ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নৌ দুর্ঘটনা: যে জলে আগুন জ্বলে

এরশাদুল আলম প্রিন্স | প্রকাশিত: ১১:৫৭ এএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০২১

ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ নামে একটি লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়। আরও অনেকে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। লঞ্চে এরকম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নজিরবিহীনই বলা চলে। এর আগে লঞ্চে এমন আগুন লাগার ঘটনা কদাচিত ঘটেছে। দুর্ঘটনা ঘটলেও তাতে প্রাণহানি হয়নি।

দুর্ঘটনা কারণ এখনও পরিষ্কার না। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয় যে গ্যাস সিলিন্ডার থেকেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। খাবারের হোটেলের জন্য ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েই এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তবে, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে তখন আসল কারণ জানা যাবে।

খাবার হোটেলে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার হয় এটা আমরা জানি। কোনো যানবাহনে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার খুবই বিপজ্জনক। এর হয়তো কোনো বিকল্পও নেই। কেরোসিন ব্যবহারও বিপজ্জনক। সবই দাহ্য পদার্থ। এছাড়া লঞ্চের ইঞ্জিন রুমেও অনেক দাহ্য পদার্থ মজুদ থাকে। কোনো কারণে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়াই স্বাভাবিক। আর অগ্নিকাণ্ডের সূচনা যদি ইঞ্চিন রুমের কাছে হয়তো তবে তা ছড়িয়ে পড়া আরও স্বাভাবিক।

এখনকার বড় বড় বিলাসবহুল লঞ্চগুলোতে খাবার হোটেল সাধারণত ইঞ্জিনরুম থেকে দূরেই হয়ে থাকে। কিন্তু আগের লঞ্চগুলোতে ইঞ্জিনরুমের পাশেই খাবার হোটেলগুলো থাকতো। এখনও যারা পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ বা মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটে লঞ্চে নদী পার হন তারা দেখে থাকবেন যে নিচ তলায় ইঞ্জিনরুমের পাশেই রয়েছে খাবার হোটেল। কেরোসিন বা গ্যাসের চুলা দিয়ে সেখানেই রান্না, সেখানেই খাওয়া। খাবার হোটেল থাকায় সেখানে যাত্রীসমাগমও বেশি হয়ে থাকে। অথচ ইঞ্জিনরুমের এরিয়াটি সংরক্ষিত থাকার কথা। আমাদের দেশের কয়টি লঞ্চের ইঞ্জিনরুম এরিয়া সংরক্ষিত তা নিয়ে প্রশ্ন করাই যেতে পারে। এ অগ্নিকাণ্ডের প্রাথমিক তথ্য বিবরণে জানা যায়, ইঞ্জিনরুমের পাশেই ছিল খাবার হোটেল, সেখানেই গ্যাস সিলিন্ডার। দেখা যাক, তদন্ত প্রতিবেদন কী বলে।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী লঞ্চটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল বলে জানিয়েছেন। কী সেই ত্রুটি তা এখনও জানা যায়নি। সেই যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য হয়তো এ দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে লঞ্চের এ যান্ত্রিক ত্রুটিটি যদি স্বাভাবিক বা নিয়মিত ত্রুটি হয়ে থাকে সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু অনিয়মিত ত্রুটি থাকলে লঞ্চের ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এ বিষয়টিও তদন্ত প্রতিবেদনে পরিষ্কার হবে।

ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য নৌপথই সবচেয়ে জনপ্রিয়। বিশেষ করে, ঢাকা থেকে ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালি, ঝালকাঠি রুটে লঞ্চই প্রধান বাহন। এসব রুটে এখন বিলাসবহুল লঞ্চ চলাচল করে। বিশেষ করে, ঢাকা-বরিশাল রুটে বিলাসবহুল লঞ্চের প্রতিযোগিতা চলে। কদিন পরই একেক কোম্পানি নতুন নতুন লঞ্চ চালু করে। গণমাধ্যমে সেসব খবর চাউর হয়। এসবই আনন্দের কথা। কিন্তু বিলাসবহুল লঞ্চের পেছনে লঞ্চের বা যাত্রী নিরাপত্তার কথাটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চাপা পড়ে যায়। এটি বিপজ্জনক।

এসব বিলাসবহুল লঞ্চে আমারও যাতায়াতের সুযোগ হয়েছে। কিন্তু, স্বীকার করছি, এসব লঞ্চে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন সেটি কখনো ভেবে দেখিনি। কোন লঞ্চ কতটা বিলাসবহুল বা সুযোগ সুবিধা বেশি সেটিই যাচাই করেছি, কিন্তু সাধারণ নিরাপত্তার বিষয়টিও কখনো ভেবে দেখা হয়নি। সাধারণ যাত্রীরাও এটিই বিবেচনা করে থাকেন। এসব লঞ্চে যাত্রীনিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুলই বলতে হবে। কদাচিত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র চোখে পড়বে। থাকলেও সেটি যাত্রীদের হাতের নাগালের মধ্যে নয়। ক’টি লঞ্চে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, ফায়ার বাকেট, বালুবাহী বালতি, ফায়ার সেফটি অ্যালার্ম রয়েছে সেটি একটি প্রশ্ন। কোনো লঞ্চেই পর্যাপ্ত লাইফ জাকেট নেই। এগুলো সবই নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জলযান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা হয়তো ত্রুটিগুলো আরও বেশি ধরিয়ে দিতে পারবেন। এরকম আরও অসংখ্য ত্রুটি নিয়েই ‘অত্যাধুনিক বিলাসবহুল’ লঞ্চগুলো চলাচল করে।

সংকট শুধু সরঞ্জামের নয়, প্রশিক্ষণেরও। নৌপরিবহন কর্মীদের জন্য প্যাসেঞ্জার শিপ এনডোর্সমেন্ট কোর্স, সেফটি ড্রিল, মাস্টার ড্রিল ইত্যাদি নানা প্রশিক্ষণ রয়েছে। এসব প্রশিক্ষণ যাদের জন্য তারা কি বাংলাদেশের কোনো লঞ্চে চাকরি করছেন? বিলাসবহুল লঞ্চ মানেই নিরাপদ ভ্রমণ নয়। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশেষ করে নৌ যোগাযোগে নিরাপদ ভ্রমণের বিষয়টি এখনও অগ্রাধিকার পায়নি। শুধু লঞ্চ ডুবে গেলে লঞ্চের ফিটনেস নিয়ে আমরা কথা বলি। কিন্তু ভেসে থাকাই যে শেষ কথা নয় তা জলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে মৃত মানুষগুলো প্রমাণ করে গেলো। অব্যবস্থাপনা থাকলে শুধু আগুনে নয় জলেও পুড়তে হয়।

আমরা সড়ক নিরাপত্তার কথা বলি। অথচ নৌ নিরাপত্তা নিয়ে আমরা চুপ। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে দু’চারদিন কথা হয়, কলাম হয়, টকশো হয়। পরে যা তাই। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলছে। অনেক লঞ্চে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা থাকলেও তা ত্রুটিপূর্ণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ। কমপ্লায়েন্সের জন্য হয়তো কয়েকটি নির্বাপণযন্ত্র বসানো হয়। এসব যাদের দেখার কথা তারা সবই জানেন। কোন্ লঞ্চের কী হাল তা কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। কিন্তু তারপরও দিনের পর দিন এসব নৌযান ত্রুটিপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই বিলাসবহুল ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে, নিরাপদ ভ্রমণের তকমা লাগিয়ে নৌপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এবং তা কর্তৃপক্ষের গোচরেই।

বিমানে সাধারণত যাত্রীদের কিছু সাধারণ নিরাপত্তা নির্দেশনা দেওয়া হয়। দুর্ঘটনা ঘটলে যাত্রীদের করণীয় কী তা বলা হয়। কিন্তু এতো বড় ও বিলাসবহুল লঞ্চে যাত্রীদের কোনো নিরাপত্তা নির্দেশনা দেওয়া হয় না। লাইভ ভেস্ট ব্যবহারবিধি তো শুধু বিমানে নয়, লঞ্চেও প্রয়োজন। জরুরি বহির্গমনতো শুধু বিমানে নয়, লঞ্চেও লাগতে পারে। একেকটি নৌ দুর্ঘটনার পরও এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের কোনো লঞ্চেই আজঅবধি দেখা যায় না। এতো প্রাণহানি, এতো মৃত্যুর পরও নৌপরিবহনে বিলাসবহুল লঞ্চ ছাড়া আর কিছুই সংযোজিত হয়নি। প্রত্যেকটি লঞ্চে যাত্রীদের স্বাভাবিক নিরাপত্তা নির্দেশনা দেওয়ার রেওয়াজ অতি দ্রুত চালু করা প্রয়োজন। আগুন লাগলে শুধু নির্বাপণ যন্ত্র থাকলেই চলবে না, তা ব্যবহার করতেও জানতে হবে। যাত্রীরাতো অনেক পরের কথা, লঞ্চের স্টাফরাও বেশিরভাগই এসব ব্যবহার করতে জানেন না। কারণ, সেই প্রশিক্ষণই তাদের দেওয়া হয়নি। মাঝে মাঝে ড্রিল করতে হয়। লঞ্চের স্টাফরা মাঝে মাঝে তো পরের কথা, জীবনে একবারও ড্রিল করেছেন কিনা সন্দেহ। এসবই নৌপরিবহনে সাধারণ নিরাপত্তা ত্রুটি। কর্তৃপক্ষকে এসব নিয়ে কথা বলতে হবে, কাজ করতে হবে।

নৌপরিবহন খাতে নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)। তারা তাদের দায়িত্বটি ঠিকভাবে পালন করলে অনেক অব্যবস্থাপনাগত ত্রুটিই দূর হতো। নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে নৌপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরে আসতো। এছাড়া নৌপরিবহনে সার্ভেয়াররা আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করলে নিরাপত্তার বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতো। কাজেই, সার্বিকভাবে বিআইডব্লিউটিএ-কেই এগিয়ে আসতেই হবে। এ দুর্ঘটনার দায় থেকে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ বলি বা নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বলি কেউ দায়মুক্ত নয়। কার দায় কম বা বেশি তদন্তের পর হয়তো সেটি জানা যাবে।

এ অগ্নিকাণ্ডকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা যেতেই পারে। কিন্তু এ দুর্ঘটনা নৌপরিবহন খাতে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনারই একটি অংশ। কাজেই, বিদ্যমান অবস্থাপনা থেকে একে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। পুরো ব্যবস্থাটাই যখন ত্রুটিপূর্ণ হয় তখন ওষুধ দেবো কোথা- এ প্রশ্ন আসতেই পারে। একেকটি দুর্ঘটনা ঘটলে তখন আমরা সেটি নিয়ে কথা বলি। এগুলো সবই আসল রোগের লক্ষণ বা আলামত। রোগের কারণ নয়। আসল কারণ ওই অব্যবস্থাপনায়। সেখানে হাত দিতে হবে। ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকলে জলেও আগুন লাগতে পারে, আগুনেও ডুবে যেতে পারে মানুষের জীবন।

লেখক : আইনজীবী ও কলাম লেখক।

এইচআর/এমএস