পাকিস্তানিদের চোখে বাংলাদেশের ৫০
বাংলাদেশ ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করলো ঘটা করে। কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যায়ে মোটামুটি দেশজুড়েই রেশ ছিল এই উৎসবের। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মসূচিতে দেশের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করেছে। সাধারণ মানুষ তাদের মন্তব্যগুলো শুনেছে।
বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে দেশের অভ্যন্তরেই নানা মত প্রচারিত। বিশেষ করে সরকারি দল ও কিছু বিশ্লেষক এর ভাবনা আর বিরোধী দলের ভাবনায় পার্থক্য বিস্তর। বাংলাদেশের ৫০ বছর বয়সে এসে নিশ্চয়ই আমাদের ভাবনায় আসে পাকিস্তানের কথা। শুনে আসছি, ওরা বাংলাদেশের অগ্রগতি দেখে আফসোস করে। তাদের বোদ্ধা মহলে একটা বোধের সৃষ্টি হয়েছে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখার কৌশলটা পাকিস্তানের জন্য কত বড় ভুল হয়েছিল। একইসঙ্গে বাঙালির মেধা ও দেশপ্রেমকে মূল্যায়ন না করায় আজকে পাকিস্তানকে কতটা খেসারত দিতে হয়েছে।
পাকিস্তানের পরাজয় আর বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০বছরে পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোর বিশ্লেষণ দেখে আমারও মনে হয়েছে-বড্ড দেরিতে বুঝতে পারলেন আপনারা। ৫০বছর আগে যদি আপনারা দমন নিপীড়নের পথ গ্রহণ না করতেন, পূর্বকে বঞ্চিত করে পশ্চিমের উন্নয়নের অশুভ চিন্তা না করতেন তাহলে হয়তো এতদিনে আপনাদেরও ভাগ্যের পরিবর্তন হতো। অন্তত এই সময় এসে আফসোস করতে হতো না। বলতে হতো না- আমাদের বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আপনাদের নাগরিকদের বলতে হতো না, সিঙ্গাপুর-টোকিওর স্বপ্ন দেখানোর দরকার নেই, আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও।
বহুল প্রচারিত পত্রিকা ডন মূল্যায়নধর্মী নিবন্ধ ছেপেছে, ইসরাত হোসেনের। তিনি আবার একসময় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালীতে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত। শুধু তাই নয় তিনি বাংলাভাষায়ও মোটামুটি পারদর্শী। কয়েকটি পত্রিকা পাকিস্তানের পরাজয়ের এবং বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর বিষয়ে নিবন্ধ এবং একাধিক পত্রিকা সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। ডেইলি মিরর সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা ফলাও করে প্রকাশ করেছে। কিন্তু ইতিহাস অংশে কিছু বিভ্রান্তিকে তারা এখনও ধরে রেখেছে। তারা এখনও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। যা ইতিহাসের পরিপন্থী।
আবার একটি পত্রিকা লিখেছে-পাকিস্তানিরা যেমন বাঙালি হত্যা করেছে তেমনি বাঙালিরাও অবাঙালিদের হত্যা করেছে। এখানে অবশ্যই বলতে হবে বাঙালি অবাঙালিদের হত্যা করেনি। অবাঙালিদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারণে বাঙালি আত্মরক্ষা করেছে মাত্র। একটা হত্যাকাণ্ড আরেকটা জীবন বাঁচানোর প্রয়োজন, এভাবেই বিশ্লেষণ হওয়া উচিৎ। তবে প্রায় সব পত্রিকাই বাংলাদেশের অগ্রগতিকে তুলে ধরেছে। এমনকি একটি ওয়েবিনারও দেখলাম,উর্দু ভাষা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও যেটুকু বুঝেছি মনে হয়েছে, বাংলাদেশের প্রশংসা এবং তাদের ব্যর্থতার প্রসঙ্গই তাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল।
আমার দেখা বিশ্লেষণগুলোর মধ্যে দ্য ডন এ প্রকাশিত ইসরাত হোসেনের নিবন্ধটির বিভিন্ন অংশ মনে হয়েছে উল্লেখ্য। তার নির্যাস তুলে ধরছি- ‘এই দেশটিকে একসময় হেনরি কিসিঞ্জার তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাকেই আজকে রোলমডেল হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় আয় বেড়েছে ৫০গুণ। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। ৪গুণ বেড়েছে খাদ্য উৎপাদন, জন্মহার এখনও ২.৫% এ ধরে রেখেছে। বেড়েছে মাথাপিছু খাদ্য নিশ্চয়তা। রফতানি বেড়েছে ১০০ভাগ এবং দারিদ্র্য ২০% এ নেমে এসেছে যেখানে ১৯৯০ সালে ছিলো ৬০%। গড় আয়ু সীমা গড় হিসেবে বেড়েছে ৭২বছর। অধিকাংশ সামাজিক সূচকে একমাত্র শ্রীলংকা ছাড়া আঞ্চলিক দেশগুলোর তুলনায় অনেক ভালো। মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগতি হয়েছে ৬০%।
এই উন্নয়নের অধিকাংশই সম্ভব হয়েছে গত ৩০ বছরে। তার আগের দুই দশক ছিলো মূলত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর কঠিন বাস্তবতার সময়।ওই সময় পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ। দুঃখজনক হচ্ছে, আজকে তা নেমে এসেছে বাংলাদেশের দশভাগের সাত ভাগে। কোভিডের আগে ২০১১-২০১৯ সময় বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধি হয়েছিলো ৭%-৮%। যা ছিল পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশের গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। একটা দেশ, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্বিপাক লেগেই থাকতো, যার প্রভাব ছিল সর্বত্র। সেই দেশটি কী করে তার প্রতিবেশি ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশ কিছু সূচকে এত ভালো করতে পারলো। এই দেশটিকে একসময় কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। দেশটির জন্মলগ্নে এর প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, পুনর্বাসন ব্যবস্থা নাজুক ছিল। বিশেষ করে সামরিক অভ্যুত্থান মাধ্যমে দেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিনিয়র রাজনৈতিক নেতাদের হত্যার পর যে শূন্যতা তৈরি হয় সেইদিকটি অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। সফল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। এরপর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছরের জন্য ক্ষমতাসীন হয়।
দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল যথাক্রমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জিয়ার বিএনপি ১৯৯১ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতাসীন ছিল। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ টানা শাসন ক্ষমতায়। খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জন করে এবং রাজনৈতিক সহযোগীদের অনেকেসহ কারাগারে যায়। পর্যবেক্ষণ করতে গেলে কৌতূহল জাগতে পারে, এমন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে একটি দেশ কিভাবে আর্থসামাজিক দিক থেকে এভাবে মাথা উচিয়ে চলার শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়।
কিছু বিষয় আছে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বিশেষ করে এখানে সাংস্কৃতিক, ভাষা ও জাতিগত অভিন্নতা, উপজাতিগত দ্বন্দ্ব কিংবা ধর্মীয় বিভাজনও নেই তেমন। তবে নগর ও পল্লীজীবনের পার্থক্য থাকলেও দ্রুত উন্নয়নের ছোঁয়ায় সেখানে সামাজিক ক্ষোভ-বিক্ষোভও কম। অন্যদিকে বাংলাদেশ বহির্দেশীয় হুমকির মধ্যেও নেই।
দ্বিতীয়ত সেখানে সরকার কাঠামো একক হওয়ায় রাজ্য ও প্রদেশের মধ্যে হস্তক্ষেপের বিষয় নেই। ফলে সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক খবরদারিত্ব অনুপস্থিত। নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে নজরদারি সহজতর। অন্যদিকে দুর্বল বিরোধীদল ও শক্তিশালী শাসকদলের কারণে সরকারকে অনেকসময় একনায়কতান্ত্রিকও মনে হতে পারে। তেমনটা অভিহিতও করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে একই কারণে আমলাতন্ত্রকেও তারা জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারছে।
তৃতীয়ত নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি উল্লেখ করার মতো। ১৯৭১ সালের আগে থেকেই সেখানে জন্মনিয়ন্ত্রণের যাত্রা শুরু। নারীশিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, ক্ষুদ্র ঋণসহ সামগ্রিক বিষয়গুলো সরকার পরম্পরায় চালিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে গ্রামীণ,ব্র্যাক,আশার মতো এনজিওগুলোর সহযোগিতায় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ অনেকাংশে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছে। সরকার তাদের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি নজরে রেখেছে, সেই সীমাবদ্ধতা দূর করতে তারা সহযোগিতা গ্রহণ করেছে সামাজিক সংস্থা ও বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগীদের। শিশু ও নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে তারা। এনজিওগুলোকে স্বাধীনতা দিয়েছে সেক্ষেত্রে। এর প্রভাব পড়েছে নারীর আয়-রোজগারে। যে কারণে লিঙ্গ বৈষম্যও কমে এসেছে।
চতুর্থত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চেয়ে অর্থনৈতিক নীতিমালা অনুযায়ী প্রকল্প কর্মসূচি গ্রহণের বিষয় উল্লেখ করা যায়। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্রদান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। সরকার পরিবর্তনের পরও বিনিয়োগ নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন না হওয়াটাও উল্লেখ্য। যে কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা কমে এসেছে। যার ফল পাচ্ছে দেশটির অর্থনীতি।
পঞ্চমত, বাণিজ্যনীতি উদারিকরণের প্রভাবও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। তারা বৈদেশিক প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে তাদের ক্যাশ ও ননক্যাশ সুবিধাকে বৃদ্ধি করেছে। রফতানিকারকরা সেই সুযোগটি গ্রহণ করতে পারছে। দৃশ্যত উদাহরণ হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প খাত। সেখানে চীনের পরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্য এখন অগ্রাধিকার পায়। এই শিল্পে নারীর অংশগ্রহণের ফলে সামাজিকভাবে তাদের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। পরিবারে তার মূল্যায়ণ হচ্ছে ইতিবাচক। বিনিয়োগে উৎসাহী হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। উৎপাদনে দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তির সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিও হয়েছে তুলনামূলক অনেক।
ষষ্ঠত উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে যখন অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ হার ১৫% থেকে ৩০% হারে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। বেসরকারি উৎপাদনখাতে ব্যক্তির বিনিয়োগকে উৎসাহিত করায় অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকার মনোনিবেশ করতে পারছে অনেকটা নিশ্চিন্তে। আমদানি চাহিদা বৃদ্ধির ধকলটা সওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে ইতোমধ্যে আর তা সম্ভব হয়েছে রফতানি প্রবৃদ্ধির কারণে।
মোটামুটিভাবে অন্য পত্রিকাগুলোরও ভাষ্য একইরকম। সুতরাং বলা যায়-বাংলাদেশকে হারানোর যন্ত্রণায় তারা প্রতিশোধ পরায়ন হলেও বাস্তবতাকে স্বীকার করছে। এবং সেক্ষেত্রে যারা ক্রেডিট পাওয়ার তাও করছে তারা। সবচেয়ে উল্লেখ্য হচ্ছে- তাদের পিছিয়ে পড়ার অনুশোচনা প্রকাশে এখন আর দ্বিধান্বিত নয়।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এমএস