ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি: জনদুর্ভোগ দেখবে কে?
আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও মহামারি করোনার কারণে গত দুই বছরে দেশে অন্তত আট দফায় ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। এতে টিসিবির ট্রাকে ভোক্তাদের লাইন আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
তবে অনেকেই বলছেন যে, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী লোকসানের কথা বলে কিছুটা কম ভোজ্যতেল আমদানি করছেন। ফলে চাহিদার তুলনায় আমদানি কম থাকায় ভোজ্যতেলের দাম বহুলাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি রোববার বিকেলে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনারি অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির এ তথ্য জানান, যা ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।
সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা এবং খোলা সয়াবিনের দাম ১৩৬ টাকা নির্ধারিত ছিল। তখন পাম তেলের দাম ছিল লিটারপ্রতি ১১৮ টাকা। এদিকে নতুন দাম অনুযায়ী এখন থেকে ভোক্তাকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি অতিরিক্ত ৮ টাকা গুনতে হবে। আর খোলা সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি অতিরিক্ত ৭ টাকা ব্যয় করতে হবে। পাম তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে পাম তেলের জন্য আগের ১১৮ টাকার স্থলে ১৩৩ টাকা খরচ করতে হবে।
ভোজ্যতেলের লাফিয়ে লাফিয়ে মূল্যবৃদ্ধির ফলে চরম বিপাকে পড়েছে নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। কিছু দিন আগেই জ্বালানি তেলের দাম একলাফে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। পণ্য পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাজারে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রতিটি দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী।
মানুষের ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু সে তুলনায় আয় বাড়েনি। তাই তো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ আয়ের সাথে ব্যয়ের হিসাব মিলাতে হিমসিম খাচ্ছে। গত দুই বছরে বহু মানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকেই ব্যবসার পুঁজি হারিয়ে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। বহু মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। চাপ পড়েছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমানের ওপর।
২০১৫ সালের পর সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এক টাকা বৃদ্ধি না পেলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। জীবন মানের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগে এলপিজি সিলেন্ডারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বেতন বৃদ্ধি সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
দেশের ইতিহাসে ভোজ্যতেলের দাম এখন সর্বোচ্চ। দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৮০০ টাকায়। ২০১৯ সালে যা ছিল প্রায় ৩ হাজার ৫০০ টাকা। তিন বছরে মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে মণপ্রতি প্রায় ২ হাজার টাকা। অন্যদিকে গত তিন বছরে পাম তেলের দাম মণপ্রতি ৩ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাম তেলের বর্তমান বাজারমূল্য ৫ হাজার ৪০০ টাকা, যা ২০১৯ সালে ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা।
মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত দুই বছরে ভোজ্যতেলের বাজার মোটেই স্থিতিশীল ছিল না। এছাড়া মহামারি করোনার কারণে উৎপাদন হ্রাসের পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়েছে। এমন অস্থিরতার কারণে গত দুই বছরে অন্তত আট দফায় ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারের তথ্য মতে, গত বছরের জুন মাসে পাইকারি বাজারে মণপ্রতি সয়াবিনের দাম ছিল ৪ হাজার ৩০০ থেকে ৪ হাজার ৪০০ টাকা। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার টাকায়। নভেম্বরে পৌঁছায় ৫ হাজার ৫০০ টাকায়। অথচ ২০১৯ সালে এ দাম ছিল মণপ্রতি ৩ হাজার ৮০০ টাকা।
তিন বছরে দাম বেড়েছে শতাংশের হিসেবে প্রায় ৬৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। মূলত ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়। তুলনামূলক কম দামের কারণে দেশে সয়াবিন তেলের বিকল্প হিসেবে পাম অয়েল ব্যবহৃত হয়। ভোজ্যতেল ছাড়াও খাদ্য উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে পাম অয়েল। এর মূল উৎপাদক দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। সেখান থেকেই এই তেল আমদানি করা হয়। দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা বছরে প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন। যার ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। ফলে প্রতি বছর আমাদের ভোজ্যতেল আমদানি বাবদ কয়েক হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যয় মেটাতে হয়। অথচ সরিষার তেল থেকে পারতো অন্যতম বিকল্প ভোজ্যতেলের উৎস।
দেশে সরিষার চাষাবাদ জনপ্রিয় করার জন্য কৃষক পর্যায়ে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করা গেলে কৃষকরা একদিকে যেমন লাভবান হতো অন্যদিকে সরিষা চাষে উৎসাহিত বোধ করতো। পাশাপাশি ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরশীলতা কমানো যেত। এছাড়া আমাদের দেশে বহু অটো রাইস মিল রয়েছে। অটো রাইস বার্ন ব্যবহার করেও এক ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত ভোজ্যতেল উৎপাদন করা যায়।
আমরা আমদানি তেলের বিকল্প হিসেবে এধরনের তেল উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করতে পারি। বিষয়টি সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখতে পারেন। এছাড়া দেশে প্রচুর পরিমাণে সূর্যমুখী চাষাবাদ করে তা থেকেও তেল উৎপাদন করতে হবে। যেভাবেই হোক আমাদের ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
লেখক : আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/এমএস