মুজিব, পতাকা, নৌকা: আবেগে অবিরাম আঘাত
স্পর্শকাতর কিছু নিয়ে অতিচর্চা, বেশি কচলানি, খামখেয়ালি, গোঁয়ার্তুমি, হুজুগের খেসারত আবারো। রাজশাহীর বাগমারায় বিজয় দিবসে আবেগের তাড়নায় মুখ ফসকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের জান্নাত চেয়ে মোনাজাত করে বসেছেন তাহেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক। এই গোস্তাকির জন্য তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে দল থেকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল ওয়াজটি আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষকে বিনোদন দিয়েছে। বেশ আনন্দ ও পুলকের সঙ্গে তারা এটি শেয়ারের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের জান্নাত কামনার আগে-পরে কোথাও সামান্যতম গোলমাল ছিল না। তার মোনাজাতটি ছিল এমন- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যারা হত্যা করেছে তারা মানুষ নয়, অমানুষ। মাবুদ জাতির জনক এবং তার পরিবারকে যারা হত্যা করেছে আল্লাহ সকলকে তুমি জান্নাত দান করে দিও। আমাদের দেশের জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনি যে নিষ্ঠার সাথে দেশ পরিচালনা করছেন, উনার হায়াত বাড়িয়ে দিও। অসুখ বিসুখ থেকে উদ্ধার করে দিও আল্লাহ।’
বাজারে ভাইরাল হয়েছে ‘জাতির জনক এবং তার পরিবারকে যারা হত্যা করেছে আল্লাহ সকলকে তুমি জান্নাত দান করে দিও’ অংশটি। আওয়ামী লীগবিরোধীদের কাছে এ অংশটিই পছন্দ হয়েছে। রাজনীতিতে বা সামাজিক নানা ঘটনায় প্রতিপক্ষের কাছে এমনতর কথায়ই মন বেশি ভরে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। মাঝ দিয়ে রাজনীতির মাঠ বরবাদ হয়েছে আব্দুর রাজ্জাক বেচারার। ঘরে-উঠানে যা-ই হোক প্রকাশ্যে স্পর্শকাতর ইস্যুতে কিছু বলতে-লিখতে অসাবধানতার জের পড়েছে আবেগ-ঐতিহ্যের স্মারক মুজিববর্ষেও। সেখানে মুজিবের ‘ব’ কেটে ফেলা হয়েছে। অথবা ব-টা পড়ে গেছে। 'মুজিববর্ষ'কে লেখা হয়েছে 'মুজিবর্ষ'। তার জন্ম শতবর্ষে, বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে, তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা মঞ্চেই দেখা গেল মুজিবের নাম থেকে 'ব' উধাও।
শুরুতে চেপে যাওয়ার চেষ্টা হয়। পরে চেষ্টা চলে একে ব্যাকরণ সিদ্ধ প্রমাণের। বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, মুজিব থেকে ‘মুজি’ আর ‘বর্ষ’ মিলিয়ে ‘মুজিবর্ষ' বানানো হয়েছে। অথবা এটাকে সন্ধির মতো করা হয়েছে যে মুজিব+বর্ষ=মুজিবর্ষ। এ ধরনের যুক্তির কচলানির মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় যা হওয়ার হয়ে যায়। উৎসাহী মহল বেশ তৃপ্তি পেতে থাকে। এ রকম অবস্থায় মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির তরফে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ব্যাখাটি এমন, ‘আমরা একটি চিপ-এ পিসি থেকে ট্রান্সফার করে লেখাটি উৎকীর্ণ করেছি। ডিভাইস ট্রান্সফারের একপর্যায়ে একটি ‘ব’ অক্ষর অমিট হয়ে গেছে। আমরা পিসিতে চেক করে দেখেছি এটা ঠিকই আছে। অ্যাডভান্স টেকনোলজির বিষয়টি হয়তো স্যুট করেনি। এলইডিতে পরিস্ফুটন করে লেখাটি তোলা হয়েছে। পেডিয়ামের মনিটরেই আমরা ত্রুটিপূর্ণ বানান দেখতে পাই। এমন প্রাযুক্তিক গোলমালের বিষয়টি দৃষ্টিতে আসার পরপরই নামাজের বিরতিতে ত্রুটি সারাই করা হয় মাধ্যমটি পরিবর্তন করে। অর্থাৎ প্রথমে এলইডিতে পরে ম্যানুয়ালি উৎকীর্ণ করা প্লেট প্রতিস্থাপন করে।’
ভাষা ও বাক্যের ধরনে ব্যাখ্যাটির অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য ঢেকে। যদ্দূর বোঝা গেছে সেখানেও অস্পষ্টা, দায়সারা ও স্ববিরোধিতা। কারণ ঘটনাটি কেবল ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার বিজয়মঞ্চেই ঘটেনি। একাধিক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এমনকি দায়িত্বশীল সংবাদপত্রেও গত বছরের মার্চ থেকে 'মুজিবর্ষ' শব্দটি লেখা হচ্ছে। গত বছরের ১২ মার্চ বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটটের একটি সংশোধিত পরিপত্রে 'মুজিবর্ষ' লেখা হয়েছে। গত ৩১ মে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও 'মুজিবর্ষ' লেখা হয়েছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও লেখা হয়েছে 'মুজিবর্ষ'।
মোচড়ামুচড়ির এক পর্যায়ে ভুলটা স্বীকার করেছেন মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বলেছেন, এ ভুল অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক। অনেক কথার সঙ্গে তিনি একথাও বলেছেন,’কারিগরি জটিলতার কারণে এই ভুল হওয়ায় এজন্য কাউকে এককভাবে দায়ী করার অবকাশ নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে- তাদের কাছে ব্যাখ্যা কি কেউ চেয়েছে? যে কাজটি তাদেরকে করতে দেওয়া হয়েছিল, সেটি তারা ঠিকঠাক মতো করতে পারেননি- এটাই মূল কথা। ভুলের জন্য ব্যাখ্যার চেয়ে ক্ষমা চাওয়া, ক্ষমা পাওয়া বা বিহিত বেশি প্রাসঙ্গিক। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সামনে যে দুটো জাতীয় পতাকা রাখা ছিল, সেগুলোর মাপটা ঠিক ছিল কি-না; এ প্রশ্নও আছে সচেতন অনেকের। যদিও জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষার আইনি বিধানের সমান্তরালে রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা জারি হয় মাঝেমধ্যেই। জাতীয় পতাকার সাইজ, দিনক্ষণ, ওঠানো-নামানো, ঝুলানোসহ বিধিমালা পাকা-পোক্ত বাংলাদেশেও। কে-কারা, বাড়িতে-গাড়িতে, সামনে বা পেছনে কতো অংশে, কখন, কতোক্ষণ পতাকা বহনের অধিকারী সেই নির্দেশনাও পরিষ্কার। অন্য দেশের পতাকার সাথে বাংলাদেশের পতাকা তুলতে হলে কোনটা আগে, কোনটা পরে তাও ডানবামসহ নির্দিষ্ট করা আছে। ১৯৭২ সালের ফ্ল্যাগ রুলসে বাংলাদেশে পতাকা ব্যবহারের বিধিবিধানে তা একদম পরিষ্কার।
বিজয়ের ডিসেম্বর বা স্বাধীনতার মার্চ মাসে আবেগে, হুজুগে, অজ্ঞতায়, মতলবে বা বাহাদুরির শো-ডাউনে যত্রতত্র-যথেচ্ছা জাতীয় পতাকার অবমাননা অনেকটা গা সহার পর্যায়ে চলে এসেছে। পোশাকে জাতীয় পতাকা বা জাতীয় পতাকা দিয়ে পোশাক বানানোর পাগলামিও পুরনো। ভক্তি দেখাতে গিয়ে ফ্যাশানেবল হয়ে যা প্রকারান্তরে জাতীয় পতাকার অপমানই নিশ্চিত করছে। এ নিয়ে ডাকদোহাই না মানার সংস্কৃতিও সহ্য করতে হচ্ছে। নইলে না দেখার ভান ধরে নিজেকে নিবৃত রাখতে হচ্ছে। বিধিমালায় বা আইনত জাতীয় পতাকা প্রদর্শন ও উত্তোলন যে অবাধ নয়, সীমিত-তা বোঝার বোধও নেই অনেকের।
বাংলাদেশ, বাংলা, বাঙালি, বঙ্গবন্ধু, মুজিব, পতাকা, স্বাধীনতা ইত্যাদি মানুষের হৃদয়ের গহীনে গাঁথা। এগুলো নিয়ে বেশি ব্যাকরণ, শুদ্ধাশুদ্ধের বাহাদুরি ঠিক নয়। আবার অতি আবেগে অতি কচলানিও অনাকাঙ্খিত। নৌকা নামের বস্তুটির মর্যাদাও এক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নৌকাকে কেবল একটি নির্বাচনী প্রতীক মনে করলে তা হবে খণ্ডিত ভাবনা। বাঙালির ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্যের কালো অক্ষর থেকে নৌকাকে কোনোভাবেই বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। মানুষের-আস্থা-ভরসার স্বাধীনতার প্রতীকও। মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক- সামাজিক মুক্তির প্রতীক।
অবশেষে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতীকও। কিন্তু, এবার ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে নৌকাকে কেবল নাজেহাল নয়, কলঙ্কিতও করে ছাড়ছে এর নানা কিছিমের কাণ্ডারিরা। অথচ কোনো বিতর্কিত, দাগী সন্ত্রাসীকে বঙ্গবন্ধুর নৌকা দেয়া হবে না বলে ছিল কড়া দলীয় অঙ্গীকার। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঐতিহ্যের ‘নৌকা’ ডুবাচ্ছে আওয়ামী লীগ। আবার আওয়ামী লীগকে ডুবাচ্ছেন নৌকা প্রার্থীরা। এতে ভাসছে কে? কারা?
বঙ্গবন্ধু, জাতীয় পতাকা, নৌকার মতো বিষয়কে দলীয় গণ্ডিতে রাখা যায় না। কারো পছন্দ-অপছন্দের চেয়ে এগুলোর বেশি গুরুত্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, আবেগের বিষয় হিসেবে। ভোটের বদলে বন্দুক, চাপাতি, কিরিচ, দা-বঁটি, লাঠি-সোটায় জেতার মানসিকতা নৌকাকে কেবল কলঙ্কিতই করছে না। একটি ভয়ের প্রতীকও করে ছাড়ছে। দল থেকে হিম্মতওয়ালা -বাহাদুর খোঁজার সংস্কৃতির জেরে নৌকার লোকেরা আওয়ামী লীগের লোকদের কান কেটে ফেলছে। হাত-পায়ের রগ কেটে পুকুরে ছুঁড়ে ফেলছে।
এর মাঝে ইউপি নির্বাচনী সংঘাতে গত ৪ মাসে নৌকা আর আওয়ামী লীগে পরস্পর ৭০ জনকে আস্ত মেরে ফেলা হয়েছে। আবেগে-হুজুগে, মতলবে, খামখেয়ালিতে বঙ্গবন্ধু, মুজিব, জাতীয় পতাকা, নৌকা কোনোটিকেই অক্ষত না রাখার উম্মাদনা মহল বিশেষের জন্য আনন্দের, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম