ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বিএনপির এই মাথা ব্যথা সারাবে কে?

বিভুরঞ্জন সরকার | প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ০১ মার্চ ২০২২

সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য চার নির্বাচন কমিশনার শপথ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজও শুরু করেছেন। তবে এই কমিশন নিয়ে বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ এই কমিশনের ওপর আস্থা রাখছে। নতুন ইসি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে পারবে বলে সরকার পক্ষ মনে করছে। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তারা অনুসন্ধান কমিটির কাছে যে ১০ জনের নাম জমা দিয়েছেন তার মধ্য থেকে একজনকেও কমিশনে রাখা হয়নি।

আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি অভ্যাস মতোই কমিশন নিয়ে নিরাসক্ত ভাব দেখিয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। তাদের মাথা ব্যথা একটা বিষয় নিয়েই যে নির্বাচনকালীন সরকারে কারা থাকবে’।

নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারেরই ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত শতভাগ। বিএনপির দাবি মতো নির্দলীয় বা অনির্বাচিত সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা এ কারণেই দেখা যাচ্ছে না যে, সংবিধানে তেমন সরকারের বিধান নেই। সংবিধান সংশোধন করে নতুন বিধান করার মতো জোর সংসদে বিএনপির নেই। বিএনপি নেতারা অবশ্য সরকার পতনের কথা বলে আসছেন বহু বছর ধরে। রাজপথের বাস্তবতা তেমন নয়। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপির যে মাথা ব্যথা তা দূর করার দাওয়াই কোনো ডাক্তার বা কবিরাজের কাছ থেকে পাওয়া যাবে, বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দলের কাছে তেমন ওষুধ মজুত আছে বলেও কোনো খবর জানা যায়নি।

বিএনপি দরদি একজন খ্যাতিমান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এতদিন বিএনপির জন্য নানা টোটকা ওষুধ বাতলেছেন, কিন্তু বিএনপি আবার ‘দুস্থ’দের চিকিৎসা নিতে আগ্রহী নয়। ফলে দলটির হয়ে বিনামূল্যে অনেক প্রেসক্রিপশন লিখলেও বিএনপি তা আমলে নেয়নি। নির্বাচন কমিশন প্রশ্নে আবার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী উল্টো অবস্থান নিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

তার প্রস্তাব থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ায় তিনি বেজায় খুশি। নতুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ডা. জাফরুল্লাহ পক্ষ বদল করলেন, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো ‘রহস্য’ আছে তার অনুসন্ধানে কোনো সাংবাদিক নেমেছেন কি না সে খবরও এখনো অজানা।

তবে মন্দ লোকেরা আড়ালে আবডালে বলছেন, আওয়ামী লীগ যেমন ইসিতে সুহৃদ ছোট দল দিয়ে নাম জমা দিয়ে সে নাম পাস করিয়ে সমালোচকদের চোখে বালু ছিটিয়েছে, বিএনপিও সেভাবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পছন্দের ব্যক্তিকে সিইসি বানানোর পেছনে গুটি চালিয়েছে থাকলেও থাকতে পারে! তবে এসবই কষ্টকল্পনার বিষয়।

নির্বাচন কমিশনের কাজ দিয়েই প্রমাণ হবে, তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালনে সক্ষম কি না। এদিকে শপথ নিয়েই নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সবাইকে সরাসরিই জানিয়ে দিয়েছেন, চ্যালেঞ্জ নিতে তিনি ভয় পান না। নির্বাচন কমিশনের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ কোনটি সেটা এখনও নিশ্চয়ই তিনি বা তার সহকর্মীরা চিহ্নিত করেননি। তবে অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করাই নতুন কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। সদ্য বিদায়ী নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে পারেনি।

গত দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল ছাড়াও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেকেই অংশ নেয়নি। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলে একতরফা ওই নির্বাচনকে জাস্টিফাই করা হয়েছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ প্রায় সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগের পক্ষে নেওয়ার জনপ্রশাসন বিশেষ মেকানিজমের আশ্রয় নিয়েছিল বলে অভিযোগ আছে।

ভোট ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভোটারদেরও আস্থার সংকট- কেন্দ্রবিমুখিতা দেখা গেছে। আবার সংবিধানে নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসন ইসির অধীনে থাকার কথা থাকলেও বহু ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। নির্বাচনে পেশিশক্তি ও অর্থের অপব্যবহার হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। এসব প্রতিবন্ধকতার বিষয় বিবেচনায় রেখে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন উপহার দেওয়াই কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন ইসির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের পাশাপাশি ভোটারদেরও আস্থা অর্জন করতে হবে নতুন ইসিকে। তাদের ভোটকেন্দ্রমুখী করা বর্তমান কমিশনের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ভোটের দায়িত্বে থাকা পোলিং-প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে যদি ইসি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত না করতে পারে তা হলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়া কঠিন। এটা নতুন সিইসি তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় নিজেই উল্লেখ করেছেন। তাই এটা বলা যায় যে, নিজের কাজ সম্পর্কে নতুন সিইসির ধারণা আছে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব সবগুলো দলকে নিয়ে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন উপহার দেওয়া। একই সঙ্গে বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতা দেখা গেছে। তারা ইসির ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। সেটা পরিবর্তন করতে হবে সুষ্ঠু ভোট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে।

নতুন ইসির উচিত হবে সব অংশীজন- বিশেষ করে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন ও ভোটারদের নিরাপত্তা বিধান করা। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া সুন্দর করে, একই সঙ্গে সাংবিধানিক ক্ষমতার কঠোর প্রয়োগ করে আগামীতে যেসব নির্বাচন রয়েছে সেগুলো পরিচালনার ব্যবস্থা করা, যাতে সব দল ও ভোটাররা ইসির ওপর আস্থা ফিরে পায়।

একই সঙ্গে যেসব নির্বাচন ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তার ময়নাতদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা ও তা থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করাও এই কমিশনের দায়িত্ব। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় একটা বড় ফ্যাক্টর- এ মন্তব্য করে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনাও এ ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন সাবেক এ কমিশনার।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নতুন ইসির কাছে প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো তারা যে শপথ নিলেন, তার সারমর্ম অনুধাবন করে সেটাকে নিজেদের মধ্যে আত্মীকরণ করা। তারা এতদিন পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, সেখানে দীর্ঘদিন একটা আনুগত্য তারা লালিত করেছেন, সেখান থেকে বের হয়ে একটা মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

মনে রাখতে হবে, তারা এখন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তারা প্রতিদিন যে কাজকর্ম করবেন, তার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে তারা সরকারের কাছ থেকে সরে এসে সংবিধানের প্রতি, জনগণের প্রতি আনুগত্য দেখাতে প্রস্তুত। তাদের সব ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াস নিতে হবে।

একটি ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধু নির্বাচন কমিশনের একক চেষ্টায় সম্ভব হতে পারে না। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই এক্ষেত্রে দায়িত্ব ও ভূমিকা আছে। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচন কমিশন এগোতে পারবে না। নির্বাচনে যেনতেনভাবে জয়লাভের উদগ্র বাসনা অনেক সময় সহিংসতার জন্ম দেয়।

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে একটি সমঝোতার মনোভাব না থাকলে নির্বাচন কমিশন চাইলেও কঠোর অবস্থান নিতে পারবে না। বিএনপিদলীয় স্বার্থকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে, জনস্বার্থ ততটা কি তাদের কাছে গুরুত্ব পায়? খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের জন্য আন্দোলনের কথা বলে, মানুষের জীবনের দৈনন্দিন সমস্যার কথা কি সেভাবে উচ্চারিত হয়? তাদের মাথা ব্যথা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে, জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য, মানুষের কর্মহীনতা, আয়রোজগারের সমস্যা, অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে তাদের মাথা ব্যথার কথা কি বিএনপি নেতাদের মুখে শোনা যায়? মানুষের ব্যথা লাঘবের কথা না বললে তাদের মাথা ব্যথা কমবে কীভাবে?

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম