ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বড়দিন থেকে আমরা যেন শিক্ষাগ্রহণ করি

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০২১

প্রফেসর এডওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ

শুভ বড়দিনের প্রীতি ও শুভেচ্ছা! আজ ঈসা মসিহের জন্মদিন। ঈসা মসিহের জন্মের সময় বাদশাহ হেরোদের ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী শিক্ষা নিতে পারেন। ইনজিল শরিফের মধ্যে মথি সুখবরের ২ রুকু ১-৯ আয়াতে এ ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে। বাদশাহ হেরোদ রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে গালিল অঞ্চলের শাসক ছিলেন। বাদশাহ হেরোদ তার নিজ ভাই ফিলিপের স্ত্রী হেরোদিয়ার সাথে ব্যভিচার ও গুনাহ করেছিলেন বলে হজরত ইয়াহিয়া সরাসরি তুলে ধরেছিলেন। পরে হেরোদ ইয়াহিয়াকে কারাগারে বদ্ধ করে রেখেছিলেন। হেরোদিয়ার আগের ঘরের মেয়ে হেরোদের জন্ম দিনে নেচে হেরোদকে খুব সন্তুষ্ট করেছিলেন। হেরোদ সে মেয়েকে যা চান, তা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। আর সে মেয়ে তার মা হেরোদিয়ার চক্রান্তে হজরত ইয়াহিয়ার মাথা চেয়েছিলেন। অবশ্য হেরোদ না চাইলেও তার প্রতিজ্ঞার কারণে কারাগারে থাকা ইয়াহিয়ার মাথা কেটে সে মেয়েকে উপহার দিয়েছিলেন (ইনজিল শরিফ মথি ১৪ রুকু ১-১২ আয়াত)।

হজরত ইয়াহিয়াকে হেরোদ এতই ভয় করতেন যে, হজরত ঈসাকে হেরোদ হজরত ইয়াহিয়ার রূহ বা পুনরাগমন বলে মনে করতেন। হেরোদের মতো যে কেউ গুনাহ করে বা কোনো অন্যায় করে, তার মধ্যে সত্যতা ও ন্যায্যতার ভয় রয়েছে। সৎ ও ধার্মিক লোকদের কোনো ভয় নেই। অন্যায় ও জুলুমকারীরা ভয়ের মধ্যে থাকে। সেজন্য সৎ লোকদের দাঁড়ানো দরকার। এ হেরোদ হজরত ঈসা মসিহের জন্মের কথা শুনে বিচলিত হয়েছিলেন। এহুদিয়ার বেথলেহেমে হজরত ঈসা মসিহের জন্ম হয়েছে। পূর্বদেশ থেকে পণ্ডিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আকাশের তারা দেখে যিরূশালেমে এসেছেন বনি ইসরাইলদের বাদশাহ সে ঈসা মসিহকে খুঁজতে ও তাকে প্রণিপাত করতে। বাদশাহ হেরোদ যখন শুনতে পেলেন বনি ইসরায়েলদের বাদশাহের জন্ম হয়েছে। তার সিংহাসন কেঁপে উঠেছিল। তিনি ভুলভাবে চিন্তা করলেন যে, তার রাজত্ব শেষ হতে চলেছে। তিনি পণ্ডিতদের গোপনে ডাকলেন ও ষড়যন্ত্র করলেন। তিনি তাদের বেথলেহেমে প্রেরণ করে বললেন, ‘তোমরা গিয়ে বিশেষ করে সেই শিশুর অন্বেষণ কর; দেখা পেলে আমাকে সংবাদ দিও, যেন আমিও গিয়ে তাকে প্রণাম করতে পারি।’

পণ্ডিতদের সে তারাটি পথ দেখিয়ে ঈসা মসিহ যেখানে ছিলেন সে ঘরে নিয়ে গেল। পণ্ডিতেরা তাকে স্বর্ণ, কুন্দুরু ও গন্ধরস উপহার দিলেন। তারা স্বপ্নে এ আদেশ পেয়ে বাদশাহ হেরোদের সাথে দেখা না করে অন্য পথ দিয়ে নিজেদের দেশে চলে গেলেন (ইনজিল শরিফ মথি ২ রুকু ১৩-১৬ আয়াত)। ঈসা মসিহের উদ্দেশ্যে হেরোদ ও তার রাজত্বকে ধ্বংস করা ছিল না। অথচ হেরোদ ভুল চিন্তা করেছিলেন এবং ঈসাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। পরে প্রভুর এক দূত ইউসুফকে স্বপ্নে বলে দিলেন যেন, শিশু ঈসা ও মরিয়মকে নিয়ে সে রাত্রিতেই মিশরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কারণ হেরোদ ঈসা মসিহকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবে। ইউসুফ ও মরিয়ম শিশু ঈসাকে নিয়ে হেরোদের মৃত্যু পর্যন্ত মিশরেই থাকলেন। পণ্ডিতদের দ্বারা হেরোদ তুচ্ছীকৃত হয়েছেন বুঝতে পেরে বেথলেহেম ও পার্শ্ববর্তী এলাকার দুই বছর ও তার ছোট বয়সী সব বালককে হত্যা করালেন। আর সব অঞ্চলে রোদন ও হাহাকার উঠেছিল (ইনজিল শরিফ ২ রুকু ১৬-১৮ আয়াত)। রোমান ইতিহাসের এক জঘন্য ও ঘৃণ্য অপরাধ সে সময়ে ঘটেছিল। এ ধরনের ঘটনা হজরত মুসার জন্মের সময়ে মিশরের বাদশাহ ফেরাউনের সময়েও বনি ইসরাইলের সব ছেলে-সন্তানকে জন্মের সময়ই মেরে ফেলার আদেশ হয়েছিল। অবশ্য আল্লাহ সে আদেশ কার্যকর হতে দেননি (তাওরাত শরিফ হিজরত ১ রুকু ১৫-১৮ আয়াত)। ইউসুফ ও মরিয়ম আল্লাহর কথামতো মিশরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ তখনও আল্লাহর পরিকল্পনা মতো ঈসা মসিহের কাজের সময় হয়নি। নির্যাতিত, অবজ্ঞাত ও তুচ্ছীকৃত বহু সৎ ও ভালো লোক সমাজে থাকতে চায় না। কারণ সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা দিতে পারে না। যারা রক্ষা করবে, তারা নির্ভরযোগ্য নয়। যখন সমাজে অরাজকতা ও অনৈতিকতা বেড়ে চলে, তখন অনেক ভালো লোক চুপ মেরে যায়, কথা বলে না। তাদের ভয় হয়, উচিত কথা বলে তারা আক্রমণের মুখে পড়বে। কিন্তু আল্লাহ তার প্রিয় লোকদের হেফাজত করেন।

কেন হেরোদ এহুদিয়ার সব ছেলে-সন্তানকে হত্যা করেছিল? পূর্বদেশের পণ্ডিতরা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ঈসা মসিহ হচ্ছেন বনি ইসরাইলদের বাদশাহ। হেরোদ ঈসা মসিহকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিয়েছেন। হেরোদ ঈসা মসিহকে শিশু অবস্থায়ই হত্যা করতে চেয়েছিলেন। তিনি কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাননি। শত্রুকে হত্যা করতে পারলে তার সিংহাসন টিকে থাকবে। তিনি বোঝেননি যে, হত্যা করায়ই সমাধান নয়। মৃত্যু কোনো সমাধান নয়। মৃত্যু সম্পর্কে যাদের ভুল ধারণা রয়েছে, তারা এমন চিন্তা করতে পারে। মৃত্যুতে সবকিছুর শেষ নয়। অনেক ক্ষেত্রে মৃত কেউ জীবিত থাকার চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। হেরোদ তা বুঝতে পারেননি, যেভাবে আমাদের সমাজেরও অনেকে বুঝতে পারে না।

এমনকি অপরাধীদের বিনা বিচারে হত্যা করাতেও কোনো সমাধান নেই। সংঘাতে কোনো উপকার নেই। সমাজে আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে যেন, আমরা শত্রুকে ভালোবাসি, নিরাপত্তা দিই ও তাদের সাথে মিশি। তাহলেই সবার উপকার হবে। যে ঈসা মসিহকে হেরোদ শত্রু মনে করে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, সেই ঈসা মসিহের শিক্ষা হচ্ছে শত্রুকে প্রেম করা। হেরোদের টার্গেট ছিল ঈসা মসিহকে হত্যা করা। কিন্তু তাকে না পেয়ে সব শিশুকে হত্যা করেছিলেন। কোনো লাভ হয়নি। ঈসা মসিহ নিরাপদেই থাকলেন। আল্লাহ যাকে রক্ষা করতে মনস্থ করেন, তাকে কেউ ধ্বংস করতে পারে না। আর হেরোদ আল্লাহর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কাজ করলেন। বহু নিরপরাধ শিশুকে তিনি হত্যা করলেন। এ হেরোদ মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে কাজ করছিলেন। নিজেকে এমনকি আল্লাহর চেয়েও বড় মনে করছিলেন।

পাক কিতাবে লেখা আছে, ‘তখন এক নিরূপিত দিনে হেরোদ রাজবস্ত্র পরিধানপূর্বক সিংহাসনে বসে তাদের কাছে উচ্চৈঃস্বরে বলতে লাগলেন, এ দেবতার রব, মানুষের নয়। আর প্রভুর এক দূত তখনই তাকে আঘাত করলেন, কেননা তিনি আল্লাহকে গৌরব প্রদান করলেন না; আর তিনি কীটভক্ষিত হয়ে প্রাণত্যাগ করলেন’ (ইনজিল শরিফ প্রেরিত ১২ রুকু ২১-২৩ আয়াত)। আমাদের নিজের সার্থকতা ও সফলতার চেয়ে আল্লাহর পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্যকে বড় করে দেখতে হবে। নিজেকে যেমন প্রেম করব, তেমনি অন্যকেও প্রেম করতে হবে। তা না হলে যদি আমাদের স্বার্থপর ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ টিকে থাকার পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ না নেয়, তাহলে আমরা নিজেরা নিজেদের হারাব।

আসলেই কি ঈসা মসিহ বনি ইসরাইলের বাদশাহ ছিলেন? ইনজিল শরিফ মতে, হজরত ঈসা তেত্রিশ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। ঈসা মসিহকে যখন বনি ইসরাইলরা গ্রেফতার করে এহুদিয়ার গভর্নর পিলাতের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন পিলাত তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কি ইহুদিদের বাদশাহ?’ ঈসা মসিহ উত্তর করেছিলেন, ‘তুমিই বললে’ (ইনজিল শরিফ মথি ২৭ রুকু ১১ আয়াত)। পিলাত যখন বাদশাহ হেরোদের কাছে ঈসা মসিহকে প্রেরণ করলেন, তখন হেরোদের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছিল। কিতাবে লেখা আছে, ‘ঈসাকে দেখে হেরোদ অতিশয় আনন্দিত হলেন, কেননা তিনি তার বিষয়ে শুনেছিলেন, এজন্য অনেক দিন হতে তাকে দেখতে বাঞ্ছা করছিলেন, এবং তার কৃত কোনো চিহ্ন দেখার আশা করতে লাগলেন। তিনি তাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু ঈসা মসিহ তাকে কোনো উত্তর দিলেন না। ... আর হেরোদ ও তার সেনারা তাকে তুচ্ছ করলেন ও বিদ্রূপ করলেন, এবং জমকালো পোশাক পরিয়ে তাকে পিলাতের কাছে ফেরত পাঠালেন। সেদিন হেরোদ ও পিলাত পরস্পর বন্ধু হয়ে উঠলেন, কেননা পূর্বে তাদের মধ্যে শত্রুভাব ছিল’ (ইনজিল শরিফ ২৩ রুকু ৮-১২ আয়াত)। পিলাত ও হেরোদ দীর্ঘদিনের শত্রুতায় জড়িয়ে ছিলেন। পিলাত ও হেরোদ চিন্তা করলেন, তাদের দুজন দুজনের শত্রু হলেও ঈসা মসিহ তাদের দুজনেরই আরও বড় শত্রু। যেভাবে তখনকার জগত ঈসা মসিহের পিছনে অনুসরণ করছিল, তাতে তারা দুজনই ভীত হয়েছিলেন।

লেখা আছে, ‘তখন ফরিশীরা পরস্পর বলতে লাগল, তোমরা দেখছ, তোমাদের সব চেষ্টা বিফল; দেখ, জগৎ-সংসার তার পশ্চাৎগামী হয়েছে’ (ইনজিল শরিফ ইউহোন্না ১২ রুকু ১৯ আয়াত)। তেমনিই একজন মহান নেতা, ধার্মিক ও জগতের পরিত্রাতাকে হত্যা করতে তারা পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠলেন। এ যেন অন্যায় উদ্দেশ্যে ন্যায়কে বিসর্জন দেয়া। আমাদের সমাজে এ ধরনের ষড়যন্ত্র আমরা বহুদিন থেকে দেখে আসছি। একে অপরকে ধ্বংস করার জন্য আমরা অন্যায়ের সাথে হাত মিলাই। প্রতিদ্বন্দ্বীকে শেষ করে দিতে আমরা অন্যায়ের দ্বারস্থ হই। আমাদের দেশের জন্মলগ্ন থেকেই আমরা এ ধরনের ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু নিজের অস্তিত্ব ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আমরা এমন অন্ধ যে, আমরা তা চোখ থাকতেও দেখি, আর কান থাকতেও শুনি না, এবং কোন পদক্ষেপ নিই না। আমরা নিজেরা শেষ হয়ে যাব, আমাদের দেশকেও শেষ করে দেব, তবুও অন্য কেউ যেন টিকে না থাকতে পারে। এতে সাধারণ মানুষের কী লাভ? মানুষের কোন উপকারের চিন্তা কি আমাদের আছে? আমরা কি মানুষের মঙ্গলের চিন্তা কখনো করি?

কিতাবের কথামতো ঈসা মসিহ বনি ইসরাইলদের ও সারা পৃথিবীর সব মানুষের বাদশাহ। তবে বনি ইসরাইলরা, রোমান গভর্নর পিলাত ও বাদশাহ হেরোদ ঈসা মসিহের বাদশাহীর অর্থ বুঝেন নি। ঈসা মসিহ ছিলেন আল্লাহর রূহানী রাজ্যের বাদশাহ। তিনি মানুষ হিসেবে তাঁর জন্মের মধ্য দিয়ে এ পৃথিবীতে বেহেশতী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে এসেছেন। তাই হযরত ইয়াহিয়ার কাছে তরিকাবন্দি নেয়ার পরপরই ঈসা মসিহের যে ঘোষণা, তা হচ্ছে ‘মন ফিরাও, কেননা বেহেশতী-রাজ্য সন্নিকট হল’ (ইনজিল শরিফ মথি ৪ রুকু ১৭ আয়াত)। এর আগে হযরত ইয়াহিয়াও একই প্রচার করেছিলেন, “মন ফিরাও, কেননা বেহেশতী-রাজ্য সন্নিকট হল” (ইনজিল শরিফ মথি ৩ রুকু ১ আয়াত)।

হজরত ইয়াহিয়া ও ঈসা উভয়েই আল্লাহর রাজ্যের সুখবর দিয়েছিলেন। এ রাজ্যের প্রকৃতি জাগতিক নয়, কিন্তু আধ্যাত্মিক। বনি ইসরাইলরা ও রোমান পৌত্তলিক শাসকরা এ রাজ্যের প্রকৃতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তারা আরেকটি কারণে ঈসাকে হত্যা করতে চেয়েছিলের, কারণ হজরত ঈসা মসিহ যখন দ্বিতীয় বার এ পৃথিবীতে আগমন করবেন, তখন তিনি জাগতিক প্রকৃতির রাজ্যের বাদশাহ হবেন। তবে তাঁর সেই ভবিষ্যতের রাজ্য ও সে রাজ্যে তাঁর বাদশাহীনির্ভর করে প্রথম আগমনে তাঁর নিরূপিত কাজ হিসেবে ক্রুশীয় মৃত্যুর ওপর। আমাদের মনে রাখতে হবে, ছাড় দেয়ায় কোনো পরাজয় নেই। এখন যে যত বেশি ছাড় দেবে, ত্যাগ করবে এবং অন্যকে নিজের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর জ্ঞান করবে, সে তত বেশি লাভবান হবে। আর তার জনসমর্থন আরও বাড়বে। এই বড়দিনে আসুন আমরা ষড়যন্ত্র পরিহার করে সবাইকে সমানভাবে গ্রহণ করি। শত্রুকে মিত্রে পরিণত করি। বড়দিন থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি।

এইচআর/এমএস