ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ট্রল ফ্যাসিজমের শিকার: জায়েদ খান থেকে ‘একা’ ফেরদৌসী

মো. আনোয়ার হোসেন শামীম | প্রকাশিত: ০২:১৩ পিএম, ০৩ মার্চ ২০২২

ফ্যান-ফলোয়ার হিসেব করলে সম্ভবত এ মুহূর্তে বাংলাভাষীদের মধ্যে বড় সুপারস্টারদের তালিকায় সর্বাগ্রে স্থান করে নিবেন ‘কাঁচা বাদাম’ খ্যাত ওপার বাংলার ভুবন বাদ্যকর এবং বাংলাদেশের গায়ক, নায়ক, নির্মাতা আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। মডেল আরিফ খান, 'সি ইউ নট ফর মাইন্ড' ডায়ালগ দানকারী শ্যামল রায়েরাও থাকবেন শোভন অবস্থানেই।

জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে ঢালিউড নায়ক জায়েদ খান তাদের সঙ্গে তুলনীয় তো নন-ই, বরং তার ভক্তের সংখ্যার সঙ্গে জনৈকা ঢালিউড নায়িকার স্বামীর সংখ্যার তুলনা তো দাঁড়িয়ে গেছে হাল আমলের জনপ্রিয়তম ট্রলের টপিক হিসেবেই। উল্টো করে বলা যেতে পারে, বরং নেতিবাচক জনপ্রিয়তা তথা ট্রলের শিকার হবার ক্ষেত্রেই এইমুহূর্তে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে তিনি। প্রণিধানযোগ্য হলো, আজ দুপুরে সেই চরম 'অজনপ্রিয়' জায়েদ খানকেই সাধারণ সম্পাদক পদের বৈধ অধিকারী হিসেবে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।

আমাদের দেশের মানুষের একটি বহুল চর্চিত অভ্যেস হল, যেকোনো ইস্যুতেই দু’পক্ষে ভাগ হয়ে যাওয়া। প্রায় সবক্ষেত্রে পরস্পর প্রতিপক্ষ শিবিরে অবস্থান নিয়ে তাদেরকে মত-প্রতি মত প্রকাশ করতে দেখা গেলেও এবারের শিল্পী সমিতির নির্বাচনের সৌজন্যে দৃশ্যমান হলো এক অত্যাশ্চর্য ব্যতিক্রম বাস্তবতা। চা স্টলের আড্ডা থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কমেন্ট বক্স পর্যন্ত এক শ’ জনের মধ্যে নিরানব্বই জনকেই পাওয়া গেলো সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী জায়েদ খানের হেটাররূপে।

জায়েদ খান ইস্যুতে প্রায় পুরো দেশই মনে হলো ঐক্যবদ্ধ। জোয়ান-বুড়ো, হিন্দু- মুসলমান, গ্রাম্য-শহুরে,আওয়ামী লীগ -বিএনপি, শিক্ষিত- অশিক্ষিত, বামপন্থী -ডানপন্থীনির্বিশেষে সবাই একমত যে, জায়েদ খানই সকল নষ্টের গোড়া। শুধু সাধারণ মানুষই নন, জায়েদকে তোপ দাগাতে সামান্যতম কসুর করেননি চলচ্চিত্রাঙ্গনের ১৮ সমিতির নেতারাও। যে কোন উপায়ে হোক জায়েদকে আউট করতে হবে। জায়েদ খানকে আউট করতে পারলেই এই দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির শনৈঃ শনৈঃ অগ্রগতি অবশ্যম্ভাবী!

এ পর্যন্তও ঠিকই ছিল। কিন্তু এর পরই শুরু হয়ে গেল আমাদের তরুণ প্রজন্মের প্রিয় ট্রেন্ড- ট্রল, যার শুরুটা ওই নায়িকার স্বামীর সংখ্যার সাথে জায়েদের ভক্তের সংখ্যার তুলনা। তারপর নিন্দেমন্দ, টিটকিরি, ঠাট্টা মস্করা চলতে থাকলো সমান তালে। টানা কয়েক মাস। জায়েদ খানকে পঁচিয়েই যেন সবার সুখ, জায়েদের পরাজয়/অমঙ্গল এবং জায়েদবিরোধীদের (হোক নিপুণ, কিংবা অন্য কোন ছোটবড় নাম) সাফল্যেই সকলের আনন্দ।

আমি আসলে বুঝতে ভীষণরকম অপারগ যে, একজন চলচ্চিত্র তারকা, যিনি অনেকগুলো সিনেমায় নায়কের পাঠ করেছেন, তার এমন চরম অজনপ্রিয় হবার কারণটা আসলে কি? তার নিজের তরফে কোন ব্যর্থতা- ভুলভ্রান্তি, নাকি অল্পদিনেই তার পাদপ্রদীপের নিচে চলে আসা? ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছো, নায়ক হতে চেয়েছো, এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু কূল- গোত্রহীন লঞ্চ ঝুলে আসা বরিশাইল্লা এক যুবক ৩০/৪০ বছরের পুরনোদের ওপর ছড়ি ঘোরাবে, নেতৃত্বের আসনে বসবে! উঁহু। তা হবে না বাপু।

এটা ঠিক, মিডিয়াপাড়ায় কান পাতলে জায়েদের ব্যাপারে বেশ কিছু বদনাম শোনা যায়৷ সেসব আমিও শুনেছি। কিন্তু এক জায়েদ খান ছাড়া এই দেশের অন্য সবাই কি রাতারাতি সাধু পুরুষ হয়ে গেলেন! যদি তাই বা হবে, তাহলে কদিন পরপর দুর্নীতি, মাদকব্যবসায়, চোরাচালানি, মানিলন্ডারিং-এর অভিযোগ মাথায় নিয়ে যারা চৌদ্দ শিকের ভাত খেতে যান, তারা কি কোন ভিনগ্রহের আগন্তুক?

জায়েদ ছাড়াও অনেক শিল্পী আছেন, যাদের এমন সব কাজে সংশ্লিষ্টতার কথা আমরা শুনি/ শুনেছি, ন্যূনতম রুচিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে তা উল্লেখ করাও অসম্ভব। পরিচালক- প্রযোজকের ভূমিকায় থেকে শিল্পীদেরকে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাবদানকারীরা কি তবে এই দেশের মানুষ নন!

আমি ঢালাওভাবে সকল শিল্পীদেরকে দোষারোপ করছি না। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই সমাজের সকল অঙ্গনে, সব পেশায় নীতিবান মানুষের পাশাপাশি নীতিহীনদের উপস্থিতিও ছিলো, আছে, হয়তোবা পৃথিবীর শেষ দিনটিতেও থাকবে। কিন্তু সকল সমস্যা, অনিষ্ট, দুর্বিপাকের জন্য শুধু একজন মানুষকে দায়ী করা এবং ফাঁকতালে নিজেরা সবাই সাধুপুরুষ বনে যাওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত!

জায়েদ যা কিছু বলেন বা করেন, সবকিছু নিয়েই ট্রল/ব্যঙ্গবিদ্রূপে মেতে ওঠার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটাকেও একবার দেখুন! তারচেয়েও বড় কথা, চলচ্চিত্র অঙ্গন এবং বাহিরের এত এত রথি- মহারথিদের একপক্ষাবলম্বন এবং দেশের প্রায় সকল জনগণের ট্রল,বিদ্রুপ, বিরুদ্ধাচারণ সত্ত্বেও জায়েদ খান নামের 'খড়কুটো'টিকে উড়িয়ে দেওয়া গেল কি?

প্রসঙ্গত এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, বছর তিন-চারেক আগে এমনই ট্রলের শিকার হওয়া রন্ধনশিল্পী কেকা ফেরদৌসীর কথা। অদ্ভুতুড়ে সব রেসিপি এবং হাস্যকর উপস্থাপনার জন্য ট্রলের বন্যায় তাকে ভাসিয়ে দেওয়া হলেও একজনকেও আমি দেখিনি পত্রপত্রিকা দূরে থাকুক, নিদেনপক্ষে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে এই ভয়ানক চর্চার প্রতিবাদ জানাতে। শুধু দেখেছিলাম মানহানিকর প্রচারণার মুখে একজন সাধারণ গৃহবধূ হতে তারকা হয়ে ওঠা এক নারীর 'একা' হয়ে পড়া।

একইভাবে বহুকাল ধরে ট্রল সয়ে আসছেন ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফরুল্লাহ শরাফত, চিত্রনায়ক অনন্ত জলিলসহ আরো অনেকেই। কেকার অদ্ভুতুড়ে রেসিপি, চৌধুরী জাফরুল্লাহর যাত্রার নায়কের মতো টেনে টেনে দেওয়া ধারাভাষ্য, অনন্ত জলিলের ভুলভাল ইংরেজি উচ্চারণের ডায়ালগ এবং সবশেষ জায়েদ খানকে নিয়ে হেসে খুন হবার আগে একবার ভেবে দেখুন তো, আপনার জীবনে আপনি মানবসভ্যতার জন্য কোন মহত্তম অবদানটি রেখে ফেলেছেন!

এই মানুষগুলো তো তাদের রেসিপি ফলো করতে, ধারাভাষ্য শুনতে, মুভি দেখতে, নির্বাচনে ভোট দিতেকাউকে বাধ্য করেন নি! আমি সবার কাছে শুধু একটি অনুরোধ রাখতে চাই- একজন মানুষকে নিয়ে ক্রমাগত ব্যঙ্গবিদ্রূপ ঠাট্টামশকরার এই অরুচিকর ট্রেন্ড এবার দয়া করে বন্ধ করুন

আধুনিকতায় উত্তরনের নামে যে অসহিষ্ণুতা ও সাদিস্ট মনোবৃত্তি তরুণ প্রজন্মের মনোজগতে শেকড় গেড়ে চলেছে, নব্য ফ্যাসিজমের সর্বব্যাপী জনপ্রিয় রূপে জায়েদ খান- কেকা ফেরদৌসীদেরকে ট্রল ও মানহানিকর আক্রমণ হয়তো তারই প্রকৃষ্ট একটি বিজ্ঞাপন মাত্র।

লেখক : বিসিএস (পুলিশ), সহকারী পুলিশ সুপার, চট্টগ্রাম।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন