ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

যুদ্ধের বিপক্ষে মানুষ

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:৫৭ এএম, ০২ মার্চ ২০২২

বিশ্ব নেতাদের যুদ্ধ থামানোর পথ খোঁজা শেষ না হতেই ইউক্রেনে রাশিয়ার সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু হয়েছে। করোনা যুগের অবসান না হতেই ক্রেমলিনের আর তর সইলো না। ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ ১৩৭ জন ইউক্রেনীয় সৈন্য নিহত ও ৩১৬ জন আহত হওয়ার খবর জানানোর সঙ্গে জানান দিয়েছিল তুমুল লড়াইয়ের ভয়াবহতা। যার শুরুটা এখন সাধারণ মানুষের দেশ ছেড়ে পালানো ও ধ্বংসস্তূপ তৈরি করছে।

ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ভাষ্যে জানা গেছে, ইউক্রেনীয় সৈন্যের পাল্টা আক্রমণে ৪৫০ জন রুশ সেনার প্রাণহানির কথা। সাধারণ বা বেসামরিক মানুষ কতজন হতাহত হচ্ছে তার কোনো সঠিক খবর জানার চেষ্টা করতেই শোনা গেলো রুশরা ইতোমধ্যে ইউক্রেনে ৩৩টি বেসামরিক স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে এবং ছয় বছরের এত শিশুর মৃত্যুসহ হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছে।

ইইউ বলেছে, যুদ্ধের কয়েক সপ্তাহে ৭০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে। রাজধানী কিয়েভসহ সারাদেশে বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ ঘটছে। চতুর্দিক থেকে আক্রমণের সাথে রাতে যুদ্ধবিমান ও কৃষ্ণসাগর থেকেও মিসাইল ছোড়া হচ্ছে কিয়েভের দিকে তাক করে।

ইউক্রেনের নেতারা প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কিকে অনুরোধ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ফোন করে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাতে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুতিন ফোন ধরেননি। জেলেনস্কিকে সরিয়ে কিয়েভে ক্ষমতা দখল করে নেয়া হচ্ছে পুতিনের নির্দেশ। অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ ভয় পেলেও পোল্যান্ড ইতোমধ্যে অনেক ট্যাংক, ১৮ হাজার বন্দুকসহ নান সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য। ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ রাশিয়ার ক্রেমলিনসহ ছয়টি সরকারি দপ্তরের ওয়েবসাইটে হামলা চালিয়েছে হ্যাকাররা।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ফোন করেছিলেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ‘ফ্রাঙ্ক’ ফোন কলে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানান। জার্মানি ও তার পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়ার সুইফট কোড ও আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেছে। ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ ইউক্রেনে আরও সামরিক সরঞ্জাম ও জ্বালানি পাঠাচ্ছে ফ্রান্স।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ফোন করে যুদ্ধ থামানোর জন্য অনুরোধ করেছেন। তিনি ইউক্রেনের নিরাপত্তার জন্য ভারতের উদ্বেগের কথা জানান। তবে ইউক্রেনে যুদ্ধবিষয়ক জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাবে রাশিয়া ভেটো দিলে নিশ্চুপ ছিল চীন ও ভারত। এ থেকে মনে হচ্ছে, এই যুদ্ধ বন্ধ করা অতি সহজ হবে না।

নিউজিল্যান্ড থেকে রুশ রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাইওয়ান একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবছে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আদালতের প্রসিকিউটর করিম খান বলেন, সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করাটা যুদ্ধাপরাধ। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখবে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আদালত বা আইসিসি। রাশিয়া আইসিসির সদস্য নয়। তারা যুদ্ধাপরাধের বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু হেগের আইসিসি কিয়েভে রাশিয়ান সৈন্য কর্তৃক সাধারণ মানুষের জানমাল ধ্বংস হওয়ার ঘটনার তদন্ত করবে।

যুদ্ধের তাণ্ডব শুরু হলেও কিয়েভে থাকবেন প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, বিপদের এই সময়ে কিয়েভ একাই লড়ছে। পশ্চিমারা তাদের একাই ছেড়ে দিয়েছে রাশিয়ার আক্রমণের মুখে। শক্তিশালী দেশগুলো দূরে বসে তামাশা দেখছে। ন্যাটো প্রধান বলেছেন, যুদ্ধে ন্যাটোকে পাশে পাবে না ইউক্রেন। তবে আক্রমণের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে দেশ ছেড়ে চলে যেতে অসম্মতি জানানোয় প্রশংসায় ভাসছেন দেশপ্রেমিক অভিনেতা প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি।

রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি নিতে থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা হুমকি দিয়ে বিবৃতি দিলেও এখন কিছুটা নিশ্চুপ। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর পেন্টাগন পিছুটান দিচ্ছে কেন তা অনেকের কাছে বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, করোনার কারণে মার্কিনিদের অবস্থা বেশ খারাপ। তারা অর্থনৈতিকভাবে বেশ নাজুক এবং করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণের ঢেউ সামলাতে গিয়ে তাদের অবস্থা নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে।

এখন যুদ্ধে জড়ালে তাদের আরও বিপদ হতে পারে। তাই ইউক্রেনে যুদ্ধের ব্যাপারে প্রতিদিন গণমাধ্যমে বিবৃতির মাধ্যমে হুমকি-ধামকি দিয়ে ক্ষান্ত থাকছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ইউক্রেন তাদের নাগরিকদের রাশিয়া ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া ভারত বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশ ইউক্রেন থেকে তাদের নাগরিকদের নিজ নিজ দেশে চলে আসার জন্য নির্দেশ দিয়েছে।

এর অর্থ হলো সেখানে জীবনের আর কোনো নিরাপত্তা নেই। এই বার্তাকে বিশ্বশান্তির বিরুদ্ধে বড় হুমকি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ইউক্রেনের এক মা তার বাড়ির ধ্বংসলীলার ওপর দাঁড়িয়ে এই যুদ্ধকে পৃথিবীর ওপর চরম নিষ্ঠুরতার জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে দায়ী করেছেন। তিনি করোনাকালে মানুষর ওপর নিষ্ঠুরতা শুরু করেছেন। পুতিন কারও কথায় কর্ণপাত না করতে অনড়। কারও ফোন বা পরামর্শ তিনি শুনতে চাচ্ছেন না। শুধু সামরিক স্থাপনা নয়, সামরিক বেসামরিক সব জায়গায় নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেন পুতিন। ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেট্রো পবাসেঙ্ক মনে করেন, ‘আধুনিক যুগের হিটলার পুতিন’। সত্যিই তা হলে সেটা মানবতার জন্য ভয়ংকর ব্যাপার।

২০১৪ সালে ইউক্রেনে রুশপন্থী প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। রাশিয়া তখন ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। সেই যুদ্ধে ১৪ হাজার মানুষ নিহত হন। তখন থেকে রাশিয়া ইউক্রেনবিরোধী বিদ্রোহীদের সহায়তা করে আসছে। পরে ইউক্রেনে ক্ষমতায় আসেন জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ব্যক্তিত্ব প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি। কিন্তু ২০১৫ সালে ‘মিনস্ক’ চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর ক্ষুব্ধ ও নাখোশ হয়ে পড়ে।

পূর্ব ইউক্রেনে ১০ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে বেলারুশে এই চুক্তি করা হয়েছিল। এই চুক্তিতে উভয় পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহার ও যুদ্ধ বন্ধের মাধ্যমে রাশিয়ার সাথে সীমান্তের ওপর ইউক্রেন সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করা হয়। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে পুতিন বলেন, ‘মিনস্ক চুক্তির আর অস্তিত্ব নেই’। তবে অনেকে মনে করেন এটা গোয়েন্দা পুতিনের একটা থোড়া অজুহাত মাত্র।

যুদ্ধ শুরু করার আগে রাশিয়া ইউক্রেনের বড় রাজ্য ডনবাসকে ভেঙে ডোনেস্ক ও লুহানস্ক নামক দুটি আলাদা দেশ তৈরি করে এবং সেগুলোর স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এর কয়েকদিন পর রাশিয়ান সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে ইউক্রেনকে আক্রমণ শুরু করে। ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখে তারা কিয়েভের নিকটবর্তী বিমানবন্দর এবং চেরনোবিল পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্র দখল করে নেওয়ার খবর পাওয়া যায়।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর সারা বিশ্ব এখন সেই যুদ্ধের উত্তেজনায় উত্তাল। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে গেছে। শেয়ারবাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। রাশিয়াকে থামানোর পথ খুঁজে পাচ্ছেন না বিশ্বনেতারা। করোনায় অমান্ত বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল মানুষের জীবনে ভয়ংকর অশনি সংকেত বয়ে এনেছে। দুর্বল ইউক্রেনকে ঘায়েল করে হিরো হতে চান পুতিন। কিন্তু সেজন্য তাকে কি খেসারত দিতে হবে নিশ্চয়ই ভুলে বসেছেন তিনি। এই যুদ্ধ দিয়ে পুতিন গোটা বিশ্বকে কোথায় নিয়ে গিয়ে ঠেকাবেন তা হয়তো তিনি বা কেউই এখন কল্পনা করতে পারছি না।

কারণ, অতীতের যুদ্ধের ইতিহাস আধুনিক ডিজিটাল যুগের যুদ্ধকৌশলের মতো নয়। সেটা হতেও পারে না। এছাড়া করোনার মরণ কামড় অতি শক্তিশালী মানুষের স্নায়ুকেও আঘাত হেনে দুর্বল ও ভোঁতা করে রেখেছে। বহু প্রতাপশালী ও বিজ্ঞজনরা এখন বেসামাল জীবন-যাপন করছেন। তাদের সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত বেপরোয়া মনোভাব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা শুরু হওয়ার বার্তা নিয়ে এলো না তো?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়টি এখন সারা বিশ্বে তুমুল বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন দেশ এখনও এই যুদ্ধকে পর্যবেক্ষণ করলেও কার্যত দু-তিনভাগ হয়ে যাচ্ছে বিশ্বের মানুষ। করোনায় অশান্ত বিশ্বে যে কোনো যুদ্ধের বিপক্ষে বেশি মানুষ। তারা শান্তিতে বসবাস করতে চায়।

এরপরও বিশ্বনেতাদের এত আকুতি, এত অনুরোধ উপেক্ষা করে এত ফোনেও নির্বিকার পুতিন। মার্চ মাসের শুরুতে রাশিয়া থার্মোবারিক অস্ত্র বা ভ্যাকুয়্যাম বোমা ব্যবহার শুরু করেছে। এছাড়া পারমাণবিক অস্ত্র বের করে রেখেছে। উত্তাল এই সময়ে নির্বিচারে মানবজীবন ধ্বংস করার জন্য তার মতো যুদ্ধবাজদের বহুমুখী সামরিক আক্রমণ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ব্যতিরেকে আর কীসের বার্তা বহন করছে?

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস