রাজনীতি কি পথ হারা?
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি সরকার দেবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে গত ৫ ডিসেম্বর আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য থেকে অনেকে মনে করছেন, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে বিএনপির আন্দোলনের কথা অব্যাহতভাবে বলে যাওয়া, কিছু সভা-সমাবেশ করা এবং বিএনপিপন্থি আইনজীবী ও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার হয়তো কিছুটা নমনীয় হয়েছে। আইনের মধ্যে থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশ পাঠানোর কোনো সুযোগ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী।
অন্যদিকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে পর্দার আড়ালে কিছু তৎপরতার কথাও শোনা যাচ্ছে। সরকার খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ইস্যুতে বিএনপিকে এমন ছাড় দিতে চায় না, যা থেকে তারা রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার দাবি করতে পারে। খালেদা জিয়ার জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বিশেষ কোনো সহানুভূতি বা দুর্বলতা যে নেই সেটা এরই মধ্যে পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। নেপথ্যে কোনো সমঝোতা হলে আজকের অসম্ভব আগামী কালই সম্ভব হয়ে উঠতে পারে। তবে সরকার যেসব শর্তে বেগম জিয়ার প্রতি নমনীয়তা দেখাতে চায়, বিএনপি, বিশেষ করে খালেদা জিয়ার পক্ষে সেসব শর্ত মানা খুব সহজ নয়।
রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা সরকার বলছে। কিন্তু এটা দল মানতে চাইলেও খালেদা জিয়া মানবেন বলে মনে হয় না। তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন না, এটাও সম্ভবত বেগম জিয়া মেনে নেবেন না। তবে এটাও ঠিক যে, সরকারি শর্ত মেনেই বেগম জিয়া এখন জেলের বাইরে আছেন। তার দণ্ড স্থগিত করা হয়েছে। তিনি রাজনীতি থেকে কার্যত দূরেই আছেন। তার শারীরিক অবস্থা এখন যেমন আছে তা থেকে তিনি যদি কিছুটা আরোগ্য লাভও করেন, তাহলেও তার পক্ষে আর আগের মতো সচল জীবনযাপন সম্ভব হবে না। তিনি যেসব রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, সেসব রোগ পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিলেও তিনি কতটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না।
পরে কি হবে সেটা একজন গুরুতর রোগীর চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনার বিষয় হতে পারে না। বেগম জিয়া একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান নেত্রী। তার প্রতি দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষের সমর্থন রয়েছে। তার বয়সও হয়েছে। সব মিলিয়ে উন্নত চিকিৎসা পাওয়া তার অধিকার আছে। তিনি দণ্ডিত, এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক যে তার চেয়ে বড় অপরাধ করেও মার্জনা পাওয়ার রেকর্ড আমাদের দেশেই আছে।
সরকার যদি আইনকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবতো তাহলে কেন প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী ক্ষমতাবলে তার দণ্ড স্থগিত করলেন? আইন থাকলে তার ফাঁকফোকড়ও থাকে। তাই সরকার চাইলে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দেওয়া অসম্ভব কিছু হতে পারে না। বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন। তার মধ্যে উদারতার ঘাটতি ছিল। এখন আওয়ামী লীগ তার বদলা নিতে চাইলে সেটা শোভন হয় না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি সিদ্ধান্ত হয় তা এখন দেখার বিষয়।
বিএনপি সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে বৃহত্তর ঐক্যের কথাও বলছে। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে কারা নতুন করে ঐক্য গড়ে তুলবে বা তেমন ঐক্য গঠনের অবস্থা তৈরি হলে সরকারের অবস্থান কি হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। বিএনপি তার পক্ষে শক্তি যোগ করতে চাইলে আওয়ামী লীগ এবং সরকার বসে বসে তামাশা দেখবে না। সরকার পক্ষ থেকেও পাল্টা গুটি চালানোটাই স্বাভাবিক। বিএনপির নেতৃত্বে যে ২০ দলীয় জোট আছে, সে জোটই এখন সংকটে আছে।
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। এটা মেরামত হবে, নাকি আরও তিক্ততা বাড়বে, তা-ও বলা মুশকিল। জামায়াত নিয়ে বিএনপির মধ্যেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বন্ধু মনে করার শক্তিও সক্রিয় আছে। ইসলামি আরও দুটি দল বিএনপি জোট ছেড়েছে। কল্যাণ পার্টিও বিএনপির জোট ছাড়তে চায়। বিএনপি নেতৃত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন কল্যাণ পার্টির মধ্যে। মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বিএনপির সঙ্গে চলতে আর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়া সক্রিয় হয়ে উঠতে অসমর্থ হলে বিএনপিতে নেতৃত্বের সংকট আরও বাড়বে। তখন বিএনপির পক্ষে জোটের নেতৃত্ব দেওয়া কঠিন হবে।
বিএনপি নেতারা বক্তৃতায় বড় বড় কথা বললেও বাস্তবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হয়নি, যাতে সরকার চাপ অনুভব করতে পারে। ফলে কথার লড়াইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে বিএনপির আন্দোলন। খালেদা জিয়ার ইস্যু শেষ হলে সামনে আসবে নির্বাচনের ইস্যু। আগামী নির্বাচন সরকারের জন্য যেমন, তেমনি বিএনপির জন্যও চ্যালেঞ্জ। সরকারকে ওয়াকওভার দিলে বিএনপির অস্তিত্ব সংকট দেখা দিতে পারে।
দৃশ্যত সরকারকে নিরাপদ মনে হলেও সরকারের ভেতরেও সংকট বাড়ছে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা সরকারের জন্য বড় সমস্যা। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে ছবি দেখা যাচ্ছে তা খুব উৎসাহ জাগানিয়া নয়। দলের মধ্যে বিরোধ-কোন্দল অত্যন্ত প্রবল। সবাই নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে চায়। যার ভাগ্যে নৌকা জোটে তার বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে ঐক্য। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী অপরাপর শক্তিগুলো আওয়ামী লীগের কোন্দলে বাতাস দিয়ে একটি অফিসিয়াল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পাল্টা বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ গড়ে তুলছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যেও আছে ক্ষোভ-অসন্তোষ। আগামী নির্বাচনে ১৫ দলীয় জোট অটুট থাকবে কি না, সে প্রশ্নও সামনে আসছে। জোটের বামপন্থি দলগুলো আওয়ামী লীগের ওপর কিছুটা বিরক্ত বলে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি সরকার অনুগত বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির নেতারাও উল্টো সুরে গীত গাইতে শুরু করেছেন। জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ৪ ডিসেম্বর দলীয় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জাতীয় পার্টি আর কোনো জোট না করে আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। তিনি আরও বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের (জাপার) আর কোনো প্রেম নেই। আমাদের সঙ্গে প্রেম করে আওয়ামী লীগ তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় গেছে। এখন আমাদের ওপর নির্যাতন করছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা করছেন, প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠ থেকে উঠিয়ে দিতে চাচ্ছেন।
জাপা নেতার বক্তব্য নিঃসন্দেহে ক্ষোভের বহির্প্রকাশ। তারা কার্যকরবিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে অনেকেই মনে করেন না। একবার সরকারের পেটে ঢুকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া খুব সহজ নয়। জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, প্রয়োজন ছাড়াই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তেলের দাম বাড়ালে প্রতিটি পণ্য ও সেবার দামও বেড়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষের কষ্টও বেড়ে যায়।
বর্তমানে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন। কৃষক যে পণ্য ৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করেন, তা হাত ঘুরে রাজধানীতে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। করোনায় অপরিকল্পিত লকডাউনের কারণে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। বেকারের সংখ্যা আরও বেড়েছে। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/জেআইএম