কাজী আরেফ: যে আদর্শের মৃত্যু নেই
জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইতিহাসকে অনেক চড়াই উতরাই পার হতে হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সময়টিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ।
ষাটের দশকে তার সাংগঠনিক দক্ষতা অসাধারণ মাত্রা পেয়েছিল। আজন্ম এ রাজনীতিক টগবগে যৌবনের দিনগুলোতে ছাত্রলীগ করেছেন। ছাত্র অবস্থায় টিউশনি করে নিজের খরচ চালিয়েছেন। সামান্য উপার্জন থেকে সাংগঠনিক কাজেও ব্যয় করতেন। দেশপ্রেমের ব্রত নিয়ে এমন ত্যাগ এই সময়ে তা প্রায় অচিন্ত্যনীয়।
আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমেদের ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৯ সালের এদিনে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ চলাকালীন সময়ে উগ্রপন্থি সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হন বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ আহমেদ।
কাজী আরেফের মতো নেতা বারবার জন্মায় না। তিনি নেই, রেখে গেছেন তার অসমাপ্ত সংগ্রামী জীবন। তার কাছ থেকে প্রেরণা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দেখানো পথে পথ চলতে হবে আমাদের। কাজী আরেফের প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা।
কাজী আরেফের জন্ম ১৯৪২ সালের ৮ এপ্রিল। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট হাই স্কুল থেকে ১৯৬০ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। স্কুল জীবন থেকেই তাঁর মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনার উন্মেষ ঘটে। ১৯৬০ সাল থেকেই আইয়ুবের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে তিনি যুক্ত হন। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার আগে তিনি পুরনো ঢাকার স্থানীয় তরুণদের নিয়ে সাহসিকতার সাথে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবেলা করেন। এজন্য তিনি তৎকালীন সময়ে পুরনো ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। দেশভাগ হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভাষা আন্দোলন, বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, জাতিগত নিপীড়ন প্রভৃতি ঘটনা তাঁকে প্রতিবাদী রাজনীতিতে টেনে আনে।
মেট্রিকুলেশন পাস করার পর তিনি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। সেখান থেকেই তিনি ভূগোল বিষয়ে বিএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগের এমএসসিতে ভর্তি হন। কিন্তু সরকার বিরোধী আন্দোলনের কারণে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
শুধু রাজনৈতিক কারণে তিনি সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। তিনি ছাত্রলীগ করার জন্যেই নিয়মিত টিউশনি করতেন। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো বাসে চড়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে সংগঠিত করতেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী একজন নিভৃতচারী বলিষ্ঠ সংগঠক।
১৯৬০ সালে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে, সিরাজুল আলম খান ও মরহুম আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিন সদস্যের নিউক্লিয়াস গঠন করেন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন পর পর দুই বার।
এই নিউক্লিয়াস ৬২ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর আস্থাশীল ছাত্রলীগের মাধ্যমে। নিজেকে সব সময় আড়ালে রেখে ছাত্রলীগের সব কর্মকাণ্ডে ও নিউক্লিয়াসকে দেশব্যাপী বিস্তৃত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, জয়বাংলা বাহিনী গঠন, বাংলাদেশের পতাকা নির্ধারণ, মুক্তিযুদ্ধের আগে যে সমস্ত শ্লোগান জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে তা সবই বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনক্রমে নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড হিসেবে গৃহীত হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী। কাজী আরেফ আহমেদ মুজিব বাহিনীর অন্যতম একজন রাজনৈতিক প্রশিক্ষক। স্বাধীনতা-উত্তরকালে ছাত্রলীগের বিভক্তির পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন সময়ে প্রকাশিত দৈনিক গণকণ্ঠের কার্যকরী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। জাসদ গঠিত গণবাহিনীর একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হলে বাংলাদেশের রাজনীতি ৭১-এর পরাজিত শক্তির হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। সেই সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করে ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালিত বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আপসহীনভাবে এগিয়ে যান।
১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে, আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেশে প্রত্যাবর্তন করলে নেত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রেখে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনি বারবার কারাবরণ করেন ও নির্যাতিত হন।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন আন্দোলনে তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়ন ও আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বলার অবকাশ নেই যে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটে জননেত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন একজন নেতা হিসেবে কাজী আরেফ ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণআদালতের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন।
ছাত্ররাজনীতির জীবন থেকে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন ইস্পাতের মতো দৃঢ় ও আপোসহীন, সেই সময়ে কাজী আরেফ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ছিল ‘কাজী আরেফ ভাঙেন তো মচকান না’। তিনি ছিলেন সৎ ও সাধারণ জীবনে বিশ্বাসী একজন নির্লোভ মানুষ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এক অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত, মানবিক বাংলাদেশ গঠনে তিনি ছিলেন অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মনে হয় আমার নিজের কথা। কাজী আরেফের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই আমি ছাত্রলীগের কাউন্সিলে প্রত্যক্ষ ভোটে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম।
এরপর ’৯০-এর গণ আন্দোলনে ও ’৯২-এর গণআদালত সফল করতে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলাম। ২০২২ এ দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গণে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা মোকাবেলা করার জন্য কাজী আরেফের মত সংগঠকের আজ প্রয়োজন ছিলো।
আজ গণতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু, বিকল্প কোন শক্তি জনগণের আস্থায় নাই, ২০১৪-র নির্বাচন এক বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে হয়েছে; যা আদৌ কাম্য ছিলো না। ২০১৮-র নির্বাচন এতটাই ত্রুটিপূর্ণ ছিলো যার কুফল সকলেই ভোগ করছে। ২০২৩ সালের নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় সকলের সেদিকে নজর দেয়া উচিৎ। মানুষের যাপিত জীবনে আজ নানামুখী সংকট। সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে জন্ম নেয়া বাংলাদেশকে পুর্ণ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় আজ আমাদের বিব্রত করছে, আইনের শাসনের ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা কাজ করছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সহ কালো আইনের খড়গে বাক স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে গেছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস লাগামহীন। সিন্ডিকেটের কবলে দ্রব্য মূল্য। রোহিঙ্গা সংকট, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশের বিরাজিত অবস্থাকে বিপদ্গ্রস্থ করতে পারে। এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কাজী আরেফের প্রয়োজন ছিলো।
এমনি এক পরিস্থিতিতে সকল উদার- গণতান্ত্রিক, মানুষ ও দলসমূহকে এক মঞ্চে এনে প্রকৃত ভাবে দেশকে মুক্তযুদ্ধের মূল্যবোধের উপর দাঁড় করানোর সংগ্রাম রচনা দরকার। বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ মুখী, জনগণের পুর্ণ মৌলিক অধিকার সম্পন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কাজী আরেফের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হোক। কাজী আরেফের খুনিদের অনেকেই অধরা। বিচারের রায় কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। অবিলম্বে এই বিচারের রায় কার্যকর করা হোক।
সাবেক সংসদ সদস্য রওশন জাহান সাথীর (কাজী আরেফের স্ত্রী) উদ্যোগে নিউক্লিয়াসের এক সময়ের তিন তরুণ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খানের নামে “বাঙালির জাতি রাষ্ট্র” ২০১৪ সালে একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি সম্পাদনা করেন স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) আহসান উল্লাহ। এতে কাজী আরেফ আহমেদ লিখে গেছেন,‘মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ‘জয়বাংলা’ ছিলো আমাদের অনুপ্রেরণা ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।
‘আমাদের লক্ষ্য ছিলো অসাম্পদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের সমগ্র আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নামে’। কাজী আরেফ আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘আমাদের সময়কালে আমরা এ লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারীদের জাতীয় বীর বা বীরত্ব সূচক সম্মান দিতে কৃপণতা দেখাচ্ছি বটে। কিন্তু সে জন্য আগামী প্রজন্মের চোখে শহীদরা ছোট হবেন না, ছোট হবো আমরা’।
কাজী আরেফকে দেশের শত্রুরা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবে তা ভাবতেও পারিনি। কাজী আরেফ বলতেন, ‘যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন না করা পর্যন্ত আমরা জাতির কাছে দায়বদ্ধ থাকব। তাই অন্য সকল কাজের চেয়ে এ কাজকেই প্রাধান্য দিতে হবে বেশি। তরুণ সমাজ ও নতুন প্রজন্মকে দিয়ে যেতে হবে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন এক বাংলাদেশ। গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও জাতীয় সমৃদ্ধি হবে যার মূল চাবিকাঠি।’
কাজী আরেফদের দেহ নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করলেও আদর্শ বেঁচে থাকবে যুগ যুগ। তাই তিনি সশরীরে না থাকলেও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। কাজী আরেফের দেখা স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই হবে তার প্রতি শ্রেষ্ঠ সম্মান।
লেখক : রাজনীতিক।
এইচআর/এএসএম