ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মুরাদের বিদায় : রাজনীতি ‘ভাড়’ মুক্ত হোক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | প্রকাশিত: ১০:৩৯ এএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০২১

সংবিধান, আইন, রাজনীতি সবই সংসদকে ঘিরে চলবে এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কথা। কিন্তু রাজনীতি এখন সংসদের বাইরে। সংসদ অথবা সংসদের বাইরে যেখানেই হোক, রাজনীতির একটি নিজস্ব চরিত্র আছে। রাজনীতি মানে কিছু আদর্শ বা নীতির আলোকে জনগণকে সম্পৃক্ত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার এক কৌশল। কাজেই, রাজনীতিতে এক পক্ষের আদর্শের সঙ্গে আরেক পক্ষের আদর্শগত তফাৎ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই রাজনৈতিক বিরোধিতা। রাজনৈতিক বিরোধিতা রাজনীতির সৌন্দর্য। তাই রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের কৌশলও হওয়া চাই সৌন্দর্যমণ্ডিত। শিষ্টাচারের মাধ্যমেই রাজনৈতিক বিরোধিতা প্রকাশ করতে হবে। উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিগুলোতে এটাই হয়। অতীতে আমাদের দেশেও তাই হয়েছে।

রাজনীতি ও গণতন্ত্রের নিম্মগামী প্রবণতায় সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজনীতিতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা বাদ পড়ে সেখানে ফটকাবাজ ও হাইব্রিড রাজনীতিকরা ঢুকে পড়ে। এর ফলে শত বছরের একটি পুরনো রাজনৈতিক দলও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চাকচিক্যময় চেহারার অন্তরালে ভেতরে ভেতরে দলের মৌলিক চেতনায়ও ফাটল ধরতে পারে। এরা দল থেকে যা নেওয়ার নিয়ে স্বার্থ উদ্ধার হলে কেটে পড়ে। এরাই শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগ ও খালেদা জিয়ার চেয়ে বেশি বিএনপি।

এ অতি রাজনীতিকরা স্বার্থ আদায়ের ধান্দায়, পদ-পদবি লাভের দৌড়ে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ধার ধারেন না। রাজনীতিতে এখন প্রতিপক্ষকে যত কটুবাক্যে আহত করা যায় ততোই যেন আক্রমণকারীরা বাহবা পান। কাগজে কলমে বিরোধী দল হচ্ছে জাতীয় পার্টি। কিন্তু আমরা দেখি সরকারি দলের কিছু নেতাকে অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে। সেই বিষোদগার শিষ্টাচারের সঙ্গে করলে তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু সেই সমালোচনা বা বিষোদগার যদি অশ্রাব্য হয় তবে তা সামগ্রিকভাবে আমাদের রাজনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সম্প্রতি প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান বিএনপির সমালোচনায় উঠে-পড়ে লেগেছেন। তা তিনি করতেই পারেন। কিন্তু গত মাস দুই ধরেই তার এ সমালোচনা অশ্রাব্য বাক্যবাণে পূর্ণ থাকে। তার বাচনভঙ্গি ও মুখের ভাষা কোনোভাবেই রাজনৈতিক শিষ্টারের সঙ্গে যায় না। তিনি ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য একাধিক জায়গায় বক্তব্য দেওয়া শুরু করলেন। হঠাৎ করে কেন তিনি ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার আলোচনা তুললেন সেটা আজও বোধগম্য নয়। সরকার চাইলে যেকোনো সময়ই এটা করতে পারে। এজন্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি আছে। এ মুহূর্তে সরকারের সে রকম কোনো এজেন্ডা আছে বলেও মনে হয় না। কারণ, সরকারের অন্য কোনো মন্ত্রী বা দলের অন্য কোনো নেতাই এ নিয়ে কথা বলছেন না। তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে একাই মাঠ গরম করে যাচ্ছিলেন। সরকার, বিরোধী দল, সংসদ ও জনগণ তার এ বক্তব্য শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিল।

’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া নিয়ে তার এ বক্তব্য নিয়েও তেমন সমালোচনার জায়গা নেই। তিনি রাজনীতিক। এছাড়া আওয়ামী লীগ নীতিগতভাবে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে চায়। এ কথা দলটির অনেক নেতা আগেও বলেছেন ও ভবিষ্যতেও বলবেন। কিন্তু এই আলোচনার রেশ ধরেই তিনি বিএনপি ও জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে একের পর অরুচিকর মন্তব্য করেই যাচ্ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার এ বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। এবং তার সব পরবর্তী বক্তব্যই আগের বক্তব্যের চেয়ে অরুচিকর ও অশ্রাব্য।

এরই ধারাবাহিকতায় সবশেষে এক অর্বাচীন উপস্থাপকের সঙ্গে তিনি এক ফেসবুক টকশোতে আবির্ভূত হয়েছেন। এতে তিনি খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও তারেককন্যা জাইমা রহমান সম্পর্কে যে ভাষায় ও অভিব্যক্তিতে কথা বলেছেন, শিষ্টাচারের কোনো নিয়মের মধ্যেই তা পড়ে না। উপস্থাপক ও বক্তার ভাষা এবং বাচন যারপর নাই অসহ্য ও অরুচিকর। ক্ষমতা আর দম্ভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। ডা. মুরাদ তার সব বক্তব্যে সেটাই প্রমাণ করলেন। কিছু টকশো উপস্থাপকের নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন। প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু নাহিদ নামে এই অর্বাচীন উপস্থাপকের অনভিপ্রেত ও গাজ্বালা করা বাচনভঙ্গিতে দর্শকমাত্রই বিরক্ত হয়েছেন। এই উপস্থাপক উসকানিমূলক প্রশ্ন করেছেন। আর ডা. মুরাদও লাগাম ছাড়া বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন।

রাজনীতিতে রেষারেষি নতুন কিছু নয়। এই রেষারেষি শুধু বিরোধী পক্ষের সঙ্গে নয়। রাজনীতিতে গুরু-শিষ্য রেষারেষিও কম হয় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হকদের সঙ্গে মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী, নুরুল আমিন, সবুর খান, মোহন মিয়া, লাল মিয়াদের চরম রাজনৈতিক বিরোধ ছিল। সেই রাজনৈতিক বিরোধ কোনোদিন মিটেনি। তারা কোনোদিন এক হননি। কিন্তু বিরোধিতা কখনো শিষ্টাচারের সীমারেখা অতিক্রম করেনি।

১৯৭০ এর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনী প্রচারের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা থেকে বিমানে সিলেটে যাচ্ছিলেন। সফরসঙ্গীদের মধ্যে কয়েকজন সাংবাদিকও ছিলেন যাদের একজন ছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অফ পাকিস্তানের চিফ রিপোর্টার আমানুল্লাহ। শেখ মুজিব বসেছেন সামনের সারির একটি আসনে। তার পেছনের একটি আসনেই বসেছিলেন আমানুল্লাহ। কথা বলার এক ফাঁকে বঙ্গবন্ধু ঘাড় কাত করে বললেন, আমান, নির্বাচনে আমরা জিতবোই। তবে খয়রাত ভাই ও বদু ভাই পার্লামেন্টে থাকবে না এটা ভেবে আমার খারাপ লাগছে।

খয়রাত হোসেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। দলের সহ-সভাপতিও ছিলেন। ১৯৫৪ সালের শেরেবাংলার নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক সরকারে শেখ মুজিব ও তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকেননি। বঙ্গবন্ধুর ‘বদু ভাই’য়ের আসল নাম হল বদরুদ্দোজা হাবিবুল্লাহ। বিডি হাবিবুল্লাহ নামেই তিনি বেশি পরিচিত। আর সাংবাদিক আমানুল্লাহ বিডি হাবিবুল্লাহর ছেলে।

বঙ্গবন্ধু দুজনকেই সম্মান করতেন। কিন্তু ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়েছিল। সেখানে অন্য কারও পক্ষে নির্বাচনে জয়ী হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। এটা জেনেই বঙ্গবন্ধু এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। তার কথার মর্মার্থ হলো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একচেটিয়া জয় পাবে, কিন্তু খয়রাত হোসেন ও বিডি হাবিবুল্লাহর মতো দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান সেখানে থাকবেন না (ইতিহাসের সাক্ষী/মহিউদ্দিন আহমেদ)।

রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষের নেতাদের প্রতিও যে এমন শ্রদ্ধাবোধ লালন করা যায় তা বঙ্গবন্ধু ও তার সমসাময়িক নেতাদের জীবনী পাঠে আমরা জানতে পারি। কিন্তু সে শ্রদ্ধাবোধ তো অনেক আগেই গেছে। এখন সামান্য ভাষাগত যে শিষ্টাচারটুকু অবশিষ্ট ছিল ডা. মুরাদ সেটি প্রদর্শনেও ব্যর্থ হয়েছেন। তলে তলে আরও ডা. মুরাদ থাকতে পারে। দলকে এসব খুঁজে বের করতে হবে। এরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হতে পারেন না।

তার বক্তব্যে তার দাম্ভিকতার বহিঃপ্রকাশ প্রকট। আমি ডাক্তার, আমি রাজা, আমি মন্ত্রী-এসবই তার অসুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক। একজন মানুষের মুখ খারাপ এটা কী করে গর্বের বিষয় হতে পারে? কিন্তু এনিয়েও তিনি রীতিমতো গর্ব করেন। এমন মুখ খারাপ প্রতিমন্ত্রীর মাধ্যমে দল কোনোভাবেই লাভবান হতে পারে না। কিন্তু সব কিছুরই শেষ আছে। দর্পচূর্ণ বলতে একটা কথা আছে। সবশেষ, চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে তার নানা অশোভন কথাবার্তার একটি ফোনালাপ ৬ তারিখ মধ্যরাতে ভাইরাল হয়। ওই ভাইরাল ফোনালাপে তিনি একইভাবে অশ্রাব্য, অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ ও নানা বিকৃত কথা বলেছেন। কোনো একজন সাধারণ নাগরিকের সঙ্গেও কোনো রাজনীতিক এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। এর মাধ্যমে প্রতিমন্ত্রীর পদে থাকার নৈতিক যোগ্যতা তিনি হারিয়েছেন। এমনকি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের হুমকিও তার বক্তব্যে রয়েছে।

তিনি সমালোচনার ধার ধারেন না। সমালোচকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “সমালোচকদের আমি বলবো, আসসালামু আলাইকুম, আপনি ভালো থাকেন, সুখে থাকেন, শান্তিতে থাকেন। আপনাদের এই গালিগালাজ আমাকে কোনোরকম ক্ষতি করতে পারবে না।” কিন্তু কথায় আছে, অতি আওয়াজে ব্যাঙ মরে। অতি দর্পে হতা লঙ্কা। গদির গরম সবার সহ্য হয় না। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মন্ত্রিসভা থেকে তার বহিষ্কারাদেশ দিয়েছেন। সরকার ভারমুক্ত হলো। এবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। দলকেও ভারমুক্ত করতে হবে। তার সব দলীয় সদস্য ও অন্যান্য পদ কেড়ে নেওয়া জরুরি।

তার যেসব মন্তব্য ও ফোনালাপ আইনত বিচার্য সেগুলোর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু করতে হবে। দণ্ডবিধি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য আইনে তার এসব মন্তব্য আমলযোগ্য অপরাধ। এসব রাজনৈতিক ভাড়দের থেকে সরকার, দল ও রাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে।

লেখক : আইনজীবী ও কলাম লেখক।

এইচআর/জেআইএম