ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নির্বাচন কমিশন গঠন ও বিএনপির লাভ-ক্ষতি

ড. প্রণব কুমার পান্ডে | প্রকাশিত: ০৯:৪৯ এএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নির্বাচন কমিশন গঠন। সরকার নির্বাচন কমিশন আইন সংসদে পাস করার পরে আইনের বিধান অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন।

এই কমিটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ১০ জনের নামের তালিকা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করবে। যার মধ্যে থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করবেন।

যেহেতু ২০২৩ সালে বাংলাদেশে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, সেই প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করলে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এ বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেনি। এমনকি সার্চ কমিটির আমন্ত্রণে তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীদের তালিকা জমা দেয়নি। তারা বলার চেষ্টা করেছে যে এই নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্যই কাজ করবে বিধায় তারা নিজেদের সব প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ থেকে থেকে বিরত থেকেছে।

এখন স্বভাবতই যে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় বিএনপির অংশগ্রহণ না করা আগামী দিনের রাজনীতিতে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে কি? অথবা এই নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া থেকে বিএনপি নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখে কোনো রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পারবে কি?

আমরা সবাই জানি যে, রাজনীতিতে যে কোনো একটি ভুল কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ঠেলে দিতে পারে। তাছাড়া আরেকটি বিষয়ে সবার মনে রাখা উচিত যে, রাজনৈতিক দল যদি বহুদিন ক্ষমতার বাইরে থাকে তবে সেই দল সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হতে শুরু করে।

বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল যার জন্ম হয়েছিল সেনাবাহিনীর হাত ধরে এবং বিভিন্ন দল থেকে আসা হাইব্রিড নেতাদের মাধ্যমে দল পরিচালিত হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করলে দেখা যাবে যে বিএনপিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা নেতৃত্ব দিয়েছেস বিধায় দলের প্রতি তাদের আনুগত্য খুব শক্তিশালী নয়।

তাছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার ফলে এই দলটি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে গেছে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে রাজনৈতিক পরিবেশে বিএনপি নিজেদের একেবারেই হাস্যকর করে তুলেছে। একই সাথে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এবং বিভিন্ন স্থান থেকে দলকে পরিচালনা করার বিষয়টি দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছে। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধ ও জামায়াতসহ অন্যান্য ইস্যুতে বিএনপি সুস্পষ্ট অবস্থান না থাকার কারণে দলের একটি অংশ দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

গত ৮ বছরে এই দলটি সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এমনকি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব অর্থাৎ দলের চেয়ারম্যানের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে মানুষকে মাঠে নামাতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করে তারা ২০১৩ সালের মতো আবার বড় একটি রাজনৈতিক ভুল করেছে বলে বেশিরভাগ বিশ্লেষক মনে করেন।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে সার্চ কমিটি যাদের নাম মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করবেন তারা কোনো না কোনোভাবে বর্তমান সরকার অথবা আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হবে। কিন্তু আমরা এটাও দেখেছি যে বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রায় ৩৬২ জনের নামের তালিকা সার্চ কমিটির কাছে জমা পড়েছে। সার্চ কমিটির পূর্ণ অধিকার রয়েছে এই নামের বাইরেও অন্যান্য ব্যক্তির নাম বিবেচনায় নেওয়ার।

সার্চ কমিটি এই নামের তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে তাদের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। বিএনপি যেহেতু তাদের পছন্দের নামের তালিকা দেয়নি, তাহলে তারা কীভাবে বলবে যে এই নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত? তাদের মধ্যে যদি রাজনৈতিক পরিপক্বতা কিছুটা হলেও থাকতো তাহলে তারা সুনির্দিষ্ট কিছু নামের তালিকা প্রদান করে তা জনসমক্ষে উপস্থাপন করতে পারতো।

পরবর্তীতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়া নামের তালিকায় যদি তাদের তালিকা থেকে কোনো নাম বিবেচনায় না নেওয়া হতো তাহলে তারা বলতে পারতেন যে এই সার্চ কমিটি শুধু আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নাম মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করেছেন। যেহেতু তারা কোনো নামের তালিকা দেয়নি তারা আরেকটি ভুল করেছে বলে সবাই মনে করে।

সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সবাই যে প্রশ্নটি বিএনপির কাছে করবে সেটি হচ্ছে যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় তারা অংশগ্রহণ করেনি অতএব এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো অধিকার তাদের নেই। এটি ঠিক যে তারা সংবাদ মাধ্যমে কিংবা জনসমক্ষে তাদের যুক্তি উপস্থাপন করতে পারে। কিন্তু সেই যুক্তি উপস্থাপন করে তারা বিশেষ ভাবে লাভবান হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কারণ নির্বাচন কমিশন আইন প্রণীত হওয়ার পরে এই প্রক্রিয়াটি একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় রূপ নিয়েছে। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ব্যত্যয় ঘটানোর ক্ষমতা কারও নেই।

সার্চ কমিটি যদি সুনির্দিষ্টভাবে যোগ্য ব্যক্তিদের নামের তালিকা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করেন এবং রাষ্ট্রপতি তাদের মধ্যে থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ প্রদান করেন তবে সেই নিয়োগকে সমালোচনা করে কোনো লাভ নেই।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে যাদের নিয়েই কমিশন গঠন করা হোক না কেন বিএনপি তাদের সরকারের লোক হিসেবে চিহ্নিত কোর চেষ্টা করবে। তবে তারা এই প্রক্রিয়ায় কতটুকু সফল হবে সেটি সময়ই বলে দেবে। কারণ কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করে নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য প্রদানের মাধ্যমে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের কাছে তাদের ভাবমূর্তি নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হবে। ফলে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করে বিএনপি রাজনৈতিক ভাবে একটি বড় ভুল করেছে।

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি হচ্ছে সেটি হলো নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই যদি কোনো রাজনৈতিক দল সেই প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার না করে সে প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করতে চায় তাহলে জনগণ সেই বিষয়টিকে খুব একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করবে না।

এছাড়া নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পরে তারা যদি নিরপেক্ষতার সাথে আগামী দিনের নির্বাচনগুলো পরিচালনা করতে পারেন তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা জাতির কাছে বাড়বে। ফলে ২০২৩ সালের নির্বাচনকে বিতর্কিত করার অভিপ্রায়ে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করায় জাতির কাছে বিএনপির নেতিবাচক ভাবমূর্তি উপস্থাপিত হয়েছে।

আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদানের অন্যতম শর্ত হচ্ছে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। কারণ নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তন হয় এবং এই নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনার দায়িত্ব থাকে নির্বাচন কমিশনের ওপর।

বিএনপি যতই ভুল করুক না কেন আমাদের প্রত্যাশা থাকবে সার্চ কমিটি যোগ্য মানুষদের তালিকা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করবেন। এবং সেই তালিকা অনুযায়ী যোগ্য এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদান করবেন। এই নির্বাচন কমিশন আগামী দিনে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতির কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করবেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী এবং প্রাতিষ্ঠানিক রুপ ধারণ করবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা একটি সাধারণ বিষয়। তবে নিজেদের আত্মসমালোচনা না করে সরকারের সব বিষয়কে সমালোচনা করা কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের দর্শন হতে পারে না।

রাজনৈতিক দল সরকারের খারাপ কাজের বিরোধিতা করবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করে বাইরে থেকে সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে সমালোচনা করার নৈতিক অধিকার কোনো রাজনৈতিক দলের নেই।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে পুনরায় একটি বড় ধরনের ভুল করেছে। ফলে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের দূরে রেখে তারা কোনো রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে তো পারবেই না বরং তাদের পরিণতি আরও খারাপের দিকেই যাবে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন