ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা : ভৌগোলিক রাজনৈতিক

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:০৯ এএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১

ইয়াহিয়া নয়ন

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দফতর।

নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ রয়েছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। বেনজীর আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর। একই সঙ্গে তিনি দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন।

এ ছাড়া র‌্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।

বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরকারকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে তারা বলছেন, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞায় ঢাকা ও ওয়াশিংটনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্র অনেক সময় দিয়ে থাকে। এটা নতুন কিছু না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও এক সময় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ছিল। যখন সে প্রধানমন্ত্রী হলো সেটা তুলে নিল। সে বড় বন্ধু হয়ে গেল।

এগুলো হলো রাজনীতির একটি অংশ। এটা হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। হতে পারে এখান থেকে তথ্য গেছে বা যারা তাদের পছন্দের লোক তারা তথ্য দিয়েছে। ঠিক কোন কারণে এটা করেছে সেটা বোঝা মুশকিল। তবে এটা ডমোস্টিক পলিটিকসের ব্যাপার। যেহেতু আফগানিস্তান থেকে রীতিমত পালিয়েছে, সেজন্য পৃথিবীকে কিছু একটা দেখাতে হবে। কিছু করেতো দেখাতে হবে, তাই গণতন্ত্র বা মানবাধিকার এগুলো সামনে নিয়ে আসছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরও কিন্তু তা করেছে। যখন পালিয়ে গেল তখনও গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে চিৎকার করল। চীনের পেছনে লেগেছে। এটা বোঝাই যায়, এটা তাদের ডমোস্টিক পলিটিকসের ব্যাপার। কোনো একটা রাজনীতি আছে। পৃথিবীকে দেখাল মানবাধিকার লঙ্ঘন।

কথা হলো,যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে এরা শীর্ষ কর্মকর্তা। তারা নিজেরা মাঠে কোনো অপরাধ দমন করতে যান না, পরিচালনা করেন। সেক্ষেত্রে এমন কোনো তথ্য এখন অবদি আমরা পাইনি, তারা সম্মতি দিয়েছেন গুলি করে কাউকে মেরে ফেল। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মানবিক ভূমিকা পালন করেছে। মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা যদি আন্তরিক থাকে তাহলে দেশটিতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের জায়গা হয়েছে কেন? তারপরে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন দেশের যত জঙ্গি আছে তাদেরও জায়গা হয়েছে। যখন বাংলাদেশ জঙ্গি দমনে তৎপর তখনও র‌্যাবের বিরুদ্ধে কথা উঠেছে। যে র‌্যাব জঙ্গি দমনে বাংলাদেশে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। এটি রাজনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ইস্যু তৈরি করা হয়েছে।

সারা বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সোচ্চার। মানবাধিকারের পাশাপাশি গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নিশ্চিতে নিজেদের সক্রিয় দেখাতে নানা তৎপরতা প্রদর্শন করে দেশটি। তবে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে পুলিশের গুলিতে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। অনেকটা একই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনেও।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশের বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নৃশংসতা নিয়ে সারা বিশ্বেই ব্যাপক হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন পুলিশের হাতে বিচারবহির্ভূত উপায়ে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে বহু প্রতিবাদ-বিক্ষোভও হয়েছে।

তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডে ২০২০ সালের ১ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে পুলিশের গুলিতে ৭ হাজার ৬৬৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে পুলিশের গুলিতে ১ হাজার ১০৬ জন, ২০১৪ সালে ১ হাজার ৫০ জন, ২০১৫ সালে ১ হাজার ১০৩ জন, ২০১৬ সালে ১ হাজার ৭১ জন, ২০১৭ সালে ১ হাজার ৯৫ জন, ২০১৮ সালে ১ হাজার ১৪৩ জন এবং ২০১৯ সালে ১ হাজার ৯৮ জন নিহত হয়েছেন।

প্রতিবেদনে যে ৭ বছরের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তার মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৪৩ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আর ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে বছরে গড় প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ১১০০ জন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশের গুলিতে হতাহত হয়েছেন। এই পরিসংখ্যানে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু অথবা অন্য পদ্ধতিতে নিহত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

এছাড়া ওই সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক অসম হারে পুলিশের গুলিতে নিহত বা আহত হয়েছেন, যা একইভাবে হতাহত শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি। অবশ্য বছরের পর বছর ধরে চলা মার্কিন পুলিশের এই নৃশংসতা ও বর্বরতার কারণে বাহিনীটির সংস্কার দাবিতে বহুবার বিক্ষোভ হয়েছে, এমনকি বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্কও।

অনেকটা একই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের পরিসংখ্যানেও। ২০১৪ সালে মাইকেল ব্রাউন নামে নিরস্ত্র এক কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর থেকে প্রভাবশালী এই মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের হিসাব রাখা শুরু করে।

২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা টানা চার বছর ধরে এক হাজারের আশপাশেই রয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে পুলিশের গুলিতে ৯৯৮ জন নিহত হয়েছিলেন। ২০১৭ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৯৮৭। অর্থাৎ ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে ১১ জন বেশি মারা গেছে। এছাড়া ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে নিহত মানুষের সংখ্যা ৯৬৩ জন এবং ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯৯৫ জন।

বাংলাদেশের একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মিডিয়ার কাছে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘যখন কোনো একটি বিদেশি সংবাদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করে তখন নিঃসন্দেহ এটি রাজনৈতিক। এটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার উদ্যোগ। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তথ্যভিত্তিক হয় বলে আমি মনে করি না। পদ্মা সেতুর নিয়ে যে দুর্নীতির কথা বলল সেটা তখন টিকল না। বাংলাদেশের পলিটিক্যাল অপজিশনরা যারা প্রতিনিয়ত এ বিষয়টি নিয়ে বলেন, তারা তাদের অনুসারীরা এনজিওদের মারফ তথ্য নিয়ে ইমেইল করেন। এটাকে আমরা বলি কান কথা। কান কথা শুনে সেটির ওপর যদি বড় বড় গল্প বানিয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তাহলে সেটি সঠিক হবে না। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে বাংলাদেশকে বর্তমানে চীন বিরোধী যে প্রক্রিয়া আছে সেখানে ব্যবহার করতে চাওয়া হয়েছে, কিন্তু সেটা হয়নি। না হওয়ার ফলে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার জন্য চাপ সৃষ্টি করার। এটা নিয়ে চিন্তা বা উদ্বেগের কিছু দেখছি না।’

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস