ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মিয়ানমার : জান্তা, সু চি এবং গণতন্ত্রের যাত্রা

ড. মাহবুব হাসান | প্রকাশিত: ১০:১৪ এএম, ১২ ডিসেম্বর ২০২১

প্রায় সব সময়ই জান্তার শাসন ছিল মিয়ানমারে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি স্বাধীনতার পর থেকে খুবই স্বল্পসময়ের জন্য ওই দেশে গণতান্ত্রিক শাসন কার্যকর ছিল। তার মানে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ তেমনভাবে স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। দেশটি স্বাধীন হলেও তারা পরাধীনই ছিল জান্তা শাসনে। ভিনদেশি শাসক আর জান্তাদের মধ্যে চেতনাগতভাবে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সেটা বহুভাবেই মিয়ানমারের জনগণ বুঝেছে। তাই আজ তারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে।

দিন কয়েক আগে সামরিক আদালতে বিচার করে গণতন্ত্রের মানসপুত্রীখ্যাত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চিকে চার বছর জেল দেয়া হয়। করোনাবিধি ভঙ্গ এবং বর্তমান সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দেওয়ার অপরাধে তাকে ২+২=৪ বছরের জেল দেয়া হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও ঘৃণা প্রকাশের পর সেনাপ্রধান চার বছরের জেল দুই বছরে নামিয়ে আনেন। সুচি’র বিরুদ্ধে আরও ৯টি মামলা করেছে জান্তা সরকার। সেগুলোর বিচারও রাজধানীর নেপিডোতে স্থাপিত সামরিক আদালতেই হবে। ধারণা করা হচ্ছে ওইসব মামলায় তার ১০০ বছরের জেল হতে পারে। সু চির বয়স এখন ৭৬ । তিনি মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতীক হয়ে ওঠেন যখন তিনি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং গৃহবন্দিত্ব যাপন করছিলেন।

তিনি ১৫ বছরই জান্তা সরকারের হাতে গৃহবন্দির জীবন যাপন করেছেন। সেই ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি গৃহবন্দি ছিলেন। তারপর তিনি রাজপথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি [এনএলডি] বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যায় এবং তিনি স্টেট কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই তিনি তিনটি আইনের দুটি বাতিল করেন একটি সংস্কার করেন। ১৯৭৫ সালের ‘রাষ্ট্র সুরক্ষা আইন ও ১৯৫০ সালের ‘জরুরি অধ্যাদেশ আইন বাতিল করেন। তৃতীয়টি হচ্ছে ‘ওয়ার্ড অ্যান্ড ভিলেজ ট্র্যাক অ্যাডমিনিস্ট্রটর ল’ আইন সংশোধন করেন।

এছাড়া ২০১৮ সালে রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড বলে খ্যাত ‘জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট, যা মূলত জনপ্রশাসন বিভাগকে ভেঙে দিয়ে তাকে একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করে সু চির সরকার। গত বছরের নভেম্বরে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে এনএলডির ভূমিধস বিজয় জান্তাকে ক্ষিপ্ত ও বেপরোয়া করে তোলে। বোধকরি সে কারণেই সেনারা ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখল করে অস্ত্রের জোরে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস বলে অস্ত্রের চেয়ে নিরস্ত্র জনগণের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কাছে সবই তুচ্ছ। মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ, জান্তার ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ মিছিল করে গণতন্ত্রের পথ পরিষ্কারের চেষ্টা চালাচ্ছে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, জান্তা বিচার করে দুটি মামলায় তাকে চার বছরের জেল দেওয়ার পর আবার সেই রায় সংশোধন করে দুই বছরে নামিয়ে আনলো কেন? সে কি বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের কারণে? নাকি অং সান সু চি’র প্রতি দয়া দেখিয়ে? কোনটা যে ঠিক, তা এখনো বলার সময় আসেনি। তবে ধারণা করা অন্যায় হবে না যে সু চি’র ‘নীরব সমর্থনেই সেনাবাহিনী সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ক্লিনজিংয়ের মতো নারকীয় গণহত্যা চালাতে পেরেছিল। সেই বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের ১১ লাখ মানুষ এখন বাংলাদেশের ভারবাহী বোঝা হয়ে আছে।

রোহিঙ্গা ক্লিনজিংয়ে সমর্থনের ‘পুরস্কার’ হিসেবে সু চির প্রতি দয়াপরবশ হয়ে জেলজীবন দুই বছর কমিয়ে দিয়েছে। এটা আমরা যেমন মনে করতে পারি তেমনি বিশ্বসম্প্রদায়ও মনে করতে পারে। গণতন্ত্রে প্রহরী ও মানবতার প্রতি নিরাপোষী একজন নেতা কি করে রোহিঙ্গা নিধনে ও বিতাড়নে নীরব সায় দিয়েছিল তারই সরকারের আমলে এবং তিনি তখন স্টেট কাউন্সিলর। ভাবলে অবাক হতে হয়, একজন স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানি অং সানের মেয়ে অং সান সু চি গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনীতিকের এমন অরাজনৈতিক ও সামরিক শাসক তোষণ সম্ভব হলো? সে কি এজন্য যে সামরিক ধারার ভেতরে থেকে, সামরিক জান্তাদের সহযোগী হয়ে ২০১৫ সালে ক্ষমতায় যাওয়া নেত্রী সু চি এমন অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

মিয়ানমারে প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারির ক্যুদেতাদের ক্ষমতা দখলের পরই। প্রথমে প্রতিবাদ মিছিল মিটিং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। সেই প্রতিবাদে সু চির মদত ছিল। সেই অপরাধেই তাকে জেল দিয়েছে সামরিক বিচারে। তিনি করোনা বিধি ভেঙেছেন, সেই অপরাধেও তিনি অভিযুক্ত। এরকম আরও ৯-১০টি মামলা দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে, যা নেপিদোর সামরিক আদালতে বিচারের অপেক্ষায়। এসবই সামরিক চাপ সুচির ওপর। এবং জনগণকে ভয়ের অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে তাদের জান্তা শাসন অবারিত করার উদ্দেশ্যেই। তারা সফল হতে পারেন এজন্য যে সাবেক অনেক সেনা যোগ দিচ্ছে সামরিক বাহিনীর আহ্বানে, কিন্তু সাধারণ মানুষ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে না। তারা সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। সাবেক সেনাদের নিয়োগ করা হয়েছে ওয়ার্ড অ্যান্ড ভিলেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের স্থানীয় প্রশাসনে। এরা জনগণেরই পাশে থাকে। তাদেরই অংশীদার। কিন্তু তারা ঠিক মতো স্থানীয় লোকদের শাসনে রাখতে পারছে না। তার কারণ, জনগণের অনেক পরিষেবা সামরিক জান্তা বন্ধ করে দেওয়ায়, তা হিতে বিপরীত ফল দিচ্ছে। অর্থাৎ জনগণ ক্ষেপে উঠছে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে জান্তার এমন অমানবিকতার আগুনে ঘি ঢালছে। ফলে জনগণ ও স্থানীয় আদিবাসীরা জোট বেঁধে জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোমর বেঁধে নেমেছে।

এছাড়া জান্তা মিলিশিয়া পিউ স্য তি গ্রুপকে নামিয়েছে জনগণকে শায়েস্তা করতে। এরা লোকদের ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে, ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। জান্তার পক্ষে দমনে কাজ করতে গিয়ে জনগণের ভেতরে জান্তাবিরোধী জনগোষ্ঠী সংগঠিত হচ্ছে মিলিশিয়াদের অত্যাচারে।

একটি বেসরকারি কিন্তু নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, অনেক সেনা সদস্য জান্তার পক্ষ ছেড়ে যোগ দিচ্ছে গণপ্রতিরোধ বাহিনীতে। সেখানে যোগ দিয়েছে আইনপ্রণেতাদের জোট ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট, গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনকর্মী এবং আদিবাসী রাজনৈতিক ও সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সাথে। ফলে এ গণপ্রতিরোধ বাহিনীর আকার বড় হচ্ছে। জান্তার পক্ষ ত্যাগকারীদের সংখ্যা ৮ হাজারের বেশি। প্রতিদিনই এদের সংখ্যা বাড়ছে।

বলা হচ্ছে, আদিবাসী এলাকায়, বিভিন্ন অঞ্চলে জান্তা তাদের শাসন ও প্রশাসন কার্যকর করতে পারেনি, পারছে না। আবার যেসব অঞ্চলে জান্তাদের শাসনের ছায়াও পড়েনি, সেখানে চলছে প্রতিরোধীদের প্রশাসন। ওই প্রশাসনের হাল ধরেছে গত নভেম্বরে ভোটে নির্বাচিত আইনপ্রণেতারা। তারা তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং জনগণের কাছে ওয়াদাবদ্ধ। এখন মিয়ানমারের জনগণ ভার্সাস জান্তার দ্বিমুখী শাসন চলছে। জান্তারা সীমিত, তবে তাদের আছে অস্ত্র আর প্রবল সামরিক সাহস। যদিও ওই প্রবল সাহস তারা মাদক সাম্রাজ্য গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলে প্রয়োগ করতে পারেনি কোনো সময়ই। বরং কোনো কোনো সময় সামরিক বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় মাদক অর্থনীতিকে বাড়তে সাহায্য করেছে তারা। আজও সেই গহীন অরণ্যবেষ্টিত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ কারেন বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণেই রয়ে গেছে। তারাও গণপ্রতিরোধীদের সঙ্গে, আদিবাসী সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়েছে।

ক্ষমতা দখলের পর থেকেই জান্তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তারা জান্তাদের বিরুদ্ধে যা করতে পারছে করছে। কেবল চীন নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রমাণ করছে তারা মিয়ানমারে গণতন্ত্র দেখতে চায় না, তাদেরই মতো কর্তৃত্ববাদী সামরিক প্রশাসন চায় মিয়ানমারে। ওই চাওয়ার পেছনে তাদের যেসব স্বার্থ আছে, তা গণতন্ত্রের চেয়েও ভালো বলে মনে করছে শি জিনপিং। মানুষের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব হলে কি হতে পারে সেটা বেশ ভালোই জানা আছে চীনের প্রেসিডেন্টের।

রোহিঙ্গা ক্লিনজিংয়ে যতোই নীরব ভূমিকা থাকুক না কেন, তারপরও আমরা অং সান সু চি’র পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে, মানুষের রাজনৈতিক ও মতপ্রকাশের অধিকারের পক্ষে। আমরা প্রতিবেশি বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবসানে জান্তা সরকার যদি সত্যটা মেনে নেয়, অর্থাৎ রোহিঙ্গারা যে শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে রোসাঙ্গের অধিবাসী, তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে সেই জন্মভূমিতে। বাংলাদেশে ওই রোহিঙ্গা মুসলিমরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই অমানবিক পরিবেশের অবসান হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক, কবি, কলামিস্ট।

এইচআর/ফরুক/জেআইএম