মুজিব স্বর্ণপদক ও একজন অনন্যসাধারণ অর্থনীতিবিদ
ড. মতিউর রহমান
২০২১ এর ২২ ডিসেম্বর দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রে একটি খবর খুবই গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়। সংবাদটি ছিল মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে অর্থনীতিশাস্ত্রে অনন্যসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘মুজিব স্বর্ণপদক’ পাচ্ছেন ড. আবুল বারকাত। পদকটি প্রদান করবে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০২১ এ অর্থনীতি সমিতির ২১তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই সম্মেলনে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতকে পদকটি পরিয়ে দেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আজীবন সদস্য স্বনামধন্য দুজন প্রবীণ ব্যক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব শতবর্ষে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি কতৃর্ক প্রথমবারের মতো প্রবর্তিত ‘মুজিব স্বর্ণপদক’ আবুল বারকাতের মতো একজন অর্থনীতিবিদকে প্রদান করা নিঃসন্দেহে একটি যথার্থ উদ্যোগ ও তার অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি এদেশের অর্থনীতিবিদদের এক প্রাণপ্রিয় সংগঠন। সাধারণ মানুষের কল্যাণে সরকারের নীতিনির্ধারণে এ সমিতি বরাবরই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বিগত দুই দশকেরও অধিক সময় ধরে এই সমিতির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। এই সুদীর্ঘ সময়ে তিনি একাধিকবার সমিতির সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে এবং সর্বাধিক ভোট পেয়ে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়ে সমিতির দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছেন।
তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি সর্বদিক দিয়ে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশে আরও অনেক প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ থাকতে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি কেন ড. আবুল বারকাতকে ‘মুজিব স্বর্ণপদক’ প্রদান করলো তা জানতে হলে ড. আবুল বারকাতের সুবিশাল ও গভীর বিশ্লেষণধর্মী গবেষণাকর্ম আর একই সাথে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। তবে এই লেখায় তার সুবিশাল কর্মযজ্ঞ তুলে ধরা অসম্ভব বিধায় সংক্ষেপে কিছু বিষয় তুলে ধরলে পাঠকরা কিছুটা হলেও ধারণা পাবেন বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
আবুল বারকাতকে যারা জানেন এবং চেনেন তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন তিনি মূলস্রোতের বিপরীতে একজন ভিন্নধারার অর্থনীতিবিদ। গতানুগতিকতার বাইরে অর্থাৎ প্রথাবিরোধী একজন অর্থনীতিবিদ; যিনি প্রতিনিয়ত তার লেখায ও গবেষণায় সাধারণ মানুষের কল্যাণ, জীবন সমৃদ্ধির কথা ও তাদের সার্বিক উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন। কোনো ভয়ভীতি বা কোনো কিছুর প্রলোভন তাকে তার এই চিন্তা ও ভাবনার জগৎ থেকে টলাতে পারে না।
যুক্তি দিয়ে সত্য উদ্ঘাটন করা ও তাতে অটল থাকা তার দৃঢ় চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। তার পাণ্ডিত্যের পরিধি সুবিস্তৃত। সত্য প্রকাশে অটলতা ও পাণ্ডিত্য— উভয় কারণেই তিনি ক্ষমতাবান ও সুবিধাবাদীদের কাছে অপ্রিয় ও বিরাগভাজন। একমাত্র সাধারণ মানুষের স্বার্থ ও ভালোবাসার কাছেই তিনি পরাস্ত হন। কারণ, তিনি মনে-প্রাণে তাদের কল্যাণকামী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এই সাধারণ ও গরিব-দুঃখী মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে তিনি মনেপ্রাণে ধারণ ও লালন করেন। তিনি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ভাবনা ও মৌলিক গবেষণায় ড. বারকাত অব্যাহতভাবে যে অবদান রেখে যাচ্ছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। এ পর্যন্ত তিনি যত গবেষণাকর্ম করেছেন সেসবের কয়েকটি মাইলফলক বা দিকনির্দেশক হিসেবে যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত হয়েছে তেমনি এদেশের উন্নয়ন—নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত তার ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শীর্ষক মাস্টারপিস গ্রন্থটি দেশে এবং দেশের বাইরে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
করোনা মহামারির শুরুতেই তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সামনে বিশ্বব্যাপী কী বির্পযয় ঘটতে যাচ্ছে। তাই তিনি নিরলস পরিশ্রম করে, দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রীকে পাশে রেখে রাতের পর রাত জেগে, ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে আমাদের উপহার দিয়েছেন এক মহামূল্যবান অভিসন্দর্ভ, যা বাংলাদেশ তথা বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি-উত্তর যে শোভন সমাজ গঠিত হওয়া উচিত— সেই শোভন সমাজ বিনির্মাণের অশ্রুতপূর্ব তত্ত্ব।
এ বইটি নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করেছেন দেশ-বিদেশের নামকরা অর্থনীতিবিদ, সমাজচিন্তক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ। করোনাকালে প্রকাশিত কোনো গ্রন্থ নিয়ে এমন আলোচনা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এই বইয়ে তিনি তুলে ধরেছেন করোনাকালে শ্রেণি কাঠামোর বিপজ্জনক পরিবর্তন নিম্নগামিতার কথা, তিন কোটি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের দরিদ্র হওয়ার কথা এবং তিন কোটিরও বেশি মানুষের প্রায় নিঃস্ব হওয়ার কথা।
বিপজ্জনক আয়—বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য, শিক্ষা বৈষম্য ও স্বাস্থ্য বৈষম্য বৃদ্ধির কথাও তিনি এখানে তুলে ধরেছেন এবং কী করণীয় সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট পথ বাতলে দিয়েছেন নীতিনির্ধারকদের জন্য। বিস্তারিত ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণসহ যে পরিসংখ্যান তিনি ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর প্রথমেই করেছিলেন— তাই-ই আজ বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এই বইয়েই তিনি উল্লেখ করেছেন জম্বি করপোরেটদের কথা, যারা সরকারি ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হন। যারা তাদের স্বার্থের পরিপন্থি কোনো কিছুই সহ্য করেন না। রেন্টসিকার, পরজীবী, লুটেরাদের কথাও তিনি স্পষ্টভাষায় তুলে ধরেছেন। করোনাকালে এমন সাহসী গবেষণা অন্য কেউ করেছেন কি না জানা নেই। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জনক ও জ্ঞানজগতের পণ্ডিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি আবুল বারকাতের এ বইটির জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ড. বারকাত মানুষের অধিকারভিত্তিক উন্নয়নসংশ্লিষ্ট অনেক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থের প্রণেতা। অধ্যাপক আবুল বারকাত সম্পাদন করেছেন ৮০০টিরও অধিক মৌলিক গবেষণা কর্ম। এসবের মধ্যে আছে ৪৬টি গবেষণাগ্রন্থ, শতাধিক জার্নাল প্রবন্ধ, প্রায় ২০০ গবেষণা মনোগ্রাফ, এবং ১৩০টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপিত গবেষণাপত্র। তার An Inquiry into Causes and Consequences of Deprivation of Hindu Minorities in Bangladesh through the Vested Property Act: Framework for a Realistic Solution (2000), Political Economy of Land Litigation in Bangladesh: A Case of Colossal National Wastage (ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায়: ২০০৪, ২০০৬), Charland in Bangladesh: Political Economy of Ignored Resources (২০০৭), Political Economy of Khas Land in Bangladesh (বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় প্রকাশিত ২০০১, ২০০৯), Development as Concientization (ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় প্রকাশিত, ২০০৮), Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh: Living with Vested Property (ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায়: ২০০৮,২০০৯), Life and Land of Adibashis: Land Dispossession and Alienation of Adibashis in the Plain Districts of Bangladesh (২০০৯), Social Protection Measures in Bangladesh: As Means to Improve Child Well-being (২০১১), Political Economy of Madrassa Education in Bangladesh: Genesis, Growth, and Impact (২০১১ ইংরেজি ভাষায়, বাংলা ভাষান্তর ২০১৭), Local Governance and Decentralization in Bangladesh Politics and Economics (২০১৫), বঙ্গবন্ধু— সমতা ও সাম্রাজ্যবাদ: বঙ্গবন্ধু ‘বেঁচে থাকলে’ কোথায় পৌঁছতো বাংলাদেশ?
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব-প্রভুত্বের যুগে সমতাবাদী সমাজ বিনির্মাণের সম্ভাব্যতা প্রসঙ্গে (২০১৫), বাংলাদেশে দারিদ্র্যবৈষম্য—অসমতার কারণ—পরিণাম ও উত্তরণ সম্ভাবনা: একীভূত রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বের সন্ধানে (২০১৬), Rural Land Market in Bangladesh: An Exploratory Study (২০১৬), অর্থনীতিশাস্ত্রে দর্শনের দারিদ্র্য (২০১৭); বাংলাদেশে মৌলবাদ: জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির অন্দর—বাহির (২০১৮); উৎপাদন পদ্ধতি: তত্ত্ব, এশিয়াটিক, ইতিহাস রচনায় প্রাসঙ্গিকতা, প্রাক—পুঁজিবাদী চীন, আমেরিকা, বাংলাদেশ (২০১৯); বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে (২০২০); বাংলাদেশের ভূমি আইনের অধিকারভিত্তিক বিশ্লেষণ (১৩ খণ্ডে প্রকাশিত, ২০২০), নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু: জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগ– ২০১২ সালে গবেষণায় প্রমাণিত– ২০২১ সালে দৃশ্যমান বাস্তবতা (২০২১) ইত্যাদি মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ দেশে-বিদেশে সমাদৃত হয়েছে।
সাম্প্রতিক বিষয় এবং দূরাগত পরিণতি সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আবুল বারকাতের অন্তরস্থিত ক্ষমতা তাকে সর্বজনগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। তিনিই এদেশের প্রথম অর্থনীতিবিদ, যিনি খাবার পানিতে আর্সেনিক দূষণের সামাজিক-অর্থনৈতিক অভিঘাত নিয়ে নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, ‘আর্সেনিকোসিস দারিদ্র্যের রোগ।’ তিনি খাবার পানি থেকে আর্সেনিক দূরীকরণে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী বিষ্ময়কর গ্রেইঞ্জার চ্যালেঞ্জ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার (এনএই, যুক্তরাষ্ট্র) প্রাপ্ত ‘সনো ফিল্টার’ আবিষ্কারের সহকর্মী।
তিনিই প্রথম এদেশে মৌলবাদের অর্থনীতি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করেছেন। অন্যত্র তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘বাংলাদেশে নগরায়ণ হচ্ছে আসলে বস্তিয়ায়ন প্রক্রিয়া’, ‘খানায় বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব।’ তিনিই প্রথম গভীর বিশ্লেষণপূর্বক দেখিয়েছেন যে পদ্মা সেতুসহ অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো বিনির্মাণ নিজস্ব অর্থায়নেই সম্ভব।
তার গবেষণা, চিন্তা ও লেখার বিষয়— অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রত্যক্ষ বিনিয়োগসহ বিনিয়োগ আবহ, শিল্প অর্থায়ন, মানব উন্নয়ন এবং নারী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নের অধিকার, জমি-জলা অধিকার, বিশ্বায়ন এবং উন্নয়ন, জ্বালানি—বিদ্যুৎ এবং দারিদ্র্যবিমোচন, জাতীয় বাজেট এবং দারিদ্র্য, দারিদ্র্যের রোগ, কল্যাণ অর্থনীতি, ক্ষুদ্রঋণ এবং উন্নয়নের অধিকার, ভূমিহীনতা এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য, জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ, শিশু দারিদ্র্য, যুব দারিদ্র্য, বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র্য, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য ইত্যাদি।
তিনি প্রতিনিয়ত গভীরভাবে আরও যেসব বিষয়ে গবেষণা করে চলেছেন, তাহলো: উন্নয়ন এবং মানব উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি, উন্নয়ন এবং দারিদ্র্যবিমোচন, ভূমি-পানি-জ্বালানি এবং উন্নয়ন প্রসঙ্গ, মানবাধিকার এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের অধিকার, টেকসই উন্নয়ন বিশ্লেষণ, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মূল্যায়ন এবং বিশ্লেষণ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক ক্ষেত্রে বিশ্লেষণভিত্তিক গবেষণা, উন্নয়নে নারী, আঞ্চলিক জ্বালানি নিরাপত্তা, চেতনায়ন এবং কল্যাণমুখী মানসকাঠামো বিনির্মাণ প্রক্রিয়া, দুর্ভিক্ষ, জনমিতিক বিশ্লেষণ, মানব উন্নয়নে বৈষম্য, বিশ্বায়নের অধীন কৃষি এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, উৎপাদন পদ্ধতি বিতর্ক, বাংলাদেশে আত্মকর্মসংস্থান, বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ ও অভিঘাত, অর্পিত সম্পত্তি আইনের রাজনৈতিক—অর্থনীতি, খাসজমির রাজনৈতিক—অর্থনীতি, মানব বঞ্চনার রাজনৈতিক—অর্থনীতি, ভূমি মামলার রাজনৈতিক—অর্থনীতি, সংবিধান ও উন্নয়ন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ইত্যাদি।
দেশ-বিদেশের অনেক পেশাজীবী সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে আবুল বারকাত সম্পৃক্ত। তিনি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির একটানা চারবার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সমিতির মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইতোমধ্যে তিনবার নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর সমিতির নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। ২০২১ এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নিবার্চিত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন (২০১০-২০১২)। তিনি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (২০১৭-২০২০)। এছাড়াও তিনি Member, Scientific Advisory Board (2021-2030), Transformation, Integration and Globalization Economic Research (TIGER); Chairman of the Board– José Ramos-Horta (1996 Nobel laureate in peace)| জামার্নির লিস্টব্রুক নামক সংস্থার বাংলাদেশের সম্মানিত ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে।
গণমানুষের অর্থনীতিবিদ হিসেবে খ্যাত আবুল বারকাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন প্রথিতযশা অধ্যাপক। ড. বারকাত অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রথাবিরোধী, শেকড়সন্ধানী এবং জনহিতৈষী গবেষণার জন্য একাধিকবার পুরস্কৃত হয়েছেন। অর্থনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণায় অনন্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। পেয়েছেন ইউজিসি (ইউনির্ভাসিটি গ্রান্টস কমিশন) স্বর্ণপদক (২০১৭) ও সামাজিক গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত বিচারপতি ইব্রাহিম স্মারক স্বর্ণপদক (২০০৪-২০০৫) সম্মাননা। অর্থনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণায় অনন্য অবদানের জন্য তিনি ২০০৯ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার পান।
আবুল বারকাত ২০০৯ সালে জনতা ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন। জনতা ব্যাংকে তার সাফল্য অনেক, যার মধ্যে পরিচালন মুনাফা সর্বোচ্চকরণের পাশাপাশি আছে দীর্ঘদিনের অস্থায়ী (ক্যাজুয়াল) কর্মচারীদের স্থায়ীকরণ, করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের দেশব্যাপী সম্প্রসারণ, ভূমিহীন-প্রান্তিক কৃষকদের জন্য স্বল্পমেয়াদি সুদমুক্ত ঋণ ইত্যাদি। তার সময়ে ব্যাংকটি সার্বিক দিক দিয়ে উন্নতি লাভ করে। তা সত্ত্বেও মেয়াদান্তে তাকে অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়। একটি রেন্টসিকার, পরজীবী গোষ্ঠী তাকে জড়িয়ে ভ্রান্ত ও অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে তার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা চালান। কিন্তু তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এসব ভিত্তিহীন প্রচারণার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানান। যে প্রতিবাদের কোনো প্রত্যুত্তর মেলেনি।
আবুল বারকাত হলেন সেই অর্থনীতিবিদ যিনি সর্বদা দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেন এবং তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট। তিনি সাধারণ মানুষের কথা বলেন, তাদের মতোই জীবনযাপন করেন। সেজন্য তিনি গণমানুষের অর্থনীতিবিদ হিসেবে খ্যাত। তিনি অন্তরে ধারণ করে আছেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বির্নিমাণের স্বপ্ন। প্রতি মুহূর্তে তিনি এদেশে বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছেন। মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে তিনি স্বদেশ ও জনগণের কল্যাণে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। তার প্রতিষ্ঠিত আবুল বারকাত পিস অ্যান্ড প্রোগ্রেস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র, কন্যাদায়গ্রস্ত মাতা-পিতা, জটিল রোগে আক্রান্ত ও অন্যান্য মহান উদ্যোগে নীরবে, নিভৃতে সহযোগিতা করে চলেছেন।
দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রিয়তমা পত্নীর অকাল মৃত্যুর পরও তিনি মনোবল হারাননি। এখনো রাতদিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানামতে ১৮ ঘণ্টা কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। সাধারণ খাদ্য দিয়ে দুপুর ও রাতের খাবার খান। রিকশা বা ভাড়ায়চালিত যানবাহনে চলাচল করেন। সাধারণ পোশাক পরেন। অথচ জ্ঞানচর্চার যে ভুবনে (গবেষণাকর্ম) তিনি বিচরণ করেন সেখানে অর্থের কোনো অভাব নেই। কিন্তু অর্থের মোহ তাকে কখনই তার স্থিরকর্তব্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মুজিব জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি এমন একজন অর্থনীতিবিদকে ‘মুজিব স্বর্ণ পদকে’ ভূষিত করায় আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। ভবিষ্যতে এই অনন্যসাধারণ অর্থনীতিবিদকে সরকার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করে তার প্রতি যথাযথ সম্মান জানাবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক : গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস