বাংলাদেশ ৫০: মুজিব-ইন্দিরা এবং পার্শ্বচরিত্ররা
গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ বাংলাদেশ তার মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৫০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠান করেছে। ১৯৭১ সালে ৯ মাস যুদ্ধের পর পাকিস্তানের শোষণমুক্ত হয় বাংলাদেশ। এ লড়াইয়ে বাংলাদেশের পাশে ছিল প্রতিবেশী দেশ ভারত। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সরাসরি বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে ভারতীয় সেনারা। তাই বাংলাদেশের পাশাপাশি প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর ভারতও বিজয় দিবস পালন করে। এ বছর বিশেষ আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত উভয় রাষ্ট্র পৃথকভাবে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে।
তবে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণটি আরও জৌলুসপূর্ণ হয়নি এবং এ বিজয়ে যারা প্রধান ভূমিকা রেখেছেন তাদের অবদানের কথা খুব একটা আলোচনায় আসেনি বলে সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি সমালোচনা করছে যে ‘বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে সরকার ওসমানী, জিয়া, তাজউদ্দীনের নাম উচ্চারণ করেনি’। অন্যদিকে নয়াদিল্লিতে ভারত আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নাম উল্লেখ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।
উত্তরাখন্ডের রাজধানী দেরাদুনে ১৬ ডিসেম্বর ‘বিজয় সম্মান সমাবেশ’-এ রাহুল বললেন, ইন্দিরা গান্ধী দেশের জন্য ৩২টি গুলি শরীরে নিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সরকারি অনুষ্ঠানে তার নাম পর্যন্ত উচ্চারিত হলো না! রাহুলের বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রও একই অভিযোগ করে বলেন, দেশের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নাম দেশের নারীবিদ্বেষী সরকার উচ্চারণ করল না। সেটাও বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পেছনে তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির সঙ্গে ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠান। মুজিববর্ষ উদযাপনের প্রাধান্যে বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির অনুষঙ্গ অনেকটা ম্লান ছিল, বা ঢাকা পড়েছিল। অবশ্য কেউ কেউ বলবেন মুজিব মানেই স্বাধীনতা, মুজিব মানেই বাংলাদেশ। সুতরাং এতে দোষের কিছু নেই। তারপরও মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী, সেক্টর কমান্ডার এবং হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম গর্বভরে উচ্চারিত হতে পারতো বিজয়ের ৫০ বছরপূর্তির রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে।
আমার কাছে এর চেয়েও খারাপ লেগেছে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামটি দুই দেশের কোথাও স্থান পায়নি, উচ্চারিত হয়নি বলে। অথচ বঙ্গবন্ধুর পরে এই বিজয়ে দ্বিতীয় কারও নাম লিখতে হলে ইন্দিরা গান্ধীর নাম লিখতে হবে। নয়তো ইতিহাসের ওপর অবিচার করা হবে। দুর্ভাগ্য যে আমাদের বিজয়ের ৫০ বছর পালনের এই স্বর্ণালি অধ্যায়ের বিদেশি অতিথি করতে হয়েছে ভারতের বিজেপির মতো একটি সাম্প্রদায়িক সরকারের মৌলবাদী রাষ্ট্রপতিকে, যেখানে এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এর আগে স্বাধীনতা দিবসের ৫০ বছর পালন অনুষ্ঠানেও অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাতে হয়েছে ভারতের মৌলবাদী প্রধানমন্ত্রীকে। দুই রাষ্ট্রের জন্য দুর্ভাগ্য যে এমন একটি সময়ে দিল্লিতে হিন্দু মৌলবাদী দল বিজেপি ক্ষমতায় আছে। বাংলাদেশকেও বিজেপির নেতা নয় ভারতের রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাদের দাওয়াত দিতে হলো।
এদিকে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় তাই তার সৌভাগ্য যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়েছে ৫০তম বর্ষপূর্তিতে। এর আগে ২৫ বছর পূর্তির সময়ও আওয়ামী লীগ ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তখনও বঙ্গবন্ধুকে যথাযথভাবে স্মরণ করা হয়েছে। অথচ ১৯৭৫ সালের পর ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে দিতে চেয়েছে বিএনপি, জাতীয় পার্টির সরকারগুলো। বঙ্গবন্ধু আরও ভাগ্যবান যে, তার শততম জন্মদিনও জাতি যথাযোগ্যভাবে পালন করেছে, দুই বছর ধরে উৎসব করে।
অন্যদিকে ইন্দিরার দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশ সৃষ্টির অবদানের জন্য তিনি তার দেশে স্বীকৃতি পাননি। গত ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ছিল ইন্দিরা গান্ধীর শততম জন্মদিন। আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলো এ বিষয়ে একটা ছোট সংবাদ পরিবেশন করেছে মাত্র। কেউ বিশেষ কোনো লেখা ছাপেনি। ভারতের পত্রিকাগুলোতেও বিশেষ মর্যাদা দিয়ে কোনো লেখা প্রকাশিত হতে দেখিনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। বাংলাদেশে ওই সময় সংসদ অধিবেশন চলছিল, সংসদেও তাকে স্মরণ করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বিস্মৃত হয়েছেন— এটাও কষ্টের বিষয় ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ইন্দিরার সাহস-মনন-মেধার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ক্ষেত্র। পাকিস্তানের ইয়াহিয়া-ভুট্টো, চীনের মাও সেতুং-চৌন এন লাই আর আমেরিকার নিক্সন-কিসিঞ্জারের সম্মিলিত রণকৌশলকে ইন্দিরা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে সম্ভব করে তুলেছিলেন। বাংলাদেশ নিয়ে ইন্দিরার পরিকল্পনাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম প্রথম মনোযোগ দিয়ে দেখেনি। বরং বাংলাদেশের বিষয়টি উত্থাপন করা হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরক্ত হতো। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী কৌশলে সোভিয়েতকে তার অবস্থানে থাকতে দেননি।
৯ আগস্ট ১৯৭১ ভারতের সঙ্গে ২০ বছর মেয়াদের সামরিক চুক্তি সম্পাদন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিসিঞ্জার তার ‘হোয়াইট হাউস ইয়ারস’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করে সোভিয়েত ইউনিয়ন বারুদের স্তূপে একটি জ্বলন্ত দেয়াশলাইয়ের কাঠি ছুড়ে দিয়েছিল।’ চুক্তির পরেই চীন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছিলে সোভিয়েত। চীন বুঝেছিল, তারা যদি পাকিস্তানের পক্ষে কিছু করতে যায়, তবে সোভিয়েতের প্রতিশোধ মোকাবিলা করতে হবে। এমনিতেই তখন দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না।
১৯৭১ সালে শেষ দিকে সফরে বের হন ইন্দিরা। নভেম্বর মাসে তিনি ওয়াশিংটন পৌঁছান। নভেম্বরের ৪ ও ৫ তারিখে ইন্দিরার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক হয় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের। বৈঠক সম্পর্কে নিক্সনের দুই খণ্ডে লেখা স্মৃতি কথা ‘দ্য মেমোয়ার্স অব রিচার্ড নিক্সন’-এ বিস্তারিত তথ্যও রয়েছে। কিন্তু কিসিঞ্জার তার বইতে এ আলোচনাকে ‘ডায়ালগ অব দ্য ডেফ’ বা ‘দুই বধিরের সংলাপ’ বলে উল্লেখ করেছেন। নিক্সনের সঙ্গে দুদিনের আলোচনায় কেউ কাউকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ‘কনভিন্স’ করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। আমেরিকার মানুষ, কংগ্রেস, মিডিয়া— সবই ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। ইন্দিরার এই সফর সবার সমর্থনের জোর বাড়িয়ে দিয়েছিল।
বাংলাদেশ সরকারকে তখন পর্যন্ত স্বীকৃতি দেননি ইন্দিরা। তিনি বলতেন, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাকিস্তান বসে তাদের বিষয়টি মীমাংসা করতে পারেন। অথচ বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তখন প্রবাসে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করেছিলেন। এপ্রিল মাসে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় এয়ার কভারেজ ও ভারতীয় বাহিনীর সতর্ক পাহারায় বাংলাদেশের একখণ্ড জমিকে ‘মুজিবনগর’ নাম দিয়ে সেখানে বাংলাদেশ সরকার শপথবাক্য পাঠ করেছিল।
পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার বিষয়টা তখন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছিল। আবার হাজার হাজার বাঙালি যুবককে সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধে নিয়োজিত করার কাজও অব্যাহতভাবে চলছিল। বাঙালি তরুণ, পক্ষত্যাগী সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য, পুলিশ, বিডিআরের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ১১ সেক্টরে বিভক্ত হয়ে ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের অধীনে সুশৃঙ্খলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। সেই যুদ্ধে তারা সফলও হয়েছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা সফরে এলেন ১ ডিসেম্বর ১৯৭১। ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি কলকাতায় ছিলেন। তাজউদ্দীন সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যৌথ অভিযানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত তখনই হয়েছিল। ওইসময় এই যৌথ অভিযানের কমান্ড নিয়েও মতবিরোধ হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী তাদের একক কমান্ড চেয়েছিল। কিন্তু প্রবাসী সরকার ও বাংলাদেশের বাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানীর বিরোধিতার ফলে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের বিষয়টি স্থির হয়েছিল।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জে-এন দীক্ষিত ‘ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-ইন-ওয়্যার অ্যান্ড পিস’ নামক বইয়ে এসব বিষয় তুলে ধরেছেন। কলকাতা সফর শেষে দীক্ষিত ও ডিপি ধরকে নিয়ে ইন্দিরা ৩ ডিসেম্বর প্লেনে দিল্লির পথে রওয়ানা হন। মাঝপথে খবর পেয়ে পাইলট ইন্দিরা গান্ধীকে জানালেন, পাকিস্তান পশ্চিম সীমান্তের আকাশপথে আক্রমণ করেছে। আম্বালা, অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর ও আগ্রায় বোম্বিং করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের এ আক্রমণ ছিল আত্মহত্যার শামিল। সম্ভবত পাকিস্তান সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে পাকিস্তান যদি ধ্বংস হয় বা খণ্ডিত হয়, তবে যুদ্ধ করেই হবে।
যুদ্ধ চললো মাত্র ১৩ দিন। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করলেন এ এ কে নিয়াজী। অভ্যুদয় হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। এটা ছিল ইন্ধিরা গান্ধীর জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ক্ষমতাসীনরা তার কাজের স্বীকৃতি এখন নাইবা দিলেন কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/এএসএম