‘বিধি দিয়া ধন বুঝে মন, কেড়ে নিতে কতক্ষণ?’
কটু কথার আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণে দেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এই সময়ে মানুষ হাটে-বাজারে, আলাপ-আলোচনায়, গণমাধ্যমের অনলাইন-অফলাইনে বড় বড় পদবিধারী মানুষের কটূক্তি শুনতে শুনতে লজ্জা, ক্ষোভ, দুঃখ-কষ্ট পেয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে মহামারি, মারামারি, সংঘাতে অপমৃত্যু, সড়ক-নৌদুর্ঘটনা, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সব মিলিয়ে এক চরম ক্রান্তিকাল চলছে চারদিকে।
গত এক মাসে চট্টগ্রামে নর্দমা ও খালের মধ্যে মানুষের ছুড়ে ফেলা ময়লার ভাগাড়ে পড়ে গিয়ে ডুবে-অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে চার হতভাগ্য মানুষের। পাঁচলাইশে নর্দমার ময়লায় ডুবে শিশু কামালের মৃত্যু, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর মৃত্যু, পথচারীর মৃত্যু মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। লাইন্সেবিহীন বহিরাগত চালকরা চালায় ঢাকার সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি। দিনের বেলা রাজপথে ময়লা ও পচা দুর্গন্ধযুক্ত পানি ফেলতে ফেলতে চলে ময়লার গাড়ি। মাটি, বালু ফেলতে ফেলতে দিন-দুপুরে চলে ভাঙা-চোরা নির্মাণ কাজের ট্রাক।
মাদকতায় ভরা ঢুলু চোখে রঙিন স্বপ্ন দেখতে দেখতে চালায় ওরা ভারী ময়লা ও বালু-মাটির ট্রাক। দেশের প্রায় সব সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলোর ক্ষেত্রে একই অবস্থা। ওদের গাড়িগুলো গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে দিনের বেলা রাস্তায় জনসমাগমের মধ্যে ধা ধা করে ছুটে চলে। ময়লার গন্ধে সেগুলোর চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করে না কোনো ট্রাফিক। কারণ, ওরা সরকারি গাড়ি চালায়। সেগুলো ধরলে ট্রাফিকদের কোনো লাভ-ক্ষতি মেলে না। তাহলে দরকার কি সেসব অবৈধ ট্রাক চালকদের লাইসেন্স চেক করার?
চট্টগ্রামে নর্দমার ময়লায় ডুবে বার বার মৃত্যু ঘটছে কার অবহেলায়? ২৪ ঘণ্টা পর শিশু কামালের লাশ খুঁজে পাওয়া গেছে বহুদূরের এক শিকবাঁধা ব্যারিকেডের মাথায়। বিশাল নর্দমায় কে ময়লা ফেলে আর কে সেটা নিয়মিত পরিষ্কার করার দায়িত্ব পালন করার কথা সেগুলো সম্পর্কে কেউ কোনো কিছু বলে না, ঠিকমতো লিখেও না। তাদের কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য গ্রেফতার করা দূরে থাক জিজ্ঞাসাবাদ করারও প্রয়োজন মনে করেন না কর্তৃপক্ষ। ফলে বার বার একই দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে। সিটি করপোরেশনের এত লোকবল, এত সুপারভাইজার, এত অফিসার তবুও নর্দমা কেন পলিব্যাগে ভর্তি, কেন সেগুলো আবর্জনা দিয়ে ভরাট হয়ে বন্ধ থাকে তা জনগণ জানতে চায়। ওরা মাস ফুরালেই বেতন নেয় কিন্তু ঠিকমতো কাজ করে না কেন? শুধু শ্রমিক ইউনিয়নবাজি করা এবং নিজেদের গাড়ি-বাড়ি বাড়ানোর কাজে বসদের সাথে প্রতিযোগিতা করাই যেন তাদের নিত্যদিনের ভাবনা। জনসেবার এ গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান কাজে অবহেলার জন্য শাস্তি হওয়া দরকার সংশ্লিষ্ট সবার। এরা সবাই নিজেদের রং বদলায়। নতুন সরকার এলেই নতুন রং ধারণ করে কাজে ফাঁকি দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই এদের শাস্তি দেওয়ার কে আছে? সব সময় ওরাই তো সরকার!
ড্রেনের পানিতে ডুবে মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি শুধু দুঃখজনকই নয়, এটা চরম-মর্মান্তিক। নর্দমাগুলো অগভীর, কিন্তু এত আবর্জনাময় ও দুর্গন্ধযুক্ত যে ডুবুরিরা ২৪ ঘণ্টা চেষ্টা করেও একজন ডুবন্ত শিশুর লাশ খুঁজে পায় না। একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সবার টনক নড়ে। তখন তারা একে অপরকে দোষারোপ করে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে সময় পার করে দেয়। দুর্ঘটনায় বিপদ ঘটলে লাগামছাড়াভাবে পরস্পরকে দোষারোপ করা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা কিছু কিছু দলবাজ টিভিতে আরও বেশি করে চোখে পড়ে। তারা তাদের বিশেষ নির্বাচিত লোকদের কথা বলতে নিয়মিত ডাকে।
চট্টগ্রাম শহরের প্রতিটি ড্রেনে এত যে ময়লা পানি জমে আছে তা বোঝাই যায় না। সেখানে কাদার মধ্যে ডুবুরি নেমে ভারী গাদের মধ্যে কীভাবে কারও লাশ খুঁজে পাবে? ড্রেনগুলোর স্লাব নেই, ঢাকনা নেই। বড় বড় ক্যানেলগুলোর দু’পাশে খোলা। সেখানে কোনো বেড়াও নেই। বেড়া না থাকায় শিশু কামাল ও তার বন্ধু ময়লার ওপর ভাসতে থাকা পুরোনো খেলনা কুড়াতে চেয়েছিল। তারা ভাবেনি সেখানে গভীর ময়লা কাদায় ডুবে গিয়ে তার মৃত্যু আছে। এই দোষ ও অন্যায়টা কার? কে দায়ী এই অবুঝ শিশুর মৃত্যুর জন্য? এসব উন্মুক্ত নালার ময়লা মৃত্যুকূপ হয়ে আছে কার অবহেলায়? সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তি এই দায় এড়াতে পারেন না। দেশের অর্থনৈতিক রাজধানীতে এত বড় নর্দমার জন্য কোনো সেফটি বা নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই কেন তা আজ এক বড় প্রশ্ন।
লোভ শুধু ঠিকাদারি কাজে নয়। মাদকের ভোক্তা ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই জীবনবিনাশী পাপকাজ। বাংলাদেশ এখন মাদকদ্রব্যের বড় বাজার, ছোট-বড় মাদক ভোক্তাদের বড় দেশ! দেশে এত ইয়াবা, ক্রিস্টাল, খাত, ফেনসিডিল, ভদকা, শ্যামপেনের ক্রেতা কি দরিদ্র মানুষ? অবৈধ মাদক বিয়ারের বিজ্ঞাপন চলে ভিন্ন আঙ্গিকে। তা দেখে কি মাদকসেবীরা চাঁদে জমি কিনতে চায় না? বিত্তশালী ও ক্ষমতাধরদের ছত্রচ্চায়ায় মাদকের অবৈধ ব্যবসার বিকিকিনি চলে। সিংহভাগ ব্যয়বহুল মাদকের ভোক্তা ওরা ও ওদের সাঙ্গ-পাঙ্গ ও দোসররা।
অতিলোভ থেকে অতি ক্ষোভেরও জন্ম নেয়। তাইতো তিনি অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে একজন খ্যাতিমান নায়িকাকে তার সাথে খারাপ কাজে শরিক হতে সরাসারি আহ্বান করতে কুণ্ঠিত হননি। এরাই আজ আমাদের নেতা। এরাই আইন প্রণয়ন করেন, দেশ চালান। এ ধরনের আরও কতজন যে অগোচরে রয়েছেন তার হিসাব কি কেউ রাখেন?
বিনাভোটে ক্ষমতা লাভ করা যায়- এ উদাহরণ তৈরি হওয়ার ফলে ইউপি নির্বাচন নিয়ে তৈরি হয়েছে আমরা-আমরা মারামারি, কাটাকাটি, খুনোখুনি। ভোটের কড়াকড়ি না থাকায় টাকা ও পেশি দিয়ে সবাই নেতা হতে আগ্রহী। গণতান্ত্রিক উপায়ে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা বিরাজ থাকলে দেশে এমনটি কখনো ঘটতো বলে মনে হয় না। অতি সহজেই নেতা হওয়ার ক্রমাগত লোভ থেকে মানুষের মধ্যে রাগ, হিংসা, ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, শুধু নমিনেশন পেলেই যদি ক্ষমতার মালিক হওয়া যায় তাহলে সেই নমিনেশন পাওয়ার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ না হওয়াটাই বোকামি। ইউপি নির্বাচনে সহিংস ঘটনা ও মৃত্যুর ঘটনা এ সত্যটাকেই প্রকাশ করে মাত্র।
আরেকটি জিনিস শুরু হয়েছে এক অপরের নামে বিষোদগার ও কুৎসা রটানো। এর প্রধান বাহক আজ ইন্টারনেট ও ডিজিটাল গণমাধ্যম। আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর দলকানা রোগ অতিবেশি। কারণ সেগুলোর সিংহভাগের জন্ম হয়েছে ব্যাঙের ছাতার মতো। বেশিরভাগ গণমাধ্যম গজিয়ে উঠেছে ব্যক্তিমালিকানাধীন দলপ্রীতিকে পুঁজি করে। তাই তারা সব সময় সত্যটা প্রকাশ করতে গিয়ে ভয়ে তটস্থ থাকে। ফলে এটা এক ধরনের পক্ষপাতিত্বের জন্ম দিয়ে জনগণকে প্রতারণা করে। তবে সবাই নয়। কেউ কেউ দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠে সত্য প্রকাশে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সাধুবাদ জানাই।
জ্ঞানী মানুষ যারা শুধু তারাই জানেন ক্ষমতার বাহাদুরি চিরকাল থাকে না। মাতালরা সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে শুধু হম্বিতম্বি ও আস্ফালন করে দিন কাটায়। প্রবাদে আছে, ‘বিধি দিয়া ধন বুঝে মন, কেড়ে নিতে কতক্ষণ?’ তবুও একশ্রেণির মানুষ ক্ষমতার দম্ভে রাতকানা রোগে ভুগতে থাকে। মাতাল হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সাধারণ মানুষকে পিঁপড়াও মনে করে না। কেউ কেউ মাতাল হয়ে ট্রাক দিয়ে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া মানুষকে পিষে মেরে ফেলে।
আবার কেউ কেউ দলকানার দম্ভে অপরের অধিকার কেড়ে নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠে গান গায়, নাচ করে, মাদক ও নারী ভোগে মত্ত হওয়ার জেরে জিহ্বার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আবোল-তাবোল কথা বলে নিমিষেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আর সেটা হারাবেই তো, যা কষ্ট করে অর্জিত তা হারানো এত সহজ নয়, যা বিনা কষ্টে বা ‘ফাও’ অর্জিত হয় তা তাসের ঘরের মতো নিমিষেই উড়ে যেতে পারে। এটাই নিয়তির নিয়ম। তাই উন্নাসিক সবাইকে সবক্ষেত্রে অতিলোভ, ক্ষোভ ও নিজ নিজ জিহ্বা সামলানোর জন্য জোর চেষ্টা করা জরুরি।
লেখক : সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/জিকএস