ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সত্যে ফিরতে হবে আমাদের

ড. মাহবুব হাসান | প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২১

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা পরাধীন হয়ে আছে। এ-কথা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান এর। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন, বাংলাদেশ আয়োজিত বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২১তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে তিনি এ-কথা বলেন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান-এর মতো একজন অর্থনীতিবিদ যখন এ-কথা বলেন, তখন এর সত্যতাকে সরকার ও সরকারি দলের পক্ষে অস্বীকার করে কিছু বলার উপায় থাকে না। তার মানে সরকার রেহমান সোবহানের বক্তব্যকে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। শুধু রেহমান সোবহানই নয়, যারা সরকারি দলের প্রতি নমনীয় এবং তাদের রাজনৈতিক সহযোগী, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদ, সত্য প্রকাশ করতে না পারলেও ব্যক্তিগতভাবে এটা স্বীকার করবেন যে দেশে আইনের শাসন যেমন নেই তেমনি গণতন্ত্রও তিরোহিত।

অর্থনীতি হতদরিদ্রশ্রেণির সম্পদ লুট করে সম্পদশালী হয়ে ওঠা লুটেরা ব্যবসায়ীদের হাতে শোষিত হচ্ছে। আর সমাজ ব্যবস্থা ঔপনিবেশিক আমলের মতোই একই প্যাটার্নের নিগড়ে বন্দী। সমাজ রাজনৈতিকভাবে অগ্রসরতা পেলেও সামাজিক ন্যায় বিচার ও সামাজিক কল্যাণ করে এমন কোনো চেতনায় পরিবর্তিত হয়নি বা তা করার জন্য যে রাজনৈতিক অভিস্পা ও উদ্যোগ রাষ্ট্র তরফ থেকে নেয়া দরকার ছিল, তার ছিঁটে-ফোটাও পরিলক্ষিত হয়নি।

কেন এমনটা হলো? তার কি কি কারণ, সে সব বিষয়েও উল্লেখ করার মতো গবেষণা হয়েছে বলে মনে হয় না। আবার সে রকম দু’চারটি গবেষণা হয়ে থাকলেও রাষ্ট্রযন্ত্রে ও সরকারি প্রশাসনে তার কোনো ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে হয়নি। হলে, রেহমান সোবহানের মতো প্রজ্ঞাবান অর্থনীতিক এই সত্য উচ্চারণ করতেন না। তিনি দলীয় অর্থনীতিক না হলেও বিরোধী পক্ষের কেউ নন।

আমরা তো ভুলে যাইনি যে গত শতকের ছয়-এর দশকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা বিনির্মাণের তিনিও এক কারিগর। তার চৈতন্য জুড়েই ছিল বাংলাদেশ ও তার রাজনৈতক সমাজের মূল্যায়ন ও পুনর্গঠন কল্পনা। সেই কল্পনায় ছিল প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির রূপরেখা।

আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনায় যেমন সামাজিক ন্যায় ও রাষ্ট্রীয় ন্যায়, সমতা ও অধিকার কায়েমের বিষয়টি করতে বলেছিলাম তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে, তেমনি সেই দাবির আলোকেই রচিত হয়েছিল আমাদের সংবিধান। সেই সংবিধানের আলোকেই আমাদের দেশ শাসিত হবে, মানুষের সার্বিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে— এটাই তো সত্যের আসল স্বরূপ। কিন্তু তা হয়নি। এ-জন্য আজ ৫০ বছর পর অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে বলতে হচ্ছে গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা পরাধীন।

গণতন্ত্রের কথা আমরা বলবো এ-কারণে যে এই ধনবাদি গণতন্ত্রের নর্মস এমনই যে তা একটা বাস্তবায়ন করলে অন্যটাও করতে হবে, নইলে তা পূর্ণতা পাবে না, পায় না। কান টানলে মাথা আসে- এই কথারই অনুরণন আছে এখানে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়নি বা করেনি সরকারগুলো, তাই অর্থনীতি স্বাবলম্বী হয়নি, হতে পারেনি।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়নি তাই সমাজ কাঠামোরও বিবর্তন ঘটেনি বা ঘটতে দেয়া হয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি জাতীয় জীবনে, জাতীয় রাজনীতিতে, রাজনৈতিক দলে, রাজনৈতিক সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোতে, শিক্ষা কারিকুলামে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়া হয়নি বলে নৈতিক চরিত্রেরও উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ঘটেনি।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি বা করা হয়নি বলেই সব ক্ষেত্রেই অনৈতিকতার রমরমা চলছে। অবৈধ হলেও তাকেই বৈধ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন রাজনৈতিক সরকার। গণতন্ত্র এই সব নৈতিক ও অবৈধতার সেইফ গার্ড। বিষয়টা সম্পর্কযুক্ত, তাই একটা প্রতিষ্ঠা না পেলে পরেরগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় না।

এ-সবই আমাদের রাজনৈতিক নেতারা ভালোভাবেই বোঝেন, কিন্তু নিজেদের গোষ্ঠীগত স্বার্থরক্ষার খাতিরে গণতন্ত্রকেই আস্তাকুঁড়ে ফেলে রেখেছেন তারা। আবার যখনই গণতন্ত্রের দরকার পড়ে, বিরোধী দলের আসনে বসলেই তাদের প্রয়োজন পড়ে ন্যায়, কল্যাণ,সমাজিক ও রাজনৈতিক ন্যায়পরায়ণতা, তখন তারা গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক মাঠ গরম করেন।

বিএনপি এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে খাটছে। কারণ ওই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা গণতন্ত্রই কেবল তাদের রাজনৈতিক অসুবিধাগুলো দূর করতে পারে। আবার যখনই তারা ক্ষমতার মসনদে ঢুকবেন, অমনিই বদলে যাবে তাদের চেহারা। ঠিক একই চেহারা আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগের। ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় তারাও গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক মাঠ-ঘাট গরম করে তুলেছিল। আজ যখন বিএনপি গণতন্ত্রের কথা বলে, ন্যায় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে তখন তাদের ঠোঁটে বাঁকা হাসির রেখা দেখা যায়।

গণতন্ত্রের বর্তমান চেহারা এমনটাই। এই চেহারার কোনো বিবর্তন নেই, পরিবর্তন নেই, এই ছবিই আমরা ৫০ বছর ধরে বহন করে চলেছি, যা মিথ্যায় মতোই রাজনৈতিক সত্য। রাজনীতি যে এখন মিথ্যারই বর্ণাঢ্য উপকরণ, সেটা না বললে হবে না। সত্য আমাদের বলতে হবে। কারণ আমরা গণতান্ত্রিক সত্যে বসবাস করতে চাই। অধ্যাপক রেহমান সোবহান সে-কথাই বলেছেন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরো বলেছেন, এখনো আমরা অন্যায্য সরকার ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি। শাসন পদ্ধতি ন্যায়সঙ্গত নয়। পুরো ব্যবস্থায় একটি অন্যায্য সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিতেও তা প্রকট।

দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চিত্র ফুটে উঠেছে এ-কটি পঙক্তিতে। যে সরকারের ন্যায্যতা নেই, সেই সরকারের অধীনেই আমরা রয়েছি। এখনো মানে বর্তমান সরকার যে অন্যায্য সরকার, যাদের কোনো ভিত্তি নেই, বলতে বুঝিয়েছেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। শাসন পদ্ধতি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে না। পুরো ব্যবস্থায় একটি অন্যায্য সংস্কৃতি যে কথা বলেছেন আসলে তা আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক দুর্বৃত্তায়নের সংস্কৃতির কথাই বলেছেন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহানের কথাগুলো আপদমস্তক সত্য, কিন্তু সেই সত্য কে মানবে? মানার কথা সরকারে যারা আছেন, তাদের। তাদের তো লজ্জিত হবারই কথা।

অন্ধ ক্ষমতার রাজনীতি তাদের রাজনৈতিক মগজকে কলাপস করে রেখেছে। আজ তারা গণতন্ত্র নয় নিজেদের উন্নয়ন আর রাজনৈতিক সরকারের তোষণই তাদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। আমরা ঢাকা মহানগরের উন্নয়ন অবকাঠামো দেখতে পাচ্ছি, তার সুবিধাও পরম আনন্দে উপভোগ করছি। আর ভুলে থাকছি ঢাকা মহানগরই কেবল বাংলাদেশ নয়, এর বাইরে ৮৫ হাজার গ্রামও আছে। সেখানে ১৫ কোটি মানুষের বাস।

ধরা যাক সেখানে ১২/১৩ কোটি মানুষের বাস। বিভাগীয় ও জেলা শহরের মানুষদের বাদ দিলে ১৩ কোটি মানুষের জন্য তো দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন আমরা দেখছি না। উন্নয়নকে ওই প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। এটাই সরকারের দায়। তা করতে পারলে হবে না কিছুই। গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন সার্বিক স্তরে পৌঁছে না। এই সত্য মানুষ। এই সত্য প্রতিষ্ঠা করুন। সেই সত্য-কল্যাণের জন্যই সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে জীবন দান করে স্বাধীনতা এনেছেন। আমরা চাই সেই জীবনদানকারীদের লক্ষ্যপূরণে সত্যে ফেরা হোক।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম