অন্যতম ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। খ্রি:পূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষণগুলোর মধ্যে ৭ মার্চ যেমন শিল্প-সাহিত্যে অভিব্যক্ত হয়েছে তেমনি আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে।

দশ লাখেরও বেশি মানুষের সেই সমাবেশ মানব সভ্যতার ইতিহাসের বিরল ঘটনা। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে দীর্ঘদিনের শোষণ বঞ্চনা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন জনগণের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনই পাকিস্তানি শাসকচক্র ষড়যন্ত্র করে ১ মার্চ ঘোষণা দিয়ে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে। কারণ পাকিস্তানি পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো বলেছিল তাদের দল বাদ দিয়ে অধিবেশন বসলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জীবনযাত্রা নীরব নিথর করে দেয়া হবে। ইয়াহিয়া তার হুমকির কাছে মাথা নত করে। আর তার ঘোষণার পরে বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়।

প্রথমে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেও ৭ মার্চের ভাষণেই বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান ছিল এরকম- ‘তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছুই- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ একই বক্তৃতায় তিনি হানাদার পাকিস্তানিদের প্রতি শান্তি প্রস্তাব দিয়েছেন; বলেছেন- ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।’

এই প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ‘আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো’ অর্থাৎ নিরস্ত্র প্রতিরোধের ডাকও দিয়েছেন তিনি। ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করে সকলেই স্বীকার করেছেন এটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু সুচিন্তিত এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এর প্রভাব ছিল প্রত্যক্ষ। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক ছিল বঙ্গবন্ধুর সাময়িক কৌশল; বিশ্বাস নয়। তাঁর বিশ্বাস ছিল সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র যুদ্ধের রাজনৈতিক বিশ্বাস। লক্ষণীয় তাঁর ভাষণজুড়ে রয়েছে সামরিক প্রসঙ্গ। পাকিস্তানিদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন- ক) সামরিক আইন বা মার্শাল ল প্রত্যাহার করতে হবে। খ) সামরিক বাহিনীর সমস্ত লোকদের ব্যারাকের ভিতর ঢুকতে হবে। গ) যে ভাইদের সেনাবাহিনী হত্যা করেছে তার তদন্ত করতে হবে। তাঁর এই নির্দেশ ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের জন্য ‘গ্রিন সিগন্যাল’।

এজন্যই ২৫ মার্চের হানাদার বাহিনীর আক্রমণের পরে দ্রুত বাঙালি সেনা অফিসাররা প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়েন। ৭ মার্চের পরেই ছাত্র-জনতা এবং আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীরা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের ডামি রাইফেল নিয়ে সামরিক ট্রেনিং শুরুর সেই চিত্র সকলেই মনে থাকার কথা। পূর্ববাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ১৫ মার্চ কর্মীদের মধ্যে এক বিশেষ গোপন সার্কুলার প্রচার করেছিল। সেটির একটি অংশ- ‘জাতি আজ বুঝিতে পারিয়াছে যে, একমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামেই সে স্বাধীনতা অর্জন করিতে পারে এবং সেইজন্য নিজস্ব উদ্যোগে সশস্ত্র হইবার চেষ্টা করিতেছে।... আমরা আজ এক যুদ্ধকালীন অবস্থার মধ্যে রহিয়াছি। এ যুদ্ধ জাতীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমরা অংশগ্রহণ করিতেছি এবং জয়যুক্ত হইতে চাই।...’

১৮ মার্চ বিমানবাহিনীর সাবেক জওয়ানরা ঢাকায় শহীদ মিনারে এক সমাবেশ করে বাংলার মুক্তিসংগ্রামকে ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামের মতো রূপ দেয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। স্বাধীন বাংলা বিমানবাহিনী গঠনের লক্ষ্যে তাদের সমাবেশ ছিল ৭ মার্চের প্রত্যক্ষ ফল। ১৯ মার্চ সামরিক কর্তৃপক্ষ জয়দেবপুরে অবস্থানরত এক ব্যাটালিয়ন বাঙালি সৈন্যকে অস্ত্রসমর্পণের নির্দেশ দেয়, কিন্তু বাঙালি সৈন্যরা এ নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে একইদিনে বঙ্গবন্ধু ও কর্নেল ওসমানী ঢাকায় এক গোপন বৈঠকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক পর্যালোচনা করেছিলেন।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক অফিসারও এসময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গোপনে দেখা করে নির্দেশাবলি গ্রহণ করেন। ২০ মার্চ ছাত্র ইউনিয়নের ট্রেনিংপ্রাপ্ত শত শত গণবাহিনীর ঢাকার রাজপথে ডামি রাইফেল কাঁধে নিয়ে মার্চপাস্ট ছিল মানুষের কাছে নতুন উদ্যমের দৃষ্টান্ত। পাকিস্তানি দিবস হিসেবে পালন করে আসা ২৩ মার্চকে বঙ্গবন্ধু ‘লাহোর প্রস্তাব দিবস’ ঘোষণা করেন এবং দিনটি ছুটি ঘোষিত হয়।

সেদিন পল্টন ময়দানে সকাল ৯ টায় ‘জয় বাংলা বাহিনী’র কুচকাওয়াজ ও মহড়া অনুষ্ঠিত হয় এবং কুচকাওয়াজ শেষে সারাশহর ঘুরে মার্চ করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তাঁর অভিবাদনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। আর এসব আয়োজনই সম্ভব হয়েছিল ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর প্রদীপ্ত ভাষণের পরে। সেজন্য কামান, মর্টার ও রাইফেল নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রাথমিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের।

ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে ফার্মগেটে এসে পাকিরা যেমন বাঁধা পেয়েছে তেমনি পিলখানায় ইপিআর আর রাজারবাগে পুলিশের প্রতিরোধের মধ্যে পড়েছে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু এই সংবাদ পেয়ে ওয়ারলেস, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনে ‘সমস্ত শক্তি জড়ো করে প্রতিরোধ আর স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিতে’ নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চের রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

তিনি বলেন, ‘এই-ই হয়তো তোমাদের জন্য আমার শেষ বাণী। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। যে যেখানেই থেকে থাকো, যে অবস্থায় থাকো, হাতে যার যা আছে, তাই দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে, যতদিন পর্যন্ত না দখলদার পাকিস্তানিদের শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে।’

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেই তিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। ২৫ মার্চ বললেন, ‘বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ'। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা থেকে শুরু করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্বদিন পর্যন্ত দেশের গণমানুষের উন্নয়নের কথা বলেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল তাঁর রাষ্ট্রনীতি। তিনি সবসময় শোষিতের মুক্তি কামনা করেছেন।

আজীবন সংগ্রামে যেমন তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি; তেমনি স্বাধীন দেশের সমাজকে সব অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল তার বলিষ্ঠ ভূমিকা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচিতেও শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলেন। তিনি দীপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আওয়ামী লীগের মাথা কেনার মতো ক্ষমতা পুঁজিপতিদের নেই।’ সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে ১৬ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছে।’

এসব মুনাফাখোর কালোবাজারীদের কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি করে দেন তিনি। এ সময় তিনি শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য ধৈর্য ধরে কাজ করার কথাও বারবার উল্লেখ করেন। অন্যদিকে সাতচল্লিশের দেশভাগের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্নাত হন। তিনি তাঁর আত্মজীবনী লেখার ডিকটেশন দেয়ার সময় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন থেকে ফজলুল হক, ফজলুল হক থেকে সুভাষচন্দ্র, সুভাষচন্দ্র থেকে আবুল হাশিম-শরৎচন্দ্র (সুভাষ বসুর ভাই) এবং দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন ও ছয়দফা পর্যন্ত যদি বাংলার রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করো, তাহলে দেখবে অসামপ্রদায়িক স্বাধীন বাংলার সুপ্ত চেতনার জন্ম সাতচল্লিশের বাংলাভাগের আগেই এবং সেই চেতনারই প্রথম বহিঃপ্রকাশ আটচল্লিশ সালেই অসাম্প্রদায়িক ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে।’

আর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এভাবে ঐতিহাসিক কালানুক্রমিক ঘটনাধারা মনে রাখলে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব। একাত্তরের ১৩ মার্চে কূটনৈতিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিসিঞ্জার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে এক স্মারকে জানিয়েছিলেন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দান থেকে নিবৃত্ত থাকাটা দৃশ্যত কৌশলগত। আর এই স্মারকেই কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর প্রতি একটা গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ মন্তব্য করেন।

শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তাঁর নেতিবাচক মন্তব্যগুলো অনেক বেশি প্রচার পেয়েছে কিন্তু যেটি পায়নি সেটি হলো কিসিঞ্জার নিজেই নিক্সনকে বলেছিলেন, শেখ মুজিব যেভাবে গান্ধীর মতো অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করছেন, তাতে সেখানে দমন-পীড়ন চালানোর যথার্থতা দেওয়া কঠিন। কিসিঞ্জারের নিজের ভাষায়, ...রহমান হ্যাজ এমবার্কড অন এ গান্ধিয়ান টাইপ নন-ভায়োলেন্ট নন-কো-অপারেশন ক্যাম্পেইন হুইচ মেকস ইট হার্ডার টু জাস্টিফাই রিপ্রেশন। ১ থেকে ৭ মার্চ-বিষয়ক নথির একটি পৃষ্ঠা ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ সহকারী জোসেফ সিসকো ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘সব ইঙ্গিত স্পষ্ট করেছে যে ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। এবং সম্ভবত সেটা হবে স্বাধীনতার সমতুল্য।’

আগামী প্রজন্ম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাসের পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে উল্লিখিত স্বাধীনতার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কারণ পৃথিবীর কোথাও এরকম ভাষণ শোনা যায়নি। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান ও বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৭ মার্চের ভাষণটিকে কেন্দ্র করে নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ কবিতার পঙক্তিমালায় যথার্থই উপস্থাপিত হয়েছে- ‘লাখ লাখ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে।’

দশ লাখেরও বেশি মানুষের সেই সমাবেশ মানব সভ্যতার ইতিহাসের বিরল ঘটনা। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে দীর্ঘদিনের শোষণ বঞ্চনা থেকে বঙ্গবন্ধু যখন জনগণের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনই পাকিস্তানি শাসকচক্র ষড়যন্ত্র করে ১ মার্চ ঘোষণা দিয়ে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে।

নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করলে ভুট্টোদের বঙ্গবন্ধুর কর্তৃত্ব মেনে নিতে হতো। সেটা না মানার জন্যই পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো বলেছিল তাদের দল বাদ দিয়ে অধিবেশন বসলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জীবনযাত্রা নীরব নিথর করে দেয়া হবে। ইয়াহিয়া তার হুমকির কাছে মাথা নত করে। আর তার ঘোষণার পরে বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়।

‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘পদ্মা- মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা বাংলা’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’- এসব স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশ তখন মিছিলের সমুদ্র। বঙ্গবন্ধু জানান বিনা চ্যালেঞ্জে তিনি কোনো কিছুই ছাড়বেন না। ছয়দফার প্রশ্নে আপস না করারও ঘোষণা আসে। ১ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর আদেশে ছাত্রলীগ আর ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’গঠিত হয়। চলমান অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। গণজাগরণের এই পরিস্থিতিতে ৭ই মার্চ ছিল স্মরণীয় দিন।

৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে কলকাতার অধুনালুপ্ত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার এককালের সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় দেখেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং উপমহাদেশের দুটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারার দর্শনের প্রভাব অর্থাৎ গান্ধীজির নিরস্ত্র নৈতিক যুদ্ধের আহ্বান এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনৈতিক দর্শন।

এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী ধাপেরও নির্দেশ রয়েছে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে। উপরন্তু ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যটি সারা দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের কাছে মুক্তিমন্ত্রতুল্য। খ্যাতিমান গবেষকের মন্তব্য, ‘বাঙালির মুক্তির সনদ ছিল এই ভাষণটি। এই দিনই রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। পাকিস্তানকে বাঙালিরা প্রত্যাখ্যান করে।’

৭ মার্চ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেকগুলো কবিতা। ‘রাজনীতির কবি’র ৭ মার্চের ভাষণই একটি মহাকবিতা। পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছে বারবার, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণআন্দোলন সংঘটিত হয় তাঁর নেতৃত্বে। ৭১-এর প্রথম মাস জানুয়ারি থেকে তিনি মুক্তিকামী মানুষের শৃঙ্খল মোচনের শপথে উদ্দীপিত করেন সাধারণ মানুষকে- রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা এবং বুদ্ধিজীবী মহলের প্রত্যেককে; কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক নির্বিশেষ। বাঙালির নিজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে চিনতে শেখা তাঁর মাধ্যমেই।

৭ মার্চে ভাষণের আগে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয়েছিল। এসবই আছে কবিতার মধ্যে। বঙ্গবন্ধুর আত্মদানকে অর্থবহ করার জন্যই এই কবিতাবলি। তাঁর রক্তের ঋণ শোধ হবে না কিন্তু তার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় জেগে থাকবে এসব কবিতার মধ্য দিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় লিখিত জসীম উদ্দীনের ‘বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক কবিতায় এই ঐতিহাসিক ভাষণের কথা বলা হয়েছে। বিশেষত বঙ্গবন্ধুর একাত্তরের মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনের বিষয়টিকে কবি তুলে ধরেছেন দীর্ঘ কবিতাটির একটি অংশে-
‘তোমার হুকুমে রেল-জাহাজের চাকা যে চলেনি আর
হাইকোর্টের বন্ধ দরজা খুলিবে সাধ্য কার!
. . . . . . . . .
তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন-ত্রাসন ভয়,
আমরা বাঙালি মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।’

কবি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণাবলির প্রশংসা করেছেন। তাঁর আপসহীন অবস্থান ও মানুষের আস্থা-ভরসার নেতা হিসেবে মুক্তিসংগ্রামে বিজয়ের চিত্রও তুলে ধরেছেন তিনি। ৭ মার্চের ভাষণই মানুষকে নতুন এক স্বপ্নে আন্দোলিত করে। জাগরণ ও শিহরণে উদ্দীপিত মানুষ মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে উৎসাহী হয়। জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান বঙ্গবন্ধু।

নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’, ওমর আলীর ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, সানাউল হকের ‘সাতই মার্চ একাত্তর’, আল মাহমুদের ‘নিশিডাক’ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকেন্দ্রিক কবিতা। নির্মলেন্দুর কবিতার একটি অংশ-

‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি;

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’

কবির বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। ১৫ আগস্টের পরে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে গণ্য করার প্রচেষ্টা নিরর্থক - এই কবিতাই তার সাক্ষ্য। আল মাহমুদের কবিতার অংশ বিশেষ-

‘তাঁর আহ্বান ছিল নিশিডাকের শিস্ তোলা তীব্র বাঁশীর মত।
প্রতিটি মানুষের রক্তবাহী শিরায় কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে তা বাজত
. . . সে যখন বলল, ‘ভাইসব’।
অমনি অরণ্যের এলোমেলো গাছেরাও সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল
সে যখন ডাকলো, ‘ভাইয়েরা আমার’।. . .
অসীম সাহার কবিতায় এভাবে প্রকাশিত ৭ই মার্চ-
‘তুমি হাত উত্তোলিত করলেই
হিমালয় মাথা নিচু করে তোমার পায়ের কাছে এসে
আনত প্রজার মতো জানায় কুর্নিশ।’

এছাড়া শামসুল আলমের ‘এবারের সংগ্রাম... স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তাহমীদুল ইসলামের ‘সমুদ্রের অর্কেস্ট্রাঃ ৭ মার্চ ১৯৭১ খৃস্টাব্দ’ প্রভৃতি কবিতা একই প্রসঙ্গে রচিত। শামসুল আলমের কবিতায় ৭ই মার্চের ভাষণকে ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

‘স্বাধীনতার কবি’ শামসুর রাহমানের একাধিক কবিতায় বঙ্গবন্ধু রূপক-প্রতীকে আবার কখনো সরাসরি আত্মপ্রকাশ করেছে। ‘ধন্য সেই পুরুষ’, ‘যাঁর মাথায় ইতিহাসের জ্যোতির্বলয়’, ‘ইলেকট্রার গান’, ‘তোমারই পদধ্বনি’ প্রধান কবিতা। ‘ইলেকট্রার গান’ বেশ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বাঙলাদেশের সাথে: ‘বিদেশী মাটিতে ঝরে নি রক্ত; নিজ বাসভূমে,/ নিজবাসগৃহে নিরস্ত্র তাঁকে সহসা হেনেছে ওরা।’

স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডকে। কিন্তু কবিতাটি আদ্যন্ত গীতিময়, জাতিসত্তার বাণীবহ মহাকাব্যিক চারিত্র এর নয়। তবে এ কবিতায় এ্যাগামেননের (বঙ্গবন্ধু) হত্যাকাণ্ডের পর নিহত পিতার জন্য কন্যা ইলেকট্রার(শেখ হাসিনা) শোক সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর জন্য হাহাকার ব্যক্ত হয়েছে। এ কবিতায় বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়াকে নিয়তি বলে ধরে নিতে দেখা যায়। শোকে কবি লুকিয়ে বিলাপ করেন, তাতে মন সান্ত্বনা মানে না।

হত্যাকারীরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় আর কবির ওপর চোখ রাখে। তবুও কবি অন্তরে শোক লালন করে যাবেন। ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতায় উন্মোচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মহিমা। তাঁর নেতৃত্ব ও মানুষের জন্য ব্রতের সমুজ্জ্বল চিত্রণ এখানে অনন্য। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত এই কবিতাটি আমার মতে শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা। কবির বিভিন্ন কবিতার কিছু কিছু অংশ-

ক) ‘ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের ওপর পতাকার মতো
দুলতে থাকে স্বাধীনতা,
ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের ওপর ঝরে
মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’

খ) ‘যতদিন আমি এই পৃথিবীর প্রত্যহ ভোরে
মেলব দুচোখ, দেখব নিয়ত রৌদ্র-ছায়ার খেলা,
যতদিন পাব বাতাসের চুমো, দেখব তরুণ

হরিণের লাফ, ততদিন আমি লালন করব শোক।
. . . . . . . . .
নিহত জনক, এ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।’

গ) ‘তারই কি আশ্চর্য প্রতিদান
যিশুর ধরনে পেয়ে গেলে তুমি। তবে ইতিহাস
চিরকাল মিথ্যার কুহক ছিঁড়ে গাইব সত্যের জয়গান।’

কবিতাকে শেখ মুজিবের সূর্যমুখী ভাষণের মতো বলেছেন কবি। মুজিবের নাম জুঁয়ের মতো, কৃষকের সানকিতে ফোটার কথাও বলেছেন তিনি। অন্যদিকে শামসুর রাহমানের মতো যিশুর প্রতীকটি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায়ও উচ্চারিত হয়েছে-

‘ফুরাবে না গঙ্গাধারা, ফুরাবে না বঙ্গভাষী কবিদের নিব
ফুরাবে না এই রক্ত, পিতা, তুমি যিসাস মুজিব।’

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কবিতায় পিতৃ-ইমেজ ব্যবহার সম্পর্কে কবীর চৌধুরী বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন কবিতায় এসেছেন তখন স্বাভাবিকভাবেই জনক বা পিতার অনুষঙ্গ বারবার কবিদের লেখায় ব্যবহৃত হয়েছে। পিতার ইমেজ সহজভাবে কবিদের লেখনীতে উঠে এসেছে, যেমনভাবে জাতির জনকের শিরোপা তার মাথায় কৃতজ্ঞ জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিয়ে দিয়েছে।’

পিতৃইমেজ আছে মহাদেব সাহার ‘তোমার হত্যাকারী’ এবং শিহাব সরকারের ‘পিতা’ কবিতায়। শোকাভিভূত কবিদের চেতনায় এভাবেই পিতৃহত্যার প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে। এজন্য আসাদ চৌধুরী ‘এ কেমন জন্মদিনে’ বলেন -

‘যে ঘাতক তোমার সুবিশাল ছায়াতলে

থেকে কেড়ে নিলো তোমার নিশ্বাস-
শিশুঘাতী, নারীঘাতী ঘাতকেরে যে করিবে ক্ষমা

তার ক্ষমা নাই-
আমরণ অনুগত,
তোমারই অবাধ্য হবে আজ,
পিতা, অনুমতি দাও।’

মূলত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কবিতায় বাঙালি জাতির ভাষার স্মৃতি উচ্চকিত হয়েছে। তাঁর মতো মহাপুরুষকে নিয়ে রচিত সৃজনকলায় কবিরা সমাজ ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য। কারণ কবিতার মাধ্যমে কবি একাত্মতার বাণী প্রচার করেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের একাত্ম হওয়ার এই বাণী অসংখ্য কবির অজস্র চরণে কখনো শেখ মুজিব, কখনো বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। স্বাধীনতার মহাকাব্য ৭ মার্চের ভাষণ শিল্প-সাহিত্যের অনন্য উদ্দীপনা।

লেখক : কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন