ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি’ এবং বাস্তবতা

ড. মিল্টন বিশ্বাস | প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

চলতি মাসে (ফেব্রুয়ারি) সংবাদপত্রে ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ তথা টিসিবির ট্রাকে লম্বা লাইন’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে ১৪ ফেব্রুয়ারি (২০২২) কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কৃষিমন্ত্রী প্রেস ব্রিফিং করে জানিয়েছেন খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত সার, সেচ, বীজ, বালাইনাশকসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণের জন্য ভর্তুকি প্রদানের বাস্তব অবস্থা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়তে থাকায় কম দামে পণ্য পেতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ টিসিবির ন্যায্যমূল্যের চার ধরনের ভোগ্যপণ্যের জন্য লাইনে দাঁড়াচ্ছে৷

টিসিবির ট্রাকে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা, মসুর ডাল প্রতি কেজি ৬৫ টাকা, চিনি ৫৫ টাকা, পেঁয়াজ ৩০ টাকা। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, এ পণ্যগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য যথাক্রমে ১৬৮ টাকা, ১০০ টাকা, ৮০ টাকা এবং ৩৮ টাকা। উল্লেখ্য, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সারাদেশে ৪৫০টি পয়েন্টে এখন ট্রাকে টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে।

এর মধ্যে ঢাকা শহরসহ ঢাকা বিভাগে ১০১টি পয়েন্টে পণ্য বিক্রি হয়। শুক্রবার বাদে সপ্তাহে প্রতিদিন প্রতিটি ট্রাকে দিনে ৬০০ লিটার সয়াবিন তেল, ৪০০ কেজি ডাল, ৫০০ কেজি চিনি এবং ৫০০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়। একজন ক্রেতা সয়াবিন তেল দুই লিটার, চিনি ও মসুর ডাল দুই কেজি এবং পেঁয়াজ সর্বনিম্ন দুই কেজি থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি কিনতে পারেন। জানা গেছে, ২২ ফেব্রুয়ারি ট্রাকে পণ্য বিক্রির কর্মসূচি শেষ হলেও মার্চ থেকে আবারো শুরু হবে। রমজান মাসেও চলবে। এবার পণ্য এবং বিক্রির আওতা দুটোই আরও বাড়ানো হবে৷ যারা ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা পেয়েছেন তাদের তালিকা করে তারা যাতে টিসিবির ন্যায্যমূল্যের পণ্য পান তা নিশ্চিত করা হবে৷

গত মাসে প্রকাশিত এক সংবাদ সূত্র অনুযায়ী, জার্মানিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে ভোক্তাদের৷ ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধি এটি। ফলে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে। বৈশ্বিক এই বাস্তবতার কথা বাণিজ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে গত বছর শেষ দিকে শোনা গিয়েছিল।

২০২১ সালের অক্টোবরে দেশে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেছিলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা প্রতিনিয়ত মিটিং করে যাচ্ছি। যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে বলে কথা বলা হচ্ছে, যেমন-তেল, চিনি... প্রত্যেকটা পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেড়েছে। তাই আমাদের দেশে এর প্রভাব পড়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গরিব কিংবা স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য টিসিবির মাধ্যমে কম দামে পণ্য বিক্রির চেষ্টা করছি।’

প্রকৃতপক্ষে কেবল টিসিবি’র মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় নয়, বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত সারের দাম কমিয়ে দেন। ওই সময় সেচকাজে ডিজেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া হয়। এতে দ্রুত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং মাত্র পাঁচ বছরে দেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশ আবার আগের খাদ্য ঘাটতি এবং খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক ধারায় ফিরে যায়।

পরে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কৃষি ও কৃষকবান্ধব নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন শুরু করে। সার, সেচ, বীজ, বালাইনাশকসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ উৎপাদন, আমদানি, বিতরণসহ সার্বিক ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে। কৃষি উপকরণের দাম যেমন কমিয়েছে তেমনি সহজলভ্য করে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে।

গত ১৩ বছরে সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের কোনো সংকট হয়নি। ফলে কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট দানাদার শস্যের উৎপাদন হয়েছে ৪৪৫.০৫ লাখ মেট্রিক টন। চাল ৩৭৬.০৮ লাখ মেট্রিক টন। গম ১২.৩৪ লাখ মেট্রিক টন। এছাড়া আলু ১০৬.১৩ লাখ মেট্রিক টন, ডালজাতীয় ফসল ৯.৩৯ লাখ মেট্রিক টন, পেঁয়াজ ৩৩.৬২ লাখ মেট্রিক টন এবং পাট ৭৭.২৫ লাখ বেল উৎপাদিত হয়েছে। এসব সাফল্যের পেছনে সারের দাম কমানো ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বিরাট ভূমিকা রেখেছে।

দেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বৈশ্বিক বাস্তবতায় দ্রব্যমূল্য কিছুটা বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণও আছে। বিশেষত কোভিড পরিস্থিতির প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সারের মূল্য অস্বাভাবিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় প্রায় তিনগুণ। তাছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় জাহাজ ভাড়াও প্রায় দুইগুণ পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। তবে আওয়ামী লীগ সরকার সারের উৎপাদন ও আমদানি অব্যাহত রেখেছে।

গত ১৩ বছরে সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের কোনো সংকট হয়নি। চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্য বিগত বছরের চেয়ে প্রায় তিনগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেলেও বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার অভ্যন্তরীণ বাজারে অর্থাৎ কৃষক পর্যায়ে সারের মূল্যবৃদ্ধি করেনি। অব্যাহতভাবে ভর্তুকি দিয়ে সুলভমূল্যে সার সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের ধারা বজায় রেখেছে।

ফলে খাদ্যদ্রব্য সহজপ্রাপ্য হয়ে উঠেছে। মনে রাখতে হবে উন্নয়নের মহাসড়কে আসীন বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। বর্তমানে ৯৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধাভোগ করছে। ১১ কোটি মানুষ ইন্টারনেট সংযোগের মধ্যে আছে। টেলিফোন সুবিধা আরও বেশি। ২০২৬ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি মিলবে। এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের অবস্থান অনেক উঁচুতে।

মূলত কৃষিপ্রধান দেশের কৃষক স্বল্পমূল্যে সার ক্রয় করতে সক্ষম হওয়ায় উৎপাদন খরচ যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। এজন্য খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নাগালের মধ্যে আছে। তাছাড়া টিসিবি’র ট্রাক সেল চলমান থাকবে। মনে রাখতে হবে, কৃষিখাতে বিশাল অংকের ভর্তুকি প্রদানে চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরে লাগবে ২৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভর্তুকিতে লেগেছিল ০৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ভর্তুকি খাতে বাজেট মাত্র ০৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আরও প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন। এতো বিশাল অংকের ভর্তুকি কোথা থেকে আসবে এ বিষয়ে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।

অবশ্য এই ভর্তুকি দিলে অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে, অন্যদিকে সারের দাম বাড়ালে কৃষকের কষ্ট বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদন খরচ বাড়বে, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং খাদ্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। অবশ্য বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত সার, সেচসহ কৃষি উপকরণে মোট ৮৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করেছে। বিএনপি’র শাসন আমলে (২০০৫-০৬ অর্থ বছরে) প্রায় ৩২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন সার ব্যবহার হয় এবং ওই সময়ে এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা।

বিএনপির শাসন আমলে সারসহ কৃষি উপকরণের চরম সংকট ছিল। সারের জন্য কৃষকদের জীবন দিতে হয়। সারের জন্য বিএনপি সরকার ১৯৯৫ সালে ১৮ জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করে। গত ১৩ বছরে এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় বর্তমানে প্রায় ২৭ (সাতাশ) গুণ বেশি ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কৃষকরা সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন