‘সোভিয়েত পরবর্তী যুগে নতুনের সূচনা’
ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দশের পর ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কিন্তু এই যুদ্ধ কতটা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আর কতটা মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে সেটা সময়ই বলবে। এই যুদ্ধ একদিন শেষ হবে, তবে আগামী অনেক বছর এর ফলাফল মানবজাতিকে ভোগ করে যেতে হবে।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে পৃথিবীতে একচ্ছত্র আধিপত্য পেল আমেরিকা। আমেরিকার সঙ্গে টক্কর নিয়ে সোভিয়েত যেমন দ্বিমেরু বিশ্বে বিকল্প শক্তির মাথা ছিল, সেটি আর থাকল না।
সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির ব্লকের নেতৃত্ব সোভিয়েতের হাতে ছিল। এখনকার বিশ্বের পরিস্থিতি তা নয়। এক প্রান্তে ভিয়েতনাম, অন্য প্রান্তে কিউবা এবং লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ, মধ্যপ্রাচ্য আর পূর্ব ইউরোপে একাই খেলছে আমেরিকা। সেই ভাবনা থেকে বলতেই হবে যে, সোভিয়েত মডেলের ভেঙে পড়া ছিল বড় এক বিপর্যয়।
সঙ্কটটা শুরু বেশ আগে। বলা যায় এক দশক বা তার চেয়ে কিছু সময় বেশি ধরে। পৃথিবীটা ক্রমেই একটি একক শক্তির হাতের পুতুল হয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে বড় শক্তিগুলোর কোন ভাবনা ছিল না। পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে দুটি দেশ রাশিয়া আর চীন বলতে গেলে কোন ভূমিকাই রাখতে পারছিল না পুরো পরিস্থিতিতে। বেইজিং ব্যস্ত ছিল অর্থনৈতিক অর্জনে আর মস্কো চেষ্টা করে গেছে তার নতুন পরিচয় নিশ্চিত করতে।
পৃথিবীতে ক্ষমতার ভারসাম্য ধ্বংস হয়েছে। আগেই বলেছি আজ থেকে দুই দশকের বেশি সময় আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে একক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভাব ঘটে আমেরিকার। ওয়ারশ জোট ভেঙে যাওয়ার বিপরীতে সম্প্রসারিত হয়েছে ন্যাটো।
সাবেক কমিউনিস্ট দেশ হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক এমনকি সোভিয়েত ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে আসা এস্তনিয়া, লিথুনিয়া, লাটভিয়াও ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। সংস্থাটির মোট সদস্যসংখ্যা বর্তমানে ৩০। সোভিয়েত-কে এতটাই ভয় ছিল আমেরিকা বা পশ্চিম ইউরোপের যে, ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে ন্যাটো পৃথিবীর কোথাও কোনো সামরিক অভিযান চালায়নি। চার দশক পর অপারেশন অ্যাঙ্কর গার্ড নামে তাদের প্রথম অভিযান শুরু হয়েছিল ইরাকের বিরুদ্ধে, দেশটি ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে যখন কুয়েত আক্রমণ করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে না গেলেও তার ভাঙনপ্রক্রিয়া তত দিনে সম্পন্ন হয়ে গেছে, ওয়ারশ জোটও তখন রয়েছে অবশ্যম্ভাবী বিলুপ্তির পথে। এর পরের ইতিহাস বড়ই মসৃণ। বসনিয়া হার্জেগোভিনা (১৯৯৩), কসোভো (১৯৯৯), আফগানিস্তান (২০০১), সোমালিয়া (২০০৯), লিবিয়া এবং সিরিয়ায় (২০১১) আমেরিকার নেতৃত্বে পর্যায়ক্রমিক সামরিক অভিযান চালায় ন্যাটো।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ-কে পাত্তা না দিয়ে অভিযানগুলো করতে আমেরিকাকে একটুও বেগ পেতে হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর রাশিয়া ও আমেরিকার সামরিক শক্তিতে যে পার্থক্য তৈরি হয়েছিল তার প্রভাব নগ্নভাবে দেখাতে শুরু করেছিল আমেরিকা। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল, মার্কিন একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার দিন সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে, এ বাস্তবতা টিকে থাকবে আগামী কয়েক দশক।
অনেকে বলেছেন সেটা হতে দিতে চান না পুতিন। ২০০৮ সালে জর্জিয়ায় অপারেশন চালিয়ে, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার সাথে একীভূত করার মাধ্যমে পুতিন জানান দিলেন আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য কেউ না কেউ আছে। তবে মার্কিনীদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের সরকারকে টিকিয়ে রাখতে রাশিয়ার সরাসরি উপস্থিত হওয়া, যার কারণে সেখান থেকে আমেরিকাকে সরেই আসতে হয়েছে।
সোভিয়েত পতনের পর আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য যে কেবল বিশ্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভারনাম্য নষ্ট করেছে তা নয়, বরং বলা চলে বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যটাও আর থাকেনি। সংস্কৃতিকে বিনাশ করে বাজার অর্থনীতির যাত্রা পৃথিবীর আসল বিকাশকে থামিয়ে দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী চক্রের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। একটি একক দর্শনের প্রভাবে বিশ্বের মানুষের চোখও একটি হয়ে গিয়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা করা যাবে। তবে পুতিন আমেরিকা বা তার পশ্চিমা মিত্রদের জন্য এটাও ভাবনা যে, তারা যা করেছে অন্য কেউও সেটা করতে পারছে। পুতিন এখন বলতে পারেন তিনি পশ্চিমাদের কাছ থেকেই এমন আক্রমণ করা শিখেছেন যেমনটা তারা করেছে সাবেক যুগোশ্লাভিয়ায়, ইরাকে, লিবিয়া বা সিরিয়ায়।
উত্তেজনা অনেকদিনের। ইউক্রেন এখন সেই বিশ্ব ভারসাম্য ফেরানোর ফ্রন্টলাইন। এটা কোন আদর্শিক যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ রাশিয়ার টিকে থাকার বা রুশ সাম্রাজ্যের নতুন করে সম্প্রসারণের। কেউ কেউ বলছেন বিশ্ব বৈচিত্র্যকে ফিরিয়ে আনার। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার প্রভাবের বলয় আর থাকছে না, এটা বলা যাবে না। তবে এটা বলা যায় যে, আজ পুতিনকে সাজা দিতে পশ্চিমারা যে সংঘবদ্ধ হয়েছে, তাদের ইরাক, সিরিয়া বা বসনিয়ায় আক্রমণের সময় এমন স্বচ্ছ মানবাধিকারের কথা কোথাও উচ্চারিত হয়নি, তাদের কেউ টার্গেট করে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়াও ক্রীড়া বা সাংস্কৃতিক জগৎ থেকেও কেউ তাদের বিচ্ছিন্ন করে নি।
পুতিনের ইউক্রেন লড়াইয়ে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে যেমনটা ঘটেছিল ইরাকে, লিবিয়া, সিরিয়ায়, বসনিয়া-হার্জেগোভিনায়। কিন্তু এর কৌশলগত তাৎপর্যও অনেক। ব্যাপক অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে পুতিন একটা বার্তা দিতে পেরেছেন যে, আমেরিকা ও তার অনুচর পশ্চিম ইউরোপের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কেউ না কেউ এখনও আছে। সোভিয়েত পতনের পর বিশ্ব মূল্যবোধ নির্ধারিত হয়েছে। পৃথিবীতে এখন কেবলই ভূমি দখলের নেশায় খুন খারাবি। এটাই স্বার্থ রক্ষা আর অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার সহজ কৌশল।
বিশ্ব নতুন মেরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দুটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও চীনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্ব কখনো খুব গভীর পর্যায়ে পৌঁছায়নি যেটা এখন দেখা যাচ্ছে। তবে সেই সময়েও সংকটের সময় চীনের রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৬২ সালে কিউবা মিসাইল ক্রাইসিসে চীন প্রকাশ্যেই সোভিয়েতের পক্ষ অবলম্বন করেছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নকে হুমকি দিয়ে রেডিওতে কেনেডির ভাষণ প্রচারিত হওয়ার পর পিপলস ডেইলি শিরোনাম করেছিল, ‘৬৫ কোটি চীনা নর-নারী কিউবার পাশে আছে।’
চীনের নিজেরও কিছু সমস্যা আছে। তাইওয়ানকে চীন বরাবরই নিজ ভূখণ্ড বলে মনে করলেও আমেরিকার জোরালো বিরোধিতার কারণে চীন এই দাবিটি উত্থাপন করতে প্রায় ভুলেই গেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে আরও অগ্রসর হলে কত দিন তারা চুপ করে থাকবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে পিপলস ডেইলির এক জরিপে জানা গেছে, বেশির ভাগ চীনা নাগরিক মনে করে তাইওয়ানের ব্যাপারে চীনের উচিত সামরিক ব্যাবস্থা গ্রহণ করা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত পাঁচ কোটি মানুষের দুই কোটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের তথা রাশিয়ার। রাশিয়া হয়তো ভেবেচিন্তেই রাজনৈতিক-সামরিক প্রভাব সম্প্রসারণের এই নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। যেসব অবরোধ আর নিষেধাজ্ঞা এসেছে সেগুলো হিসেব করেই রাশিয়া নেমেছে। এই যুদ্ধে রাশিয়ার বিজয় বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আনতে বাধ্য।
দুঃখের বিষয় যে, সেটা ঘটছে ইউক্রেনে নিরীহ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। রাশিয়ার জন্য সময়টা ক্ষমতা দেখানোর। স্ট্যালিনগ্রাদ, কুরস্ক বা মস্কো যুদ্ধের ডকুমেন্টারি যাঁরা দেখেছেন, তারা জাতি হিসেবে রাশিয়ানদের জাত্যভিমান সম্পর্কে জানেন। পুতিন মেরু ভল্লুকের মতো শীতল কিন্তু লক্ষ্যাভিমুখী। হয়তো পুতিন চলে যাবেন, রাশিয়া অনেক কিছু হারাবে, কিন্তু আমেরিকার এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্নে একটা নতুন আঘাত এলো ২০২২ সালের সূচনালগ্নে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এএসএম