বিশ্বাসের অস্ত্রায়ন
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পাকিস্তানের শিয়ালকোট শহরে কিছুদিন আগে এক শ্রীলঙ্কান নাগরিককে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে৷ হত্যার পর তার মৃতদেহ পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। নিহত শ্রীলঙ্কান নাগরিক শিয়ালকোটের এক খেলাধুলার পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন৷ কারখানার দেয়ালের একটি পোস্টার ছিঁড়ে ফেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কারখানার শ্রমিক এবং স্থানীয়রা পিটিয়ে হত্যা করে।
যারা আক্রমণ করেছিল তারা সব ছিল বয়সে তরুণ। যারা দেখছিল, কিন্তু মানুষটাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি তারা ছিল কিশোর থেকে যুব বয়সের। ঘটনাস্থলে উপস্থিত অনেকেই সোৎসাহে ব্যস্ত ছিল মোবাইলে ভিডিও ধারণে। ২০২০ সালে এমন এক ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশে। সে বছর অক্টোবর মাসে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে শহীদুন্নবী জুয়েল নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাকে পিটিয়ে হত্যা এবং পরে তার লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
কোরআনের অবমাননার অভিযোগে ৩০ অক্টোবর আসরের নামাজের পর বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে পাঁচ থেকে ছয়জন ব্যক্তি শহীদুন্নবী ও জোবায়েরকে মারধর করেন। খবর পেয়ে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হাফিজুল ইসলাম তাদের সেখান থেকে নিয়ে যান। তাদের ইউপি কার্যালয়ের একটি কক্ষে রাখা হয়। এরপর কক্ষের দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের ভাষ্য, ঘটনাটি জানাজানি হলে উত্তেজিত জনতা বুড়িমারী ইউপি চত্বরে জমায়েত হয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দুজনকে মারধর করেন। পুলিশ জোবায়েরকে সরিয়ে নিতে পারলেও শহীদুন্নবীকে উদ্ধার করতে পারেনি। সেখানেই গণপিটুনি দিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় তাকে।
যারা এমন কাজ করে তারা একটা বিশ্বাস থেকে করে এবং সেটাকে অন্যায় বলেও মনে করে না। বিশ্বাসের নামে খুন করা, গলা কাটা, রগ কাটা, গণপিটুনিতে মারা, পুড়িয়ে মারা দিন দিন বাড়ছে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার যত বাড়ছে, এদের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের তোষণ যত বাড়ছে, ততই এরা ভয়ংকর হয়ে উঠছে। পাকিস্তানে ঘটছে, বাংলাদেশে ঘটছে কোরআন আবমাননার নামে, ভারতে ঘটছে গো মাংস খাওয়ার অপরাধে। ধর্মীয় বিশ্বাসের এমন অস্ত্রায়ন স্বাভাবিক কোন অসহিষ্ণুতা নয়। যারা এমনটা করে তারা বর্বর, ধর্মান্ধ খুনি।
অন্যের মত, আদর্শ, বিশ্বাস, ব্যবহার, যারা মানতে আগ্রহী নয়, তাদেরই অসহিষ্ণু বলি আমরা। ফেসবুক দেখতে তো মনে হয় ইদানীং শিক্ষিত শহুরে লোকরাও অসহিষ্ণুতা বাড়াচ্ছেন। একটা প্রবণতা লক্ষ্যণীয় যে, অনেকেই এই ভয়ংকর ধর্মান্ধদের ব্যাপারে বেশ সিলেকটিভ। আমরা যদি সব ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে না দাঁড়াই তবে এর থেকে পরিত্রাণ সহজ নয়। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে সেখানেও উদারতার প্রদর্শন প্রয়োজন। মৌলবাদীরা শুধু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ভেতরে নয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েও মৌলবাদী আছে।
সমাজের শ্রেণি বিভাজনের চেয়েও ভয়ঙ্কর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। বিজয়ের ৫০ বছরে এসে আমরা দেখছি দেশের প্রায় সর্বত্রই ধর্মীয় রাজনীতি করে টিকে থাকতে চাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। এবং এ কারণে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকারের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ, বিধিনিষেধ আরোপ ও ধর্মকে কেন্দ্র করে সামাজিক অস্থিরতার ঘটনা বাড়ছে। বেড়েছে জাতি বা বর্ণ-ঘৃণাজনিত অপরাধের ঘটনা, হিংসা, সাম্প্রদায়িক হিংসা, ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাস। বেড়েছে ধর্মাচরণে বাধা দেওয়ার ঘটনা।
তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে পোশাক পরানোর জোর প্রচেষ্টা। বিশেষ করে ধর্ম উপযোগী পোশাক না পরায় নারীরা নানা ভাবে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। এক মুক্ত, সুস্থ, শিক্ষিত, স্বাধীন নারীসমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন যে বেগম রোকেয়া সে দেশে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে পিছিয়ে রাখার সব আয়োজন বিস্তৃত হচ্ছে।
সম্প্রতি কয়েকটি জেলা সফরের সময় দেখেছি প্রান্তিক পর্যায়ে তো বটেই, এমনকি শহুরে এলাকায়ও বেড়ে চলেছে বাল্য বিবাহ। সারাক্ষণ মাঠের ওয়াজে, ইউটিউবের ওয়াজে বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহের পক্ষে লাগাতার প্রচারণা, বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর কারণে সর্বত্র আজ কুসংস্কারের জয় জয়কার। এবার দুর্গাপূজার সময় সারাদেশে যেভাবে হিন্দুদের ওপর, তাদের মন্দিরের ওপর হামলা হয়েছে, এতে করে দেশের সাম্প্রদায়িকতার ছবিটা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
এক অদ্ভুত সমাজ এখন। দেখেছি গ্রামগুলোর পথে ঘাটে কিশোরীরা সব বধূ অথবা মা। কিশোররাও মাঠে খেলেনা, আছে ডিভাইস নিয়ে। আজ গ্রাম আর গ্রামের মাঠঘাটগুলো খেলাধুলাহীন, প্রাণহীন। কিশোরীরা হিজাব পরে, বোরখা পরে, ঘরে বন্দী থাকে। স্কুল শেষ হওয়ার আগেই বউ হয়ে যায়। বাল্যবিয়ে চলছে দেদারসে এবং প্রশাসনিক ঝামেলা এড়াতে বিয়ে হচ্ছে চুপিসারে। কিশোর কিশোরীরা আজকাল গল্পের বই পড়ে না, খবর শোনে না, নাচ-গান করে না, খেলাধুলা করে না। তারা শুধু ধর্মীয় বই পড়ে। তারা ফেসবুকিং করে, ইউটিউবে থাকে ওয়াজ দেখার জন্য, কিংবা খুবই নিম্নমানের টিকটিক ভিডিও করা বা দেখার জন্য।
অর্থনীতির চাকা ঘুরছে, কিন্তু পেছনে যাচ্ছে সংস্কৃতির চাকা। রাজনীতি সর্বদাই অনিশ্চয়তায় ভরা। গণতন্ত্রের মহিমায় শাসক পক্ষ কখনও বিরোধী হয়ে যায়, বিরোধীরা শাসকের চেয়ারে বসে পড়ে। তবে ধর্মের নামে সমাজটাকে ভেঙে দেওয়ার চর্চায় কেউ কম যেতে চায় না। বিশ্বাসের ভাইরাসের ভাঙা আয়নায় খণ্ডিত অবয়বটুকুই যদি দেখতে থাকি তবে মনুষ্যত্বের সলিল সমাধি নিশ্চিত।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস