ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

একাকিত্ব শুধু সামাজিক নয় জনস্বাস্থ্য সমস্যাও

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ০৯:৫০ এএম, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২

একাকিত্ব বোধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অবসাদের। অবসাদ অনেক সময় মৃত্যু ডেকে আনে। এই একাকিত্ব, আত্মহত্যা বা হত্যার কারণ সর্বোত মানসিক এমনটাও নয়। একাকিত্ববোধ প্রত্যেকের নিয়তি। পিতৃ-মাতৃহীন ছেলেমেয়ে, বিপত্নীক পুরুষ, বৃদ্ধাশ্রমে প্রেরিত বাবা-মা, ঋণজর্জর ব্যর্থ ব্যক্তি – সবারই অবসাদ আসতে পারে। একাকিত্ব এক অদৃশ্য শক্তিমান দৈত্য। কখন, কার ঘাড়ে চেপে বসে, তাকে দিয়ে কী করিয়ে নেয় সেটা বড় অনিশ্চিত।

আবু মহসিন খান তেমনই একজন। আত্মহত্যার আগে ব্যক্তিজীবনের নানা হতাশার কথা তুলে ধরেন তিনি যা স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের নজরে আসেনি কখনও। তার সমস্যাগুলো বোঝা গেল মারা যাওযার পর। তিনি নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলেন। ঘরবন্দি ছিলেন। তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই এবং নিজেও হয়তো যেতেন না। ফোনে কথা বলার কেউ ছিল না তেমন। অনেকদিন প্রিয়জনের মুখ দেখেননি। আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। অবসাদে আর মনোবৈকল্যে আকুল এই মানুষটার মানসিক স্বাস্থ্য চুরমার হয়ে গিয়েছিল কখন তা কেউ জানতে পারেনি।

তিনি ছিলেন একা ও নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব তিনি স্বেচ্ছায় বরণ করেন নি। হয়তো এই একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা নানা কারণে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল তার জন্য। তিনি বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। অনেক ব্যস্ততা ছিল। আয় করেছেন অনেক, স্বজন আর বন্ধুদের দিয়েছেন অনেক। অতি ব্যস্ততা মানুষের এই ব্যক্তিগত সময়কে কখন হরণ করে নেয় সে টেরও পায় না। নিজের মুখোমুখি বসবার, চিন্তা করবার সময় ছিল না হয়তো। এবং একটা সময় সহজ জীবন হতে অনেক দূরে নিতান্ত একা হয়ে গিয়েছিলেন যা তিনি বুঝতে পারেন নি। এই বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির পরিপন্থী। কিন্তু সেটাই ঘটে আমাদের জীবনে। মহসিন খান বিচ্ছিন্নতার নির্মম দূরত্বের জন্য আক্ষেপ করে নিজেই নিজেকে খুন করেছেন।

যারা আত্মহত্যা করেন কেবল তারাই জানেন কেন করেছেন। আর কারও পক্ষে বলা সহজ নয় কেন তিনি জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে দিলেন। যারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন তাদের একজন মনিরা রহমান। তার মতে, “প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে। যিনি আত্মহত্যার কথা ভাবেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি আসলে মরতে চান না বরং তিনি তার কষ্টটাকে শেষ করতে চান।

তিনি আত্মহত্যা করার আগে অনেক ভাবে জানান দেওয়ার চেষ্টাও করেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় আমরা সেগুলো ধরতে পারি না বা অজ্ঞতার কারণে অবহেলা করে থাকি। তখনই একজন নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন যখন তার কাছে আর কোন পথ থাকে না। বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্নতা, সাইকোসিস, মাদক, সহিংসতা, অবহেলা, বেকারত্ব, শারীরিক অসুস্থতা, ছাড়াও আরো কিছু কারণে একজন মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা প্রতিরোধ যোগ্য। যার পরিবারে এমন ঘটনা ঘটে যায় সেই পরিবার অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যায়। তাই অনুগ্রহ করে এমন মন্তব্য করবেন না যাতে তাদের কষ্ট আরো বেড়ে যায়।

আসুন মানসিক স্বাস্থ্য সচেতন হই। মানুষের কথা মন দিয়ে শুনি। আর কোন রকম বিচার না করে তার পাশে থাকি। অন্যদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা প্রকাশ করতে হয় কিভাবে সেটা শিখি। আমাদের আশেপাশে অনেক মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। আমরা যেন আমাদের কথার বাণে তাদের জীবন আরো দুর্বিষহ না করে তুলি। সময়টা ভালো যাচ্ছে না তাই আমাদের আরো একটু বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

যিনি একা স্বপ্নে জাগরণে একাকিত্বের নির্যাতন তাকে সইতে হয়। অর্থ ও প্রতিপত্তির চোরাবালিতে একা তলিয়ে যাওয়ার একাকিত্বও আছে। এই নিঃসঙ্গতা হতে মুক্তির উপায় নিয়ে ভাবনা দরকার। আমরা এক সময় সহজ জীবনযাপন করতেই অভ্যস্ত ছিলাম। এখন আমরা অনেকেই তা পারি না। চায়ের দোকানে বসে পথচলতি মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারিনা।

প্রত্যেকেরই সমাজের সাথে, মানুষের সাথে সহজ সংযোগ দরকার। আনন্দে আবেগে বেদনায় উল্লাসে মন আন্দোলিত করা চাই। মানুষের সঙ্গে মিশতেই যদি না পারি তবে তবে মন কেমন করে জাগবে। নিজের সহজ জীবনের বর্ণ-গন্ধ-স্বাদই কেবল একজনের জীবনকে নানাভাবে বর্ণালী করে। সেই জীবন পরিপার্শ্ব হতে বিচ্ছিন্ন থাকলে তার বর্ণ-গন্ধ-স্বাদ থাকে না।

মহসিন খানের মৃত্যু আবার জনপরিসরের আলোচনায় নিয়ে এল বয়স্কদের একাকিত্ব প্রসঙ্গটি। এটি যে একটি সামাজিক সমস্যা, তা আমরা জানি। কিন্তু এখন গবেষকরা বলছেন, এটি একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যাও। অস্বাস্থ্যের পরিচিত যে লক্ষণগুলো নিয়মিত বলা হয়, যেসব রোগ মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে পারে বলে সুবিদিত, সেগুলোর তুলনায় একাকিত্ব কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা থাকলে মৃত্যু বাড়ে। পরিবার ছোট হয়েছে, সামাজিক সংযোগের পরিচিত নকশা বদলে গেছে, গ্রাম হতে শহরে আসবার ঝোঁক বেড়েছে। তারও অবধারিত ফল নিঃসঙ্গতা। নিজের পুষ্টি, পরিচর্যা, চিকিৎসার ভার বইতে বয়স্করা যত অক্ষম হবেন, ততই মৃত্যু ত্বরান্বিত হবে। তাই বলা যায় নিঃসঙ্গতার সামাজিক ব্যাধি অনেকটাই প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু প্রয়োজন স্বজনের সহৃদয়তা আর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন