ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

চাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

মাহমুদ আহমদ | প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২

একটি মহল বরাবরই শান্তিময় সমাজকে অশান্ত করে তোলার কাজে ব্যস্ত থাকে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে তারা থাকে সদা তৎপর। দু-চারদিন ধরে ভারতের মুসলিমবিদ্বেষী কট্টরপন্থিরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার লক্ষ্যে উঠে পরে মাঠে নেমেছে। অথচ প্রত্যেক ধর্মের মূল মর্মবাণী হলো-শান্তি ও মানুষের কল্যাণ। ধর্ম মানুষকে সম্প্রীতি ও পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়।

বিভিন্ন সময় ধর্মকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল ও সুযোগসন্ধানী একটি চক্র বরাবরই পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চালায়। সম্প্রতি একই অবস্থা লক্ষ্য করা যায় ভারতে। বিশ্বভাজন সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর চারদিন আগে মৃত্যুবরণ করেন। শেষকৃত্যের জন্য লতা মঙ্গেশকরের মরদেহ তার বাড়ি প্রভুকুঞ্জ থেকে মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কে নিয়ে আসা হয়। প্রচুর ভক্ত সে সময় তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।

লাইন ধরে মানুষজন অস্থায়ী একটি প্লাটফর্মে উঠে শেষ দেখা দেখছিলেন এবং ফুল-মালা দিচ্ছিলেন। একসময় শাহরুখ খানও ওই বেদিতে ওঠেন। ফুল দেওয়ার পর তিনি দুই হাত তুলে দোয়া পড়া শুরু করেন। সে সময় তার মুখে মাস্ক ছিল। দোয়া শেষ করে শাহরুখ মাস্ক নিচু করে এবং বাতাসে ফুঁ দেন। শাহরুখ খানের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের পর থেকেই ভারতের মুসলিমবিদ্বেষী কট্টরপন্থিরা অভিযোগ করছেন যে তিনি নাকি থুতু নিক্ষেপ করে লতা মঙ্গেশকরের অপমান করেছেন। অথচ তিনি দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে বোরকা ও হিজাব পরে কলেজে যাওয়ার কারণে কট্টর হিজাববিরোধীদের রোষানলে পড়েছেন ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকের মুসলিম ছাত্রী মুসকান খান। এ দুটি বিষয় সামনে রেখে মুসলিমবিদ্বেষী কট্টরপন্থিরা সে দেশে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করছে।

অথচ আবহমানকাল থেকে ভারতে নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মমতের অনুসারীরা পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে মিলেমিশে একত্রে বসবাসের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য সংহত রেখেছে। যার যার ধর্ম তাদের নিজস্ব রীতি অনুযায়ী পালন করে আসছে।

সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করছি হঠাৎ করেই যেন এ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার লক্ষ্যে একটি মহল আবার সোচ্চার হয়েছে। ইসলাম এমন এক শান্তিপ্রিয় ধর্ম যেখানে সব ধর্মের অনুসারীদের সম্মানের শিক্ষা দেয়। প্রেমপ্রীতি, সৌহার্দ্য আর শান্তি ও সম্প্রীতির এক পরিমণ্ডল বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। অন্য কথায়, মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি বিশ্বস্ততার হক আদায়ে এবং তার সৃষ্টির প্রতি দায়বদ্ধ আচরণের মাধ্যমে এ বিশ্ব এক স্বর্গরাজ্যে পরিণত করা।

প্রকৃত ইসলামের আকর্ষণীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার জোর-জবরদস্তি এবং বল প্রয়োগে নয় বরং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করার মাধ্যমে সম্ভব। বল প্রয়োগ করলে অন্যের অধিকার যেমন দেয়া যায় না, তেমনি আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভও এর দ্বারা সম্ভব নয়।

ইসলামে মুসলমান ও অমুসলমানের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলাম শত্রুদের সাথেও দয়ার্দ্র আচরণ করে, তা শান্তিকালীন সময়ই হোক বা যুদ্ধাবস্থায়ই হোক। সর্বাবস্থায় ইসলাম অমুসলমানদের অধিকার মর্যাদার সাথে সংরক্ষণ করে। বিদ্বেষ ছড়ানো ও আক্রমণের অধিকার ইসলামে নেই। চড়াও হওয়া বা আক্রমণ করার অধিকার ইসলামে নেই।

ইসলামের বাস্তব শিক্ষা হলো, কেবল আক্রান্ত হলেই তুমি যুদ্ধ করতে পার। অধিকন্তু ইসলামে এ নির্দেশও রয়েছে যে, আক্রমণকারী বা আগ্রাসী হইও না, চুক্তি ভঙ্গকারী হইও না। আগ্রাসন বলতে কী বোঝায়? সে যুগে ইসলামবিরোধীরা পরাজিত সৈন্যদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে বিকৃত করতো, এটা সমর নীতির পরিপন্থি, জিঘাংসামূলক অত্যন্ত গর্হিত এক কর্ম। ইসলামে এটি নিষিদ্ধ।

শিশু ও নারীদের হত্যা করাও নিষিদ্ধ। ধমীর্য় নেতাদের পাদ্রি-পুরোহিত, রাব্বি, প্রমুখদের তাদের উপাসনালয়ে হত্যা করা সম্পূর্ণ অবৈধ। অন্য কথায়, যুদ্ধ কেবল সমরক্ষেত্রেই সংঘটিত হতে পারে। অথবা অন্য কোনো বিকল্প খুঁজে না পেয়ে যদি শহর বা নগরে যুদ্ধ করতে বাধ্যও হতে হয়, তবুও কেবল তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করা যেতে পারে, যারা বিরোধিতায় আগ বাড়িয়ে অস্ত্র ধারণ করে আক্রমণ চালিয়েছে।

আমরা আজ এটাই দেখছি যে, সুন্দর সাবলীল ও সুংগঠিত এসব ইসলামি শিক্ষার ওপর কেউ আমল করছে না। আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা শিশু, নারী, বৃদ্ধ, নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করছে, অন্যদিকে আগ্রাসী বাহিনী, শহর নগর-বন্দরে বোমাবর্ষণ করছে, গুলি চালাচ্ছে, করছে অতর্কিত আক্রমণ। তারা নগরগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নগর অবকাঠামো সমূলে বিনাশ করছে। এতে নাগরিক অধিকারের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকছে না। আজ আমরা অনেক ক্ষেত্রে মহানবির শিক্ষা ভুলে উগ্রতার পথ বেছে নিয়েছি।

মহানবির (সা.) মৃত্যুর অল্প দিন আগে বিদায় হজের সময় বিরাট ইসলামি সমাগমকে সম্বোধন করে তিনি (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়।

শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করলো। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ।’ (বায়হাকি) এই মহান শব্দগুলো ইসলামের উচ্চতম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম নীতিমালার একটি দিক উজ্জ্বলভাবে চিত্রায়িত করেছে। শতধা বিভক্ত একটি সমাজকে অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতাভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহ্বান।

বিশ্বাসের স্বাধীনতা হচ্ছে সব মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলাম ধর্মের বিধান মতে ‘ধর্ম’ হচ্ছে নিজ, পছন্দের একটি বিষয়। এ ধর্ম একটি সুস্পষ্ট ধর্ম। এই ধর্ম গ্রহণের পরেও চাইলে কেউ এটা ত্যাগ করতে পারে, কোনো জোর নেই, তবে এর বিচার সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজ হাতেই করেন। ধর্মে যদি বলপ্রয়োগের বিধান থাকতো, তাহলে মহানবি (সা.) মক্কা বিজয়ের পর অমুসলমানদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য বাধ্য করতেন এবং মক্কায় বসবাসের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এতে প্রমাণিত হয়, ধর্মের জন্য বলপ্রয়োগ ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের আদর্শ হলো শত্রুর সাথেও বন্ধুসুলভ আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

আমার ধর্মের সাথে, আমার মতের সাথে, আমার ইবাদতের পদ্ধতির সাথে আরেকজন একমত নাও হতে পারেন, তাই বলে কি তার বিরুদ্ধে আমাকে অবস্থান নিতে হবে? ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনো দেশের সংস্কৃতিকে পছন্দ নাও করতে পারি তাই বলে এ নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলার কোনো অনুমতি ইসলাম কেন কোনো ধর্মই দেয় না। আমাদের দেশেও একটি মহল বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার পাঁয়তারা করে আর বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের চেষ্টা করে কিন্তু এদেশের সচেতন নাগরিক বরাবরই তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।

কাজী নজরুল ইসলাম কতইনা চমৎকার লিখেছিলেন- ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।’ তাই সমাজে যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করবে তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের প্রতিহত করতে হবে। এটা আমাদের দেশে হোক বা ভিন্ন দেশে। আমরা কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের আশ্রয় বা প্রশ্রয় দিতে পারি না।

এইচআর/ফারুক/এমএস