করোনার ওমিক্রন ঢেউ সত্যিই কি মারাত্মক নয়!

ডা. মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরী

করোনার সংক্রমণ আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন যে, এখন ঢাকায় করোনায় সংক্রমিতদের প্রায় ৬৯%- ই নতুন ধরন ওমিক্রনে আক্রান্ত। যে হারে রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে তাতে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে হাসপাতালের সব শয্যা ভরে যাবে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই ভাবছেন, ওমিক্রনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৃদু মাত্রার লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে এটা নিয়ে এত শঙ্কা কেন। আসলে ওমিক্রন কি কম ক্ষতিকারক? দেখে নিই বৈশ্বিক চিত্র কি বলছে।

ওমিক্রন (Omicron) হচ্ছে করোনা ভাইরাসের সর্বশেষ ভেরিয়েন্ত (Variant), যা প্রথম শনাক্ত হয় আফ্রিকা মহাদেশের বোতসওয়ানায় ১১ নভেম্বর, ২০২১; কিন্তু সেটা তখনই ঘোষিত হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকাই প্রথম ঘোষণা দেয় ২৩ নভেম্বর। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রন ব্যাপকভাবে ছড়ায় । আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে এর ব্যাপকতা পূর্বের ডেল্টা ঢেউকে ছাড়িয়ে যায়। এ সমস্ত উন্নত দেশে প্রচুর পরিমাণে টিকা দেওয়ার কারণে ইতিমধ্যে Herd Immunity অর্জিত হওয়ার কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে সেখানে করোনার সংক্রমণ কেন এত ব্যাপক। জেনে নেই, ঐ সমস্ত দেশে টিকা গ্রহণের অবস্থা।

যুক্তরাজ্যে অদ্যাবধি ৭০% লোক পূর্ণ ডোজ এবং আরও ৬% লোক এক ডোজ টিকা নিয়েছেন। বুস্তার (Booster) ডোজ পেয়েছেন ৪ কোটি ( ৬০% ) লোক। সেখানে ১৭ জানুয়ারি নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮৪,৪২৯ জন। মারা গিয়েছে ৮৫ জন। যদিও সর্বাধিক এক দিনে আক্রান্ত হয়েছে ২,১৮,৩৭৬ জন এবং মারা গিয়েছে ৩৯৮ জন। এর পূর্বে ডেল্টা ঢেউয়ে একদিনে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল ৬৭,৭৯৪ জন। একদিনে সবচেয়ে বেশি মারা গিয়েছে ১,৮২৪ জন।

যুক্তরাষ্ট্রে পূর্ণ ডোজ টিকা পেয়েছে ৬৩% ও এক ডোজ পেয়েছে আরও ৮%। বুস্তার ডোজ পেয়েছে ৮ কোটি ( ২৫% ) মানুষ । যুক্তরাষ্ট্রে ১৬ জানুয়ারি করোনায় নতুন আক্রান্ত ৩,৮৯,৫৫৩ জন, মারা গেছে ৪৬৮ জন। যদিও ১৪ জানুয়ারি নুতন শনাক্ত হয়েছে ৮,৫৯,১৪৯ জন আর ৬ জানুয়ারি মারা গেছে ২,৪৫২ জন। যুক্তরাষ্ট্রে ৯৫% করোনা ওমিক্রন ধরনের।

ডেনমার্কে পূর্ণ ডোজ টিকা পেয়েছে ৮১%, এক ডোজ পেয়েছে আরও ৩%। বুস্তার ডোজ পেয়েছে ৫৫%। ১৭ জানুয়ারি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ২৬,৯৬৫ জন, মৃত্যুবরণ করেছে ১১ জন। ডেনমার্কে ডেল্টা ঢেউয়ে দৈনিক সর্বাধিক শনাক্ত হয়েছিল ১,০৮৫ জন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ১২ ডিসেম্বর,২০২১ - এ নুতন রোগী শনাক্ত হয় ৩৭,৮৭৫ জন (ওমিক্রন ঢেউয়ে সর্বাধিক)। মারা যায় ৩৬ জন। কিন্তু ১৫ জানুয়ারি মারা যায় ১৬১ জন। দক্ষিণ আফ্রিকায় মারা যাওয়ার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। সেখানে ৬৫ বছরের উপরে জনসংখ্যা মাত্র ৬% বিধায় মৃত্যুর সংখ্যা কম বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওমিক্রনে আক্রান্তের সংখ্যা ৬,৪৯,৮৩৪। ওমিক্রন আক্রান্তদের ২৫% হচ্ছে টিকা না দেওয়া ব্যক্তি, ৪৩% হচ্ছে ২ ডোজ দেওয়া ব্যক্তি, ২৩% হচ্ছে বুস্তার ডোজ পাওয়া ব্যক্তি। ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওমিক্রনে আক্রান্ত ৮১৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং মারা গিয়েছে ৫৭ জন। দেখা যাচ্ছে, টিকা ওমিক্রনের বিরুদ্ধে খুব বেশি সুরক্ষা দিতে পারছে না। যে কারণে ওমিক্রন প্রতিরোধ করতে নতুন ভাবে টিকা তৈরির কাজ চলছে।

যুক্তরাজ্যে গবেষণায় দেখা গেছে যে, দুই ডোজ AstraZeneca টিকা দেওয়ার পরে ওমিক্রনের ক্ষেত্রে ১২ সপ্তাহ পরে ৩০% (যেটা সর্বাধিক) আর ১৯ সপ্তাহ পরে ১৮% সুরক্ষা মিলছে এবং ডেল্টার ক্ষেত্রে ৪ সপ্তাহ পরে ৮০% (যেটা সর্বাধিক ) আর ১৯ সপ্তাহ পরে ৫৭% সুরক্ষা মিলছে। এক্ষেত্রে ফাইজার বা মডার্না টিকা বুস্তার ডোজ হিসেবে দিলে ওমিক্রনের ক্ষেত্রে ৪ সপ্তাহ পরে ৬২% আর ১০ সপ্তাহ পরে ৪০% সুরক্ষা মিলছে এবং ডেল্টার ক্ষেত্রে ৪ সপ্তাহ পরে ৯৮% আর ১০ সপ্তাহ পরে ৮২% পর্যন্ত সুরক্ষা মিলছে।

আর দুই ডোজ ফাইজার টিকার পরে ওমিক্রনের ক্ষেত্রে ৩ সপ্তাহ পরে ৬০% (সর্বাধিক ) ও ডেল্টার ক্ষেত্রে ৪ সপ্তাহ পরে ৯৫% সুরক্ষা মিলছে। আর বুস্তার হিসেবে ফাইযার দিলে ওমিক্রনের ক্ষেত্রে ৪ সপ্তাহ পরে ৬৩% ও ১০ সপ্তাহ পরে ৪৮% সুরক্ষা পাওয়া যাচ্ছে। আর ডেল্টার ক্ষেত্রে ৪ সপ্তাহ পরে ৯৭% ও ১০ সপ্তাহ পরে ৯২% পর্যন্ত সুরক্ষা পাওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে ব্যবহৃত টিকা ডেল্টার চেয়ে ওমিক্রনের ক্ষেত্রে কম কার্যকরী। এটাও বলা যায়, যারা দুই ডোজ AstraZeneca টিকা নেওয়ার পরে ৬ মাস পার হয়ে গেছে অথচ এখনও বুস্তার ডোজ নেয়নি তারা ওমিক্রনের ক্ষেত্রে অনেক ঝুঁকিতে থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রে ৫২,২৯৭ জন ওমিক্রনে আক্রান্ত এবং ১৯,৯৮২ জন ডেল্টায় আক্রান্ত রোগীর মধ্যে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২৩৫ জন ওমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তি ও ২২২ জন ডেল্টায় আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। ওমিক্রনে আক্রান্তদের আইসিইউ-তে যেতে হয়েছে এবং মারা গিয়েছে যথাক্রমে ডেল্টার ৪ ভাগের ১ ভাগ ও ১১ ভাগের ১ ভাগ রোগীকে।

সুতরাং বলা যায়, রোগীর সংখ্যা অনুপাতে হাসপাতালে ভর্তি ডেল্টার তুলনায় ওমিক্রনে কম। কিন্তু ওমিক্রনে যেহেতু অনেক গুণ বেশি সংক্রমণ হয় তাই হাসপাতালে ভর্তি মোট রোগীর সংখ্যা ডেল্টার তুলনায় বেশি। এখানে উল্লেখ্য, হাসপাতালে Severe ক্যাটাগরি ও Co-morbidity সহ Moderate ক্যাটাগরি রোগীরাই ভর্তি হয়, যাদেরকে কমবেশি অক্সিজেন দিতে হয়।

উপরের পরিসংখ্যান থেকে বুঝা যায় যে, ওমিক্রনের সংক্রমণ ক্ষমতা ডেল্টার চেয়ে অনেক বেশি। বর্তমানে ব্যবহৃত টিকা সমূহ ডেল্টার চেয়ে ওমিক্রনে সুরক্ষা অনেক কম দিচ্ছে। সেজন্য মাস্ক ব্যবহারসহ অন্যান্য COVID-19 প্রোটোকল মেনে চলতে হবে। আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, করোনা ভাইরাস কারও মুখ বা নাক থেকে নিঃসৃত হলে তা কক্ষের আর্দ্রতা ৫০%-এর নিচে থাকলে ৫ সেকেন্ডের মধ্যে ৫০% সংক্রমণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

আর ২০ মিনিটের মধ্যে ৯০% হারিয়ে ফেলে। কক্ষ যদি খোলামেলা (Well-ventilated) হয় তাহলে সংক্রমণের আশঙ্কা কম থাকে। সেজন্য মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় এবং খোলামেলা কক্ষে অবস্থান করলে করোনা সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে কম হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকায় সংক্রমণ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে ( ১৭ জানুয়ারিতে শনাক্ত ১,৬৯১) গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সংক্রমণের শীর্ষে ছিল দেশটি (একদিনে শনাক্ত ৩৭,৮৭৫ )। এটা সম্ভব হয়েছে মাস্ক পরিধান ও অন্যান্য আচার-আচরণ পালনে কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ি আরোপের ফলে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ওমিক্রনের ঢেউ চলছে। আগের ডেল্টা ঢেউয়ের সময় সংক্রমণের প্রথম দিকে আক্রান্ত সংখ্যা ১০ দিনে দ্বিগুণ হয়েছে। এবার ৪ দিনে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত করোনার দুই ডোজ টিকা পেয়েছে ৩৪% লোক, এক ডোজ পেয়েছে আর ১৮%। বুস্তার ডোজ পেয়েছে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ লাখ লোক। ভারতের পশ্চিম বঙ্গে সংক্রমণ অনেক বেশি। গেল ডেল্টা ঢেউয়ে পশ্চিম বঙ্গের কারণে আমাদের দেশে অনেক বেশি লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং মারাও গিয়েছে অনেক।

যেহেতু ভারত বা ইউরোপ -আমেরিকার চেয়ে টিকা প্রাপ্ত লোকের সংখ্যা আমদের দেশে অনেক কম তদুপরি আমদের চিকিৎসা ক্ষমতাও তাদের চেয়ে অনেক কম, সেজন্য যাতে সংক্রমনের মাত্রা কম থাকে তার জন্য মাস্ক পরিধান ও COVID-19-এর অন্যান্য প্রোটোকল মেনে চলার কোন বিকল্প নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টিকা সংগ্রহে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন বিধায় অনেকে সুরক্ষিত থাকবে। টিকার জন্য প্রচুর অর্থ জোগান দিতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি মাস্ক পরিধান ও অন্যান্য আচার-আচরণ মেনে না চলি তাহলে হাসপাতালের উপর অনেক চাপ সৃষ্টি হবে, আর্থিক ক্ষতি হবে অনেক, অনেক প্রাণ ঝরে যাবে অকালে। তাই সময় থাকতে সকলের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ।

লেখক : সদস্য, জাতীয় করোনা ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন কমিটি, মহাসচিব, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল প্রাকটিশনারস এসোসিয়েশন।

এইচআর/এএসএম