হয় বিলুপ্তি না হয় নির্বাচন: বিএনপি’র সামনে দুই অপশন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনা মানেই বড় দুই দলের ইস্যু। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনে সেভাবে আলোচনায় আসার যোগ্যতা আর কোনো রাজনৈতিক দল এখনও অর্জন করতে পারেনি। শুনতে তিতা মনে হলেও এটাই বাস্তবতা এবং এই বাস্তবতা ব্যর্থতারও বটে। এই আলোচনায় আসতে পারতো বাম দলগুলোও। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধের লড়াইয়ের আড়ালে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব তাদের মাঠে দাঁড়াতে দেয়নি।
সামনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচন মানেই উত্তাল অবস্থা। পক্ষে বিপক্ষের আলোচনা। কে নির্বাচনে আসবে আর কে আসবে না এ নিয়ে তোলপাড় থাকে রাজনৈতিক অঙ্গন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই লক্ষে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন আইনের আওতায় একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন রাষ্ট্রপতি। সেই কমিটির সুপারিশক্রমে ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ মোট পাঁচজন ইসি সিলেক্ট করেছেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যিনি নির্বাচিত হয়েছেন জানা গেছে তার নাম সুপারিশ করেছিলেন বিএনপি’র রাজনৈতিক পরামর্শক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। যে পাঁচজন নির্বাচিত হয়েছেন তাদের কারও বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আসেনি যদিও এই সময়ে এই মন্তব্য করাটা খুব বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।
বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি দেশের সাধারণ জনগণের একটি বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্ব করে যদিও বিগত কয়েকটি নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। তাই ভোটের মাঠে তাদের সমর্থন কত অংশ এই অংকটা পরিষ্কার বোঝা যায় না। নতুন নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে বিএনপি মন্তব্য করতে নারাজ। তাদের দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পরিষ্কারভাবেই বলেছেন দলীয় সরকারের অধীনে তারা মনে করে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হতে পারে না। তাই ইসি কে হলো এ নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই।
বাস্তবে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক বা তৃতীয় কোনো পক্ষের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই সত্যটা বিএনপি ভালো করেই জানে। দেশে এই মুহূর্তে এমন কোনো অস্থিরতা বা জরুরি অবস্থা তৈরি হয়নি যেখানে সাধারণ মানুষ বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা হারিয়েছে।
বিএনপি কি আসলেই জানে তাদের রাজনীতি কোথায় আছে এই মুহূর্তে? আদৌ কী কোনো অস্তিত্ব আছে তাদের দলের? সংবাদ মাধ্যমেই এসেছে তাদের উচ্চ পর্যায়ের কমিটিগুলোর সভা হয় না আজ অনেক বছর। তাদের দলীয়প্রধান খালেদা জিয়া বর্তমানে অসুস্থ। এর আগে তিনি প্রমাণিত অপরাধের দায়ে কারাগারে ছিলেন।
খালেদা জিয়ার অবর্তমানে দলের হাই কমান্ডের দায়িত্ব নিয়েছিল সাজাপ্রাপ্ত আসামি তারেক রহমান। তারেক রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পর মূলত দল হিসেবে বিএনপির কাফনের কাপড় বুননের কাজটি শুরু হয়েছিল। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করে একক সিদ্ধান্তে দল চালাতে থাকলেন তারেক। এমনকি দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় উপেক্ষা করতে থাকলো।
একটা রাজনৈতিক দলের মেরুদণ্ড থাকে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। একে একে তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকলো নেতারা। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, অনেকবার হুমকি ধমকি দিয়েও খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুতে সরকারবিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে না পারা। কদিন পরপরই মির্জা সাহেব হুঙ্কার দেন এই করবেন সেই করবেন কিন্তু দিন শেষে কিছুই করতে পারেন না।
প্রায় ১৩ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যদি রাজনীতিমুখী হতো তাহলে তাদের উচিত ছিল এই সময়ে দল গঠনে মনোযোগী হওয়া। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কতটা শক্তিশালী তারও একটা জরিপ রাখা দরকার ছিল। এর মধ্যে সাধারণ মানুষের স্বার্থকেন্দ্রিক অনেকগুলো ইস্যু থাকা সত্ত্বেও তারা কোনোটাই সরকারের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারেনি। এই ব্যর্থতা নিশ্চয়ই সরকারের নয়। তাহলে প্রশ্ন করতে চাই, বিএনপি আসলে চাইছে কী? নির্বাচনে অংশ নেবে না করেও বর্তমান সংসদে তাদের কয়েকজন প্রতিনিধি বর্তমান। অবৈধ সরকার বলছে অথচ সংসদে বসে আলোচনা করছে।
২০১৪ সালে বিএনপি জামায়াতের দায় ও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে সারাদেশে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল এই স্মৃতি আমাদের কাছে এখনও মুছে দিতে পারেনি তারা। বিএনপি’র সুবুদ্ধি কবে হবে জানি না। জামায়াত তাদের খেয়ে দিয়ে ছাবড়া করে দিয়েছে এটা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
২০১৩ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অবিস্মরণীয় মাইলফলক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলন মূলত বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা ফাইনলাইন টেনে দিয়েছিল। সাধারণ মানুষ সেদিন পরিষ্কার বার্তা দিয়েছিল যে এই বাংলাদেশে যদি রাজনীতি করতে হয় তাহলে ১৯৭১ সালকে ভিত্তি করেই টিকে থাকতে হবে। যারাই এর সাথে বেঈমানী করবে তারাই পরগাছা হিসাবে উপড়ে যাবে। আমার জানা নেই বিএনপি এই শিক্ষাটা গ্রহণ করেছে কি না।
তবে হিসাব বলে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে। মির্জা ফখরুল দু-এক সময়ে স্বীকার করেছেন যে নির্বাচনে অংশ না নেয়া তাদের ভুল ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা মানেই ভোটের নির্বাচন। নির্বাচনের বাইরে লোকে আপনাকে চিনবে না, আপনিও কাউকে চিনবেন না। প্রশাসনও আপনাকে গোনায় ধরবে না। তাই আগামী দিনে যদি রাজনীতি করতে চায় তাহলে বিএনপি’র কাছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাড়া কোনো রাস্তা খোলা নেই। বিলুপ্ত করে দিতে চাইলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম