মেরাজের তাৎপর্য ও শিক্ষা
বিশ্বনবি ও বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, রাহমাতুল্লিল আলামিন, হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য লাভ করে পবিত্র মেরাজের মাধ্যমে। তাই মেরাজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন ‘তিনি পরম পবিত্র ও মহিমায়, যিনি রাত্রিযোগে আপন বান্দাকে মসজিদুল হারাম (সম্মানিত মসজিদ) থেকে মসজিদুল আকসা (দূরবর্তী মসজিদ) পর্যন্ত নিয়ে গেলেন, যার চারদিকে আমি বরকত মণ্ডিত করেছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাই, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১)
এ আয়াতে বিশ্বনবির (সা.) রাত্রিকালীন সফর সম্পর্কে ব্যক্ত হয়েছে, যা অধিকাংশ তফসিরকারকের মতে মেরাজ বলে পরিচিত। মেরাজের যে ঘটনা তা নবুওয়তের পঞ্চম বা ৬ষ্ঠ বছরে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে ঘটেছিল। এই সময় মহানবির যে মেরাজ সংঘঠিত হয়, তাতে তিনি বহু ঊর্ধ্ব-লোকে উপনীত হয়ে আল্লাহর জ্যোতিসমূহের বিকাশ প্রত্যক্ষ করেন। অপরদিকে মহান আল্লাহর জ্যোতিমালাও তার প্রিয় রাসুলের (সা.) দিকে অবতরণ করে। এভাবেই একদিকে আল্লাহর রাসুল (সা.) আল্লাহর দিকে অগ্রসর হন, অপর দিকে আল্লাহও অগ্রসর হন তার প্রিয় রাসুলের (সা.) দিকে। মানুষের পক্ষে যতটা আধ্যাত্মিক-উন্নতি অর্জন করা সম্ভব, তার সবটাই ঘটেছিলো রাসুলের (সা.) মাঝে।
মহান আল্লাহর শক্তি ও মহিমার জ্যোতি যতটা মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব, তার সবটাই দেখেছিলেন আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় এই রাসুল (সা.)। এই মহামানবকে (সা.) যত বেশী করে আঁকড়ে ধরা যাবে, যতবেশী গভীরে যাওয়া যাবে তার শিক্ষার, ততই বেশী করে মুক্তির স্বাদ পাওয়া যাবে, পাপ থেকে ততই বেশী মুক্তি পাওয়া যাবে। পবিত্র কোরআনের সুরা নযমে উল্লিখিত মেরাজের ঘটনার বর্ণনা সম্পর্কে যতই আমরা জ্ঞান অর্জন করব, ততই বুঝা সম্ভব হবে মেরাজের মাহাত্ম্য।
নবুওয়তের একাদশ বা দ্বাদশ বছরে মহানবির (সা.) প্রিয়তম পত্নী হজরত খদিজার (রা.) ইন্তেকালের পর কাবাগৃহের নিকটবর্তী তার চাচাত বোন উম্মে হানির বাসভবনে অবস্থানকালে একরাতে দিব্যদর্শনে তিনি জেরুযালেমে অবস্থিত ‘আল আকসা মসজিদ’ গমন করেন। সেখানেই তিনি পূর্ববর্তী নবীগণের সাক্ষাত লাভ করেন। এটি ইসরা নামে পরিচিত। পূর্ববর্তী জামানায় আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নবীগণ আল আকসা মসজিদে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নবির (সা.) পেছনে নামাজ পড়েন। এরপর তিনি আবার মক্কায় ফিরে আসেন।
সুরা বনি ইসরাঈলে আল্লাহ এ ঘটনার বর্ণনা করেছেন। মেরাজ এবং ইসরা দু’টি ভিন্ন সময়ের ঘটনা। দু’টিই ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ঘটনা অথচ অনেকেই দু’টি ঘটনাকে একত্রে বেঁধে দিয়ে প্রচার করছে। মেরাজের বর্ণনা সম্পর্কে মহানবি (সা.) নিজে বলেছেন, ‘একদা আমি কা’বার ‘হাতিম’ অংশে সটান হয়ে শুয়েছিলাম।...হঠাৎ একজন আগন্তুক আমার কাছে এলেন। তিনি আমার (বুক) এ স্থান থেকে এ স্থান পর্যন্ত বিদীর্ণ করলেন।...এ ঘটনার বর্ণনা প্রসঙ্গে হজরত আনাস (রা.) বলেন, তিনি তার পাশে বসা (জনৈক সাহাবী) জারুদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ স্থান থেকে এ স্থান পর্যন্ত’ এর অর্থ কি? তিনি (তার ব্যাখ্যা দিয়ে) বলেন, হলকুমের নিচ থেকে নাভী পর্যন্ত।
অতঃপর তিনি (আগন্তুক) আমার হৃৎপিণ্ডটি বের করলেন। তারপর ঈমানে পরিপূর্ণ একটা থালা আমার কাছে আনা হল, অতঃপর আমার হৃৎপিণ্ডটাকে ধৌত করা হল। তারপর তাকে ঈমানে পরিপূর্ণ করে আবার পূর্বের জায়গায় রাখা হল। অতঃপর আকারে খচ্চরের চাইতে ছোট ও গাধার চাইতে বড় একটি শুভ্র জানোয়ার (বাহন) আমার সামনে হাজির করা হল। তখন হজরত জারুদ (রা.) হজরত আনাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু হামযা! (আনাসের ডাক নাম) ওটাই কি বুরাক ছিল? হজরত আনাস (রা.) বললেন, হ্যাঁ, তার দৃষ্টি যতদূর যেত, সেখানে সে পা রাখতো। অর্থাৎ তার পথ অতিক্রমের গতিবেগ ছিল দৃষ্টি-শক্তির গতিবেগের সমান। বিশ্বনবি (সা.) বললেন, অতঃপর আমাকে তার ওপর আরোহণ করানো হলো।
তারপর জিবরাঈল আমাকে সঙ্গে নিয়ে (ঊর্ধ্বলোকে) যাত্রা করলেন এবং নিকটতম আসমানে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, এ কে? জিবরাঈল বললেন, আমি জিবরাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সঙ্গে আর কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সা.)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন বলা হলো, তার প্রতি সাদর সম্ভাষণ। তার আগমন কতই না উত্তম। এরপর দরজা খুলে দেয়া হলো। যখন আমি ভেতরে পৌঁছলাম, তখন সেখানে দেখতে পেলাম আদম (আ.)কে। বলা হলো, তাকে সালাম করুন। আমি তাকে সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, নেককার পুত্র ও নেককার নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ।
অতঃপর জিবরাঈল (আ.) আমাকে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বে আরোহণ করতে লাগলেন এবং দ্বিতীয় আসমানে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, ‘এ কে?’ তিনি বললেন, আমি জিবরাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনার সঙ্গে আর কে?’ তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সা.)। পুণরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন বলা হল, তার প্রতি সাদর সম্ভাষণ। তার আগমন বড়ই শুভ। তারপর দরজা খুলে দেয়া হল। যখন আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম তখন সেখানে দেখতে পেলাম ইয়াহইয়া ও ঈসা (আ.)-কে। বলা হলো, আপনি তাদেরকে সালাম করুন। আমি তখন সালাম করলাম। তারা উভয়ে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, নেককার ভাই ও নেককার নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ।
তারপর জিবরাঈল আমাকে নিয়ে তৃতীয় আসমানে উঠলেন এবং দরজা খুলে দিতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, কে? তিনি বললেন: আমি জিবরাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হলোঃ সঙ্গে কে? তিনি বললেনঃ মুহাম্মদ (সা.)। পুনরায় বলা হলো, তাক কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। ভেতরে প্রবেশ করে আমি সেখানে ইউসুফ (আ.)কে দেখতে পেলাম। জিবরাঈল বললেন, ইনি হলেন ইউসুফ (আ.), তাকে সালাম করুন। আমি তাকে সালাম করলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, নেককার ভাই ও নেককার নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ।
তারপর জিবরাঈল আমাকে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বলোকে যাত্রা করলেন এবং চতুর্থ আসমানে এসে দরজা খুলতে বললেন। প্রশ্ন করা হলো আপনি কে? জবাব দেয়া হলো, আমি জিবরাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সঙ্গে আর কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সা.)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। বলা হলো, তার প্রতি সাদর অভিনন্দন। তার আগমন বড়ই শুভ। অতঃপর দরজা খুলে দেয়া হল। আমি ভেতরে ইদরিস (আ.)-এর নিকট গিয়ে পৌঁছলাম। জিবরাঈল আমাকে বললেন, ইনি ইদরীস (আ.)। তাকে সালাম করুন। আমি তাকে সালাম করলে তিনি তার উত্তর দিলেন। তারপর বললেন, নেককার ভাই ও নেককার নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ।
তারপর জিবরাঈল আমাকে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বলোকে যাত্রা করলেন এবং পঞ্চম আসমানে এসে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সা.)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। বলা হলো, তার প্রতি সাদর অভিনন্দন। তার আগমন খুবই শুভ। তারপর (দরজা খুলে দিলে) আমি ভেতরে পৌঁছলাম। তখন সেখানে হারুন (আ.)-কে দেখতে পেলাম। জিবরাঈল (আ.) বললেন, ইনি হারুন (আ.), তাকে সালাম করুন। আমি তাকে সালাম করলে তিনি তার জবাব দিলেন। তারপর বললেন, নেককার ভাই ও নেককার নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ।
তারপর জিবরাঈল আমাকে সঙ্গে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বলোকে উঠতে শুরু করলেন এবং ষষ্ঠ আসমানে এসে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, কে? তিনি বললেন, আমি জিবরাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সঙ্গে আর কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সা.)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। বলা হল, তার প্রতি সাদর সম্ভাষণ। তার আগমন কতই না উত্তম। তারপর দরজা খুলে দিলে আমি যখন ভেতরে প্রবেশ করলাম, তখন সেখানে মূসা (আ.)-কে দেখতে পেলাম। জিবরাঈল (আ.) বললেন, ইনি হলেন মূসা (আ.), তাকে সালাম করুন। আমি তাকে সালাম করলাম। আমি তাকে সালাম করলে তিনি তার জবাব দিলেন এবং বললেন, নেককার ভাই ও নেককার নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ।
অতঃপর আমি যখন তাকে অতিক্রম করে অগ্রসর হলাম তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন, আমি এজন্য কাঁদছি যে, আমার পরে এমন একজন যুবককে (নবী বানিয়ে) পাঠানো হল, যার উম্মত আমার উম্মতের চাইতে অধিক সংখ্যায় জান্নাতে প্রবেশ করবে।
তারপর জিবরাঈল (আ.) আমাকে নিয়ে সপ্তম আসমানে আরোহণ করলেন। অতঃপর জিবরাঈল দরজা খুলতে বললে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সঙ্গে আর কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সা.)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। দরজা খুলে দিয়ে দ্বাররক্ষী বললেন, তার প্রতি সাদর সম্ভাষণ। তার আগমন কতই না আনন্দদায়ক। তারপর আমি যখন ভেতরে প্রবেশ করলাম, তখন সেখানে ইব্রাহীম (আ.)কে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, ইনি আপনার পিতা ইব্রাহিম (আ.), তাকে সালাম করুন। আমি তাকে সালাম করলে তিনি তার উত্তর দিলেন এবং বললেন, নেককার পুত্র ও নেককার নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ।
তারপর আমাকে সিদরাতুল-মুন্তাহা পর্যন্ত ওঠানো হল। জিবরাঈল বললেন, এটাই সিদরাতুল-মুনতাহা। আমি আরো দেখতে পেলাম চারটি নহর। দু’টো নহর অপ্রকাশ্য আর দুটো প্রকাশ্য। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাঈল! এ নহরের তাৎপর্য কি? তিনি বললেন, অপ্রকাশ্য নহর দুটো হল জান্নাতে প্রবাহিত দু’টি ঝর্ণাধারা, আর প্রকাশ্য দু’টো হল মিসরের নীল নদ ও বাগদাদের ফুরাত (ইউফ্রেটিস) নদী। তারপর আল বায়তুল মা’মুর ঘরটি আমার সামনে পেশ করা হল। অতঃপর আমার সামনে হাজির করা হল এক পাত্র মদ, এক পাত্র দুধ ও এক পাত্র মধু। এর মধ্য থেকে আমি দুধ গ্রহণ করলাম এবং তা পান করলাম। তখন জিবরাঈল (আ.) বললেন, আপনি এবং আপনার উম্মত যে ইসলাম রূপী স্বভাবজাত ধর্মের অনুসারী, এটা তারই নিদর্শন।
তারপর আমার ওপর দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হল এবং আমি ফিরে চললাম। হজরত মুসা (আ.)-এর সম্মুখে দিয়ে যাবার সময় তিনি আমাকে বললেন, কি করতে আদেশ করা হয়েছে? আমি বললাম, দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ করা হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ সম্পাদনে সক্ষম হবে না। আল্লাহর কসম, আপনার পূর্বে আমি (ইসরাঈল) লোকদেরকে পরীক্ষা করে দেখেছি এবং বনী ইসরাঈলের হেদায়াতের জন্য যথাসাধ্য পরিশ্রম করেছি। অতএব, সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই আপনাকে বলছি, আপনি আপনার রবের কাছে ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের পক্ষে নামাজ আরো হ্রাস করার জন্য আবেদন করুন। তখন আমি ফিরে গেলাম এবং ঐভাবে প্রার্থনা জানালে আল্লাহ আমার ওপর থেকে দশ ওয়াক্ত নামাজ কমিয়ে দিলেন। তারপর আমি মুসার নিকট ফিরে গেলাম।
তিনি এবারও অনুরূপ কথা বললেন। ফলে, আমি পুনরায় আল্লাহর কাছে ফিরে গেলাম। তিনি আমার ওপর থেকে আরো দশ ওয়াক্ত নামাজ কমিয়ে দিলেন। আবার আমি মুসার কাছে ফিরে এলে তিনি অনুরূপ কথাই বললেন। তাই আমি আবার ফিরে গেলাম। তখন আল্লাহ আরো দশ ওয়াক্ত নামাজ মাফ করে দিলেন। তারপর আমি মুসার কাছে ফিরে এলে আবারও তিনি ঐ কথাই বললেন। আমি আবার ফিরে গেলে আল্লাহ আমার জন্যে আরো দশ ওয়াক্ত কম করে দিলেন এবং আমাকে প্রত্যহ দশ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের আদেশ করা হল। আমি মুসার কাছে ফিরে এলাম। এবারও তিনি অনুরূপ কথাই বললেন। ফলে, আমি পুনরায় ফিরে গেলে আমাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ করা হল।। আমি মুসার কাছে আবার ফিরে এলাম।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে সর্বশেষ কি করতে আদেশ করা হল? আমি বললাম, আমাকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ করা হয়েছে। আপনার উম্মত প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সমাপনে সক্ষম হবে না। আপনার পূর্বে আমি (ইসরাইল) লোকদেরকে বিশেষভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি এবং তাদের হেদায়াতের জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা ও কষ্ট স্বীকার করেছি। তাই আমি বলছি, আপনি আপনার রবের নিকট ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের জন্যে নামাজ হ্রাস করার প্রার্থনা জানান। নবী (সা.) বললেন, আমি আমার রবের কাছে (কর্তব্য হ্রাসের জন্য) এত অধিক বার প্রার্থনা জানিয়েছি যে, (পুনরায় প্রার্থনা জানাতে) আমি লজ্জাবোধ করছি। বরঞ্চ আমি এতটুকুতেই সন্তুষ্ট ও আনুগত্য প্রকাশ করছি। নবী (সা.) বলেন, আমি যখন মুসাকে অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হলাম, তখন জনৈক আহ্বানকারী আমাকে আহ্বান জানিয়ে বললেন, আমার অবশ্য-পালনীয় আদেশটি আমি জারি করে দিলাম এবং আমার বান্দাদের জন্য আদেশটি লঘু করে দিলাম।” (সহিহ বোখারি, কিতাবুল মানকিব, ৩য় খণ্ড)
সাধারণভাবে বলা হয়, মেরাজের ৩টি অংশ। প্রথম অংশ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা গমন। দ্বিতীয় অংশ বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে আসমানে ভ্রমণ এবং তৃতীয় অংশ আসমান থেকে মসজিদে হারামে প্রত্যাবর্তন। হাদিসে আছে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর যখন মেরাজ হয়, তখন তিনি মসজিদে হারামের হাতিমে শুয়ে ছিলেন। অন্য হাদিসে আছে, তিনি তার চাচত বোন উম্মে হানির ঘরে শুয়ে ছিলেন।
কিন্তু হাদিস ও কোরআন থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মেরাজ ও ইসরা পৃথক প্রথক সময়ে হয়েছিল। মেরাজের ঘটনা সুরা নজমে আছে, যা নবুওয়তের ৫ম সালে হয়েছিল। আর ইসরার ঘটনা কোরআনের সুরা বনি ইসরাঈলে আছে, যা হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাক্কি জীবনের শেষ-বর্ষে অর্থাৎ নবুওয়তের ১১/১২ সালে হয়েছিল। হাদিসে এর সমর্থন পাওয়া যায়। সুরা নজমে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বায়তুল মুকাদ্দাস যাওয়ার বর্ণনা নেই। আকাশে যাওয়ার কথা আছে। সুরা বনি ইসরাঈলে আকাশে যাওয়ার কথা নেই। কিন্তু বায়তুল মাকাদ্দাসে যাওয়ার কথা আছে।
হাদিস থেকে জানা যায়, মেরাজে নামাজ ফরজ হওয়ার কথা আছে। আবার হাদিসে আছে নবুয়তের শুরু থেকে নামাজ ফরজ হয়নি। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মেরাজ হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে কমপক্ষে দুবার হয়েছে। সুরা নজমে আছে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এটি দুবার দেখেছেন। মেরাজ রাসুলুল্লাহ (সা.) নবুওয়ত প্রাপ্তির প্রথম দিকে হয়েছিল। ইসরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা। এটি মহানবির মক্কী জীবনের শেষ বর্ষে ঘটেছে, যখন বিবি খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন এবং তিনি (সা.) উম্মে হানীর গৃহে অবস্থান করছিলেন। মেরাজ ও ইসরা আধ্যাত্মিক একটি বিষয়। কারণ পবিত্র কোরআনের সুরা নজমে আছে যে, তার হৃদয় এই দৃশ্য দেখেছিলো।
হাদিসে আছে, যখন তিনি এই দৃশ্য দেখেছিলেন, তখন তার (সা.) চোখ বোঁজা অবস্থায় ছিলো। এর থেকে প্রমাণিত হয়, তিনি আধ্যাত্মিকভাবে এ দৃশ্য দেখেছিলেন। হাদিসে আরও প্রমাণ আছে যে, আল্লাহ এই স্বপ্ন হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে দেখিয়েছিলেন। হাদিসে আছে তিনি (সা.) নবীদের জামাতে ইমামতি করেছিলেন। আরো অনেক ঘটনা আছে, যা ব্যাখ্যা করতে হয়। এসব ঘটনা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তা হল, মেরাজ ও ইসরার বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক।
ইসলামে মিরাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আর যেহেতু এটি সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক-বিষয়, তাই এটি লাভ করা কেবল তার পক্ষেই সম্ভব যার রূহ পবিত্র এবং যিনি পরম আধ্যাত্মিকতা সম্পন্ন। মহানবির (সা.) রূহকে স্বয়ং আল্লাহপাক পবিত্র করেছিলেন, যার ফলে আল্লাহতায়ালা এই মহান নবীকে মেরাজের অর্থাৎ আধ্যাত্মিক স্বর্গারোহণে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিশ্বনবির (সা.) জীবনে মিরাজ শুধু একবারই যে ঘটেছে তা কিন্তু নয়, কারণ ছিনাচাকের যে ঘটনা, তা তার শৈশবেই ঘটেছিল, যখন তিনি (সা.) ছাগল চড়াচ্ছিলেন। তবে কোরআন করিমে তার (সা.) যে আধ্যাত্মিক সফরের কথা উল্লেখ রয়েছে, তা একটি বিশেষ রাতে সংঘটিত হয়েছিল।
এই রাতে মহানবির (সা.) কাছে জিবরাইল ও মিকাইল (আ.) যখন আসে, তখন তিনি (সা.) ঘুমন্ত ও জাগ্রত অবস্থার মাঝামাঝি ছিলেন। তখন জিবরাইল (আ.) মহানবির (সা.) সীনা থেকে নাভীর ওপর পর্যন্ত ফেড়ে এবং তার বুক ও পেট থেকে কিছু বের করে সেসবকে যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে তার পেটকে পাক পবিত্র করে দেন। তারপর তিনি সোনার একটি তশুরী আনেন, যা ঈমান ও হিকমতে পরিপূর্ণ ছিল। এর মাধ্যমে তিনি তার সীনাটাকে ভরে দেন এবং ফাড়া অংশটা ঠিকঠাক করে দেন (বোখারি, মুসলিম ও মিশকাত)। এই বিশেষ রাতে আল্লাহপাকের ইচ্ছায় মহানবির (সা.) রূহকে পাকসাফ এবং সতেজ করা হয়েছিল।
আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে মেরাজের প্রকৃত শিক্ষার ওপর আমল করার এবং এর তাৎপর্য বুঝার তাওফিক দান করুন, আমিন।
এইচআর/এএসএম