ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাংলাদেশে কূটনৈতিক যুদ্ধে জিততে অপপ্রচারে পাকিস্তান

ফারাজী আজমল হোসেন | প্রকাশিত: ০৩:৪০ পিএম, ০১ জানুয়ারি ২০২২

১৯৭১ এর আত্মসমর্পণ পশ্চিম পাকিস্তানকে নত হতে বাধ্য করলেও বিদায় হওয়া দ্বিজাতিতত্ত্বের স্বপ্নে বিভোর হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে ঘৃণার মনোভাব বাঁচিয়ে রেখেছিল পাকিস্তান। তারা ভেবেছে পাকিস্তানের একটি শাখা সাময়িকভাবে তাদের নাম বদলেছে। তারা বলেছিল, ‘অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কখনোই টিকতে পারবে না। এজন্য আবার তারা বিনীতভাবে ফিরে আসবে।’ তবে পাকিস্তানের সেই ইচ্ছা আলোর মুখ দেখেনি। বরং স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনে গর্জে উঠেছে বাংলাদেশ। সমগ্র বিশ্ব দেখছে, আর্থসামাজিক, মানবিক সবক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে দেশটি।

বাংলাদেশ এমনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এশিয়ার পরবর্তী অর্থনৈতিক ‘বাঘ’ তারা। বৈদেশিক রিজার্ভ, মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ, গড় আয়ু ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণসহ নানা জায়গায় পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে বহু অগ্রগতি রয়েছে বাংলাদেশের।

২০২১ সালের মার্চে স্বাধীনতার ৫০তম বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লেখেন ইমরান খান। তিনি বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ককে গভীরভাবে মূল্য দেয়।

কিন্তু সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য অতীতের বিধে থাকা কাঁটা দূর করতে হবে। কোনো জাতিই তার অন্ধকার অতীতকে মোকাবিলা না করে এগিয়ে যেতে পারে না। পাকিস্তানের জাতিগত ভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি আজও হয়ে ওঠেনি।

আগেও পাকিস্তানের বহু প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশকে নানাভাবে বিব্রত করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হলে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সংসদে রেজ্যুলিউশন নেয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনা ২০০৯ এ দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলে পাকিস্তান-বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। কারণ পাকিস্তান সবসময় ১৯৭৪-এর বন্দিবিনিময়ের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিকে উল্লেখ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘটনা তখনই শেষ হয়ে গেছে বলে দাবি করে।

একদিকে পাকিস্তান দেখাচ্ছে তারা শান্তি চায়। কিন্তু অন্যদিকে মিডিয়ার মাধ্যমে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) সার্ভিসের কট্টরবাদী কর্মীরা। এর মধ্যে টিভিতে এমন অপপ্রচারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মারিয়া জাদুন। সত্যি কথা হলো এ ষড়যন্ত্রের শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা যুক্ত হয় বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার সময় থেকেই। এটা নিশ্চিত যে, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ তার পুরো পরিবারে যে গণহত্যা চালানো হয় তাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী-আইএসআই এবং বাংলাদেশে তাদের সহযোগীরাই জড়িত ছিল। এর আগেই ইসলামাবাদে এমন একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

থিংক ট্যাংক ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজভিত্তিক’ যে আলোচনা শুরু হয়েছে তাতে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীকে যুক্ত করে পাকিস্তান এটা বুঝতে পেরেছে যে, ‘অতীত ভুলের ক্ষমা চাওয়া কতোটা প্রাসঙ্গিক।’

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে পাকিস্তান আইএসআই ৯ নভেম্বর পাকিস্তান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ কনফারেন্সের প্রথম সংস্করণ আয়োজন করে। এরপর ১৯ নভেম্বর ২০২১-এ নিজস্ব বর্ণনায় ‘খেল খেল মে’ নামে একটি সিনেমা মুক্তি দেয়া হয়। এতে ফিজার প্রযোজনা, আলী মীরজা ও নাবিল কোরেশি পরিচালিত ছবিটি ১৯৭১-এর যুদ্ধকালীন তরুণ প্রজন্ম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঘিরে। যারা যুদ্ধের লুকানো ভয়াবহতাকে চ্যালেঞ্জ করে রাষ্ট্রের বিবরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

আবার এই ব্যর্থ চেষ্টার বাইরে ১৯৭১-কে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে চালানো হয় আরেক প্রচেষ্টাও। গত ১২ ডিসেম্বর প্রকাশ করা পাকিস্তানি সিরিজ ‘জো বিছার গ্যায়ে’তে মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করে পাকিস্তানি সেনাদের ধার্মিক হিসেবে দেখানো হয়। স্বাধীনতার মাসে সাধারণ বাংলাদেশিদের অনুভূতির সঙ্গে প্রতারণা করে পাকিস্তানে আরেকটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে যার নাম ‘পাকিস্তান: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’। ইভিলিউশন মিডিয়া প্রযোজনা ও জাভেদ জব্বারের নির্বাহী প্রযোজনায় নির্মিত তথ্যচিত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে, অতীতে কিছু বিষয় অতিমাত্রায় উপস্থাপন করা হয়েছে। আবার যেভাবে বাংলাদেশের পাকিস্তানের নির্যাতনের কথা বলা হচ্ছে তাও সঠিক নয়।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সময়ে নভেম্বর-ডিসেম্বরে পাকিস্তান ক্রিকেট দল বাংলাদেশে সফর করে। এ সময় অনুশীলনে পতাকা টাঙিয়ে দেওয়াকে জাতীয় চেতনার ওপর আঘাত হিসেবে নেয় অনেকেই। সুশীল সমাজ এ ঘটনার নিন্দা জানায়।

চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক ক্রিকেট সিরিজের তিক্ত পরাজয় ও পাকিস্তান সমর্থকদের প্রতিরোধের কথা ভুলে পাকিস্তান এখন ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় পাকিস্তান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ কনফারেন্সের দ্বিতীয় সংস্করণের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

বেশিরভাগ জাতি ভবিষ্যতে এগিয়ে যেতে তার গৌরবের চেয়ে দুর্যোগের সময়গুলো মনে রেখে শিক্ষা নেয়। পাকিস্তানের জাতীয় দুর্যোগের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বৈশিষ্ট্য অন্যতম শিক্ষণীয় দেশটির জন্য। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ ভারত ও বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডারের আত্মসমর্পণের ঘটনায় পাকিস্তান তার অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা, এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড ও প্রচুর অর্থ-সম্পত্তি হারায়। কিন্তু বেশিরভাগ পাকিস্তানি সেই দিনটিকে মনে রাখা ও শিক্ষা নেওয়ার চেয়ে ভুলেই যেতে চায়।

পরাজয়ের পরপরই বিস্মিত হয়েছিল পাকিস্তান। এজন্য বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনের ঘটনা জানতো না পুরো দেশবাসী। সেজন্য পরে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে কমিশন যে বিস্তৃত প্রতিবেদন করেছিল তা আজও প্রকাশ করা হয়নি। কমিশনের প্রতিবেদন কিছুটা প্রকাশ পায় প্রায় ৩ দশক পর। সেটা নিয়ে পাকিস্তানি মিডিয়ায় সমালোচনা শুরু হয়। হামুদুর কমিশনের রিপোর্টে, রাজনীতিবিদদের স্বার্থপর ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। যারা ব্যক্তিগত লাভের জন্য দেশের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলেছিল। তারচেয়েও বেশি সমালোচনা করা হয় সেনাবাহিনীর। সে সময়ের রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার সহযোগীদের দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

পাকিস্তানকে বিশ্বাস করা যায় না বুঝতে পেরে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে ওআইসির বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিতে ইসলামাবাদে ১৯ ডিসেম্বর পূর্বনির্ধারিত সফর বাতিল করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তার এ যাত্রা শেখ হাসিনার শাসনামলে গত নয় বছরে প্রথম কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর হতো।

সাম্প্রতিক সময়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশীর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একই বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দ্বিপাক্ষিক সফরের ঘটনা। ২০২১ এ ভারত থেকে অন্তত ১১-১২টি দ্বিপক্ষীয় সফর করা হয়। কোভিড-পরবর্তী প্রথম সফরে ১৫-১৭ ডিসেম্বর ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কেবিন্দ বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘ভারতের প্রতিবেশী নীতিতে বাংলাদেশ একটি বিশেষ জায়গায় রয়েছে।’ রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উন্নয়ন অংশীদারত্ব সবচেয়ে বেশি। একই সময়ে আমাদের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করারও সুযোগ সবচেয়ে বেশি রয়েছে।’

৫০ বছর আগে ভাষা, আত্মীয়তা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক নীতির সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল, যা এখনো চলমান।

লেখক: কলামিস্ট ও সিনিয়র সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম/ফারুক