শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন
ওমিক্রনের থাবায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনরায় তছনছ হয়ে গেছে। অচল হয়ে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। ওমিক্রনের প্রভাবে সরকারি আদেশে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু বলতে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের প্রায় সব কিছুই সচল। অচল শুধু শিক্ষাঙ্গন, যা দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। ওমিক্রনের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই চলমান ছিল বাণিজ্যমেলা। সরকার বিষয়টি দেখেও না দেখার মতো আচরণ করেছে।
মেলায় প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হয়েছে। ওমিক্রন বিবেচনায় মেলা বন্ধও করা হয়নি, যা দেশে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। ওমিক্রনের মধ্যেই শুরু হতে পারে একুশে বইমেলা এমন সংবাদও ঘুরে বেড়াচ্ছে নেট দুনিয়ায়। ওমিক্রনের প্রভাবে যখন কাঁপছে পুরো দেশ, তখন দৃশ্যত দেশের কোথাও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে জনসাধারণের মধ্যে কোনো প্রকার সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। পথঘাট, মাঠ কোথাও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের কোনো কড়াকড়ি নেই।
গণপরিবহনেও স্বাস্থ্যবিধি চরমভাবে উপেক্ষিত। দেশের সব ছোটবড় শপিংমল বা বিপণি-বিতানে পুরোদমে কেনাকাটা চলছে। বিনোদন কেন্দ্রগুলোয় জনসমাগম কিছুটা কমলেও খোলা রয়েছে সব কিছু। ঢিলেঢালা ভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি। তারপরও বন্ধ হয়নি বিপণি-বিতান বা বিনোদন কেন্দ্র। এখনও দেশের বহু মানুষকে টিকার আওতায় আনা যায়নি।
সর্বজনীন টিকা কার্যক্রম চলমান থাকলেও এখনও বহু মানুষ টিকা গ্রহণ করেনি বা টিকা নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেই চলছে। অথচ করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিকা গ্রহণই একমাত্র কার্যকরী পদ্ধতি। দেশে টিকার পর্যাপ্ত মজুত থাকার কথা সরকারিভাবে প্রচার করা হলেও কেন দেশের অধিকাংশ মানুষকে এখনও টিকার আওতায় আনা সম্ভব হলো না তার প্রকৃত কারণ এখনও অনেকের কাছেই অজানা। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ওমিক্রন দেশের অন্য কোথাও থাবা বসাতে না পারলেও শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কক্ষে সফলভাবে তালা ঝুলিয়ে দিতে পেরেছে।
দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও খোলা রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সব আবাসিক হল। ওমিক্রনের মধ্যেই খোলা আবাসিক হলে অবস্থান করছে বহু শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাস বন্ধ হলেও শিক্ষাঙ্গনের আশেপাশে গড়ে ওঠা ব্যক্তি মালিকানাধীন ছাত্রাবাসে অবস্থান করছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। তারা একসাথে এসব আবাসিক ছাত্রাবাসে বসবাস করছে। একই ডাইনিংয়ে দল বেঁধে খাওয়া দাওয়া করছে। দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করছে। একসাথে আড্ডা দিচ্ছে।
এসব ওমিক্রন কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে ওমিক্রনের প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে অজুহাতে ক্লাসরুমভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া মোটেই বোধগম্য নয়। যারা মনে করেছিলেন যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলেই শিক্ষার্থীরা বাসায় অবস্থান করবে, তাদের সেই আশা মোটেই পূরণ হয়নি। শিক্ষার্থীরা শপিংয়ে যাচ্ছে, সিনেমা হলে যাচ্ছে, টি-স্টলে আড্ডা দিচ্ছে, সুযোগ মতো বাবা-মায়ের সাথে পর্যটন কেন্দ্রে পিকনিক মুডে ঘুরতে যাচ্ছে। কোনো কিছুই থেমে নেই। থেমে গেছে শুধু শিক্ষা।
সবকিছু উন্মুক্ত রেখে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রাখার যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে শুধু সঠিক তদারকির অভাব ও জনসাধারণের স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে অনীহার কারণে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে শিক্ষার্থীরা ঘরের মধ্যে বসে আছে তা কিন্তু নয়। বরং তারা স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গণপরিবহনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। সবই চলছে প্রায় স্বাভাবিক গতিতে।
যদিও ওমিক্রনে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তাহলে কেন শুধু দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ তা কোনোভাবেই বোধগম্য নয়। বাজারে গেলে দেখা যায় গাদাগাদি করে মানুষ কেনাকাটা করছে, মুখে মাস্ক নেই, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো বালাই নেই, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মান্য করার কোনো বাধ্যবাধকতা পরিলক্ষিত হয় না বললেই চলে।
হাসপাতাল, ক্লিনিক, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, নৌপথ সব জায়গায় একই চিত্র। তাহলে কেন দিনের পর দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে দেশের শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে তা শিক্ষা সচেতন মানুষের কাছে আজ বড় প্রশ্ন। এ অবস্থা মোটেই কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো যেখানে খোলা সেখানে ক্লাসরুমগুলো কেন বন্ধ।
দেশে যখন ওমিক্রনের অজুহাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কিন্তু সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল বিনা বাধায়। শিক্ষার্থীরা যখন তাদের প্রিয় ক্লাসরুমে বসে ক্লাস করতে পারে না, পরীক্ষার হলে বসে পরীক্ষা দিতে পারে না অথচ ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচন চলমান রয়েছে ওমিক্রনের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে। বিয়ে-শাদিসহ সব ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছে বাধাহীন ভাবে।
আশার কথা হলো, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যায়ক্রমে তাদের বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ওমিক্রনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সত্ত্বেও অধিকাংশ দেশই কিন্তু এবার তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ করেনি। ইউনিসেফ ইতোমধ্যে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল করার আহ্বান জানিয়েছে। আমাদের দেশের বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকেই হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিপক্ষে কথা বলতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলেও জনসাধারণ কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন না করে, বা বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বা জীবন ও জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে বের হচ্ছে।
বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও অন্যদের মতো পথে-ঘাটে-মাঠে লঞ্চ-স্টিমারে স্বাস্থ্যবিধি মানাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না। তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে লাভ কি? এমন বাস্তবতায় শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে একটি জাতিকে পঙ্গু করার কোনো মানে হয় না। বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না করে সরকার ঘোষিত বা এ লক্ষ্যে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ যদি অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করা যেত, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে প্রতিপালন করা যেত, যদি পথে-ঘাটে-মাঠে সরকারের ঘোষিত বিধি বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করা যেত, তাহলে সেটাই হতো ওমিক্রন মোকাবিলায় অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না করে যদি শতভাগ শিক্ষার্থীদের দুই ডোজ টিকা সময়মতো দেওয়া যেত, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কর্তৃক প্রদত্ত বিধিনিষেধ কঠোরভাবে প্রতিপালন নিশ্চিত করা যেত, তাহলে এবার অন্তত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার প্রয়োজন হতো না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ওমিক্রন মোকাবিলার কোনো স্থায়ী সমাধান নয় বরং দেশের ৭০-৮০ ভাগ মানুষকে দ্রুত সময়ের মধ্যে টিকার আওতায় আনা হতে পারে ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী সমাধান, যা অতীব জরুরি।
সামাজিক অনাচার রোধ, বাল্যবিয়ে বন্ধ ও মাদকাসক্তের ঝুঁকি থেকে ছাত্র সমাজকে বিরত রাখতে হলে কালবিলম্ব না করে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প চিন্তা করার খুব একটা সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আশা করি সরকারসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন এবং অনতিবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম সচল করবেন।
লেখক: প্রফেসর আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
এইচআর/এএসএম