বন্ধু রাষ্ট্র ভারত: আমাদের প্রাপ্তি, তাদের ত্যাগ
‘আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এই যুদ্ধ আমার সরকার ও ভারতের জনগণের ওপর বিরাট দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। দেশকে যুদ্ধ মোকাবিলা করার জন্য তৈরি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের জওয়ান ও অফিসারদের দেশের প্রতিরক্ষার জন্য সীমান্তে পাঠানো হয়েছে। সমগ্র ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। ...সহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা ও অনড় ঐক্যের সঙ্গে ভারতের জনগণ এই আক্রমণের মোকাবিলা করবে।’
-শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী
"Good fences make good neighbours"
-Robert Frost (Mending Wall)
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল তখনও উত্তপ্ত। সেই উত্তাপ থামাতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিবেশী ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। ১৯ শতকের আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট তার মেন্ডিং ওয়াল কবিতায় বলেছেন, প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের নিজ দেশ ব্যতীত অন্য প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করলে তাদের মধ্যকার সম্প্রীতি বজায় থাকে। কিন্তু ১৯৭১ এ উপমহাদেশের তিনটি দেশ বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে এক জটিল সমীকরণ। বলা হয়ে থাকে যে, ভারত-বাংলাদেশ পরীক্ষিত বন্ধু। এর কারণ হলো ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত থেকে বাঙালি মুসলমানরা বিচ্ছিন্ন হয়ে হাত ধরে নির্ভর করে পাঞ্জাবি পশ্চিম পাকিস্তানিদের ওপর। কিন্তু বিধি বাম। এই নির্ভরতা এর সম্পর্ক খুব বেশি দিন স্থায়ী হলো না। মাত্র দুই যুগের ব্যবধানে ধর্মনির্ভর পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তান অস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি। এমনি নাজুক মুহূর্তে বাঙালি জাতির প্রয়োজন ছিল একটি দৃঢ় হাতের ভরসা। তাই ১৯৪৭-এ যে ভারত থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল; ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সেই ভারতের সাথেই বাংলাদেশ গড়লো যৌথবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে ভারত কীভাবে জড়িয়ে পড়েছিল? কীভাবে নবীন একটি দেশকে সাহায্য করেছিল; আর এই যুদ্ধে ভারত কী প্রাপ্তি ও ত্যাগ স্বীকার করল- তা অনুসন্ধান করা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করার নামান্তর।
১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ ও ভারত সরকার মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথবাহিনী বা যৌথ কমান্ড গঠন করলে নাটকীয়ভাবে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি বদলে যেতে থাকে। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে কমান্ডের অধিনায়ক করা হয় এবং যৌথ কমান্ডের প্রধান হন ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকষ। পাকিস্তান সরকার ২৩ নভেম্বর সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
পাকিস্তান এ সময় কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পরিণত করে বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিতে চেয়েছিল। এজন্য ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান অতর্কিতভাবে ভারতের বিমান ঘাঁটি, অমৃতসর, পাঠানকোট, আগ্রা ও শ্রীনগর এর ওপর বিমান হামলা চালায়। তাই মুক্তিযুদ্ধের ভারতের জড়িয়ে পড়ার পেছনে কারণ হলো তাদের সার্বভৌমত্বের হুমকি মোকাবিলা করা। এটি ছিল সময়ের দাবি। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেল পাকিস্তান ভারতের ভিতর বোমা ফেলার খবরে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা মোটেও উদ্বিগ্ন হলেন না। বরং এ ধরনের একটি সংবাদের জন্যই ভারতীয় সেনাবাহিনী অপেক্ষায় ছিল। ‘‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’’- বইতে জে. জ্যাকব লিখেছেন, ‘‘অরোরা ছিলেন খুবই উৎফুল্ল। তিনি তার এডিসিকে মেস থেকে এক বোতল হুইস্কি আনার নির্দেশ দিলেন । আমরা বুঝে নিলাম যে আগামী বেশ কিছুদিন আর বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া যাবে না।’’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের পর পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ইউএনএইচসিআর তথ্যমতে কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকে ভারত পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হবার এক সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের স্বীকৃতি চেয়ে চিঠি দেন বাংলাদেশ সরকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কিন্তু কৌশলগত কারণে ভারত ছিল তখন সাবধানী। মুজিবনগর সরকার ভারতে বসেই পরিচালিত হতো এতে ভারত সরকারের সর্বাত্বক সহায়তা ছিল। এছাড়া মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা ভারতের ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং ভারত তাদের অস্ত্র সরবরাহ করেছে। তথ্য মতে, ৮৩০০০ মুক্তিবাহিনী ও ১০০০০ মুজিব বাহিনী ক্যাডেট ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে বোঝানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী জুন মাস থেকে বিভিন্ন দেশে সফর শুরু করেন।
প্রকৃতপক্ষে সেসব সফরের মধ্য দিয়ে মিসেস গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক হস্তক্ষেপ এর ভিত্তি তৈরি করেন। ১৯৭১ সালের ২৪ মে ভারতের লোকসভায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘‘যে বিষয়টিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে, সেটি ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ পূর্ব পাকিস্তন থেকে যাওয়া শরণার্থীদের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘ভারতের ভূমি ব্যবহার করে এবং ভারতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে পাকিস্তান তার সমস্যার সমাধানের পথ করতে পারেনা। এটা করতে দেয়া যায় না।’’ ১৯৭১ এর মাঝামাঝি বিবিসিকে দেয়া অপর এক সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘‘সীমান্তে পাকিস্তনের সাথে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।’’ ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে পারে কিনা? এই প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে, জবাবে মিসেস গান্ধী বলেন, ‘‘আমি আশা করি ভারত সেটা করবে না। আমরা সব সময় শান্তির পক্ষে। আমরা আলোচনায় বিশ্বাস করি। তবে একই সাথে আমরা আমাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারিনা।’’
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অন্যতম উপদেষ্টা জি. ডব্লিউ চৌধুরীর মতে জুলাই মাসেই পাকিস্তান সরকার জানতে পারে যে, ভারত সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের গোপনে চীন সফর। ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টা মি. চৌধুরী তার ‘‘লাস্ট ডেইজ অফ ইউনাইটেড পাকিস্তান’’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে চীন সফরের পূর্বে রাওয়ালপিন্ডিতে গিয়েছিলেন। এই সময় ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে বিচলিত করে এবং এর ফলেই আগস্ট মাসের রাশিয়ার সাথে ভারত একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে।’’ ‘‘হোয়াইট হাউজ ইয়ার্স’’ বইতে মি. কিসিঞ্জার লিখেছেন, ‘‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতে থামাতে পারতো। কিন্তু তারা সেটি করেনি। প্রকৃতপক্ষে মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধকে উস্কে দিয়েছে।’’ তিনি এই মৈত্রী চুক্তিকে ‘‘বাম্বশেল’’ হিসাবে অভিহিত করেন।
অবশেষে ৬ ডিসেম্বরের এক কাঙ্ক্ষিত লগ্নে লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করলেন, ‘‘আমাদের মতো গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানাবার সিদ্ধান্ত। সমস্ত সদস্য করতালি দিয়ে টেবিল চাপড়ে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। তাদের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে সভাকক্ষ ফেটে পড়ে। এরপর ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এক রেডিও ভাষণে বলেন, ‘‘আমাদের যোদ্ধারা এখন ভারতীয় সেনাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে এবং তাদের রক্ত আমাদের রক্তের ধারার সঙ্গে মিশে গিয়ে আমাদের মাটিতে বইছে।’’ সে ভাষণে তাজউদ্দিন আহমেদ ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ভারতের ঐতিহাসিক স্বীকৃতিও যৌথ বাহিনী গঠন যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন ঘটে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় তখন শুধুই সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
অবশেষে এলো ১৬ ডিসেম্বর, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিজিত ও বিজয়ীবাহিনী প্রধান মুখোমুখি আজ বসেছে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। তবে আজ তাদের হাতে অসির পরিবর্তে রয়েছে মসি। ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে যৌথ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করলেন, ৯৩ হাজার পাক সেনা নিয়ে পাকবাহিনীর প্রধান সর্বাধিনায়ক জে. নিয়াজী। ভারতীয় সংসদ ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করলেন, ÔÔI have an announcement to make the West Pakistan forces have unconditionally surrendered. Dacca is now a free capital of a free country.ÕÕ
একদিকে চলছে যুদ্ধ জয়ের উল্লাস, বাঁধভাঙ্গা আনন্দের প্লাবন, অন্যদিকে চলছে হারানোর বেদনা। যেন ধ্বংস্ত‚পের ওপর থেকে মাথা তুলেছে লাল সূর্য। এই যুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের ক্ষয়ক্ষতি ছিল সমানুপাতিক ধারায়। কোন অর্জনই ত্যাগ ব্যতীত অর্জিত হয় না। এ সত্যতা অস্বীকারের অবকাশ নেই। মুক্তিযুদ্ধে ভারত প্রায় ২৩০৭ সৈনিক নিহত হয়েছে আর আহত হয় প্রায় ৬১৬৩ জন। সেনাদের মধ্যে নিখোঁজ হন ২১৬৩ জন। সমরাস্ত্রের মধ্যে ৭৩ টি ট্যাংক ও ৪৫ টি জঙ্গীবিমান নিখোঁজ হয়। এটি ছিল জানা কিছু ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান। অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েও ভারত বাংলাদেশকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশে সবসময় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে।
শরণার্থীদের আশ্রয় দান মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের ত্যাগের আরেক অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিদিন ২০ হাজার হতে ৪৫ হাজার অসহায় নিরস্ত্র বাঙালি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল (২৬ মার্চ হতে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ)। বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলিয়ে প্রায় এক কোটির মত লোক ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। এ বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর পেছনে ভারত সরকারের বিরাট অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এসব শরণার্থীর জন্য ভারত ও বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে যে অর্থ সাহায্য করেছে তার পরিমাণ ভারতীয় টাকায় ৫০ কোটি টাকার মতো বলে ভারতের তৎকালীন পুনর্বাসন সচিব জি. এস. কাহলেন এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতের ব্যয় হয় ২৬০ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, মোট ব্যয়ের হিসাব ধরা হয়েছিল ৫৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের পাশাপাশি ভারতের শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীগণ বেসরকারি পর্যায়েও ব্যাপক ভ‚মিকা রেখেছিল। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কে সভাপতি করে ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ-ভারত সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি গঠিত হয়। ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ পন্ডিত রবি শংকর আমেরিকার লস এঞ্জেলস-এ বাংলাদেশ কনসার্টের আয়োজন করে দশ লক্ষ ডলার ইউনিসেফকে দিয়েছিলেন শরণার্থী শিবিরের শিশুদের জন্য। মকবুল ফিদা হুসেনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবি এঁকে বোম্বের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য।
অন্নদাশংকর রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, শান্তিময় রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রণব রঞ্জন রায়, তরুণ সান্যাল, অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী, নির্মল চক্রবর্তী, রমেন মিত্র প্রমুখ কবি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন, গাইয়েরা বাংলাদেশের ওপর, বাংলাদেশের জন্য গান গেয়েছেন, নাট্যকর্মীরা নাটক করেছেন, ঋত্বিক ঘটক, শুকদেব আর মেহতারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সব মিলিয়ে ভারতের শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
বাংলাদেশের মুক্তি লগ্নে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারে বন্দি ছিলেন পুরোটা সময় জুড়ে। বিপর্যস্ত পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত বিশ্ব জনমতের চাপে আর ইন্দিরা গান্ধীর কঠোর অবস্থানের কারণে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লন্ডন হয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলায় ফিরবেন কিন্তু তিনি বাংলাদেশ এর দুঃসময়ের সঙ্গী ভারতকে ভুলতে পারেননি। তাই স্বদেশে ফেরার পথে সর্বাগ্রে ভারতের মাটিতে পা রাখলেন।
নয়াদিল্লির বিশাল জনসভায় তিনি আবেগঘন কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ÔÔI decide to stop at the historic capital of the country on way to my Bangladesh. For this is the least I could do to pay my personal tribute to the best friend of my people, the people of India and they covered men under the leadership of your magnificent prime Minister Mrs. Indira Gandhi.ÕÕ
১৯৭২-৭৩ সালে শুধু খাদ্য বা ভোগ্য পণ্য নয়, পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থার মেরামত ও পুনগঠনের জন্য এবং শিল্প কারখানার কাঁচামাল সরবরাহেও ভারত জ্বালানি তেল শোধনাগার (রিফাইনারি) জন্য অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করে জরুরি সহায়তা করেছিল। ভারত বেসামরিক বিমান ও জাহাজ সরবরাহ করে। নতুন দেশটির জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল খাদ্য। ১৯৭২-এর শুরুতে বাťলাদেশ একদিকে যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতি এবং আরেক দিকে পরপর দুবার শস্যহানীর কবলে পড়ে। ভারত সহায়তা হিসেবে শুধু ৪ লাখ টন খাদ্যশস্যই পরিবহণেও সহায়তা করে। প্রথম ছয় মাসে মোট পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তার ৭৪ শতাংশ ভারত দিয়েছিল। ১৯৭১-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২-এর জুনের মধ্যে ২০ কোটি মার্কিন ডলার দান হিসেবে এবং পণ্য আমদানি ও প্রকল্পের জন্য অত্যন্ত সহজ শতেΠ ৪.২ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫৭.৭ কোটি মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার পর দাতাদের মধ্যে এটাই ছিল দ্বিতীয় সর্ব্বেচ্চ সহায়তা।
‘‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা’’ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বিদেশী নাগরিকদের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। ২৫ জুলাই ২০১১ শ্রীমতি গান্ধীকে মরণোত্তর এই সম্মাননা প্রদান করে। ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে তার পুত্রবধু ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছ থেকে এই পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। ৩ কিলোগ্রাম ওজনের ক্রেস্টকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল ৪০০ বছরের পুরনো পোড়া মাটির উপর সোনার তৈরি ‘‘কদম গাছ’’ এবং একটি বাণী, এতে অঙ্কিত হয়েছিল- ‘মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বাংলাদেশের মানুষের পাশে ছিলেন। তিনি প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন কূটনৈতিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে মুক্তিযুদ্ধে সাহস যুগিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি দিতেই তিনি দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান চিরকাল স্মরণে থাকবে।’
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জিকেএস