ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাজনীতিহীনতাই কি ছাত্রসমাজকে দৃঢ়প্রত্যয়ী করছে?

ফারুক যোশী | প্রকাশিত: ১০:২০ এএম, ০৫ ডিসেম্বর ২০২১

জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে হয়তো পৃথিবীর সব জায়গায়। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়েছে উৎপাদিত পণ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এটা শুধু যানবাহনেই নয়। যদি আমি ধরি ব্রিটেনের কথা। এখানে তেলের দাম বেড়েছে। কিন্তু সেই হিসেবে হুট করে বাসভাড়া বাড়েনি। যানবাহন ব্যবহারকারীরা তেলের দাম বাড়ার সাথে সাথে যাত্রীদের ওপর জুলুম শুরু করতে পারেনি। কারণ দেশ একটা প্রক্রিয়ার মধ্যেই চলে। প্রতি বছরই কিছু কিছু করে দাম বাড়ে, বাসভাড়া ২০ বছর আগে যা ছিল, তা নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু চাকরিজীবী কিংবা শ্রমিকদের ঘণ্টাপ্রতি শ্রমের দামও সেই হারেই বেড়েছে।

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের বাসভাড়া কিংবা ট্রেন ভাড়াও সেই অনুপাতে কিন্তু টিকই আছে। সেকেন্ডারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেকেই মাত্র পাঁচ পাউন্ড দিয়ে একটা কার্ড করে নিতে পারে সারা বছরের জন্য, যা দেখিয়ে বাসে হাফের চেয়েও কম ভাড়ায় তারা যাতায়াত করতে পারে। মাত্র ৫ পাউন্ডের একটা কার্ড ব্যবহার করে অর্ধেক ভাড়ায় সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক টিকিট করে আনলিমিটেড যাতায়াত থাকে তাদের। দুদিন ছুটি থাকলেও এতে কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। কলেজেও সেই একই । বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের যেহেতু একটা বড় ধরনের লোন দিয়ে থাকে সরকার, সেহেতু যাতায়াতের জন্য তাদের আলাদা কোনো অর্থ না দিলেও মাসিক-বার্ষিক প্রভৃতি কার্ডে (টিকিটে) একটা বড় ধরনের কনসেশন পায়। অন্যদিকে সিনিয়র সিটেজেন অর্থাৎ অফিসিয়ালি অবসর নেয়া নাগরিকরা ফ্রি বাস চড়তে পারেন, ট্রেনে অর্ধেক ভাড়ায় দূরপাল্লার যাত্রা উপভোগ করতে পারেন তারা। এবং সুযোগগুলো শুধু লন্ডন অর্থাৎ রাজধানীভিত্তিকই নয়।

আমি বলি না, বাংলাদেশ তা-ই করবে। কারণ বাংলাদেশের উন্নয়ন-স্লোগান আপামর নাগরিকদের এখনও পুরোপুরি স্পর্শ করতে পারেনি। ছাত্র-শ্রমিক সাধারণ নাগরিক তাই কিছুটা হলেও উষ্মা প্রকাশ করে, কখনও গর্জে উঠে রাজপথ। আর সেজন্যই বাস্তবতার নিরিখেই বলতে হয় বাংলাদেশ হয়তো যুক্তরাজ্য কিংবা ইউরোপ আমেরিকার মতো অবস্থানে নেই। যদিও উন্নয়নশীল হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। উন্নয়নের অনেক কিছুই দৃশ্যমান, কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে রাজনীতির বরপুত্র-কন্যাদের দুর্নীতিতে তা চাপা পড়বেই। অর্থনীতির গতি এদের কারণেই বাধাগ্রস্ত হতে হতেই এগিয়ে যায়, যাচ্ছে। সেজন্যই সাধারণ মানুষের সমালোচনাকে সরকার ততটুকু গুরুত্ব না দিতে পারে যদিও, তবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো এসব দুর্নীতিকে উপেক্ষোও করা যাবে না।

চলমান সমস্যা-সংকটে থাকে পৃথিবীর সব দেশেই। মানুষের চাহিদা বিভিন্নভাবেই উচ্চারিত হয়। ব্রিটেনে মৌলিক চাহিদাকে সুনিশ্চিত করতে জনগণের দাবি-দাওয়া আছে প্রতিনিয়ত। সেজন্য বিভিন্ন কথা উচ্চারিত হয় সময়ে সময়ে। মানুষ সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার জন্য তার মৌলিক অধিকারগুলো থেকে নাগরিক বঞ্চিত হচ্ছে কি-না, তা নিয়েই বিরোধী দলগুলোর উচ্চারণ থাকে। সরকারও অনেক সময় বিরোধী দলের কথা বলার সুযোগ না দিয়েই জনগণের অধিকাংশ সমস্যাকে চিহ্নিত করে সমাধান খোঁজে। অর্থাৎ নাগরিকদের প্রয়োজনীয় এবং কাঙ্ক্ষিত চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে আগাতে হয় একটা রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রের প্রধান একজন মানুষ প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি রাষ্ট্র যারা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের কাছে নাগরিকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া করার অধিকার আছে, সংবিধানই তাদের সে অধিকার দিয়েছে।

রাষ্ট্র ধনিক শ্রেণিকে বাঁচিয়ে রাখে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত সংখ্যাধিক্য মানুষগুলো নিয়েই আমাদের বাংলাদেশ। এই মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত মানুষগুলোর সন্তানরা স্বাভাবিকভাবেই জায়গা করে নিয়েছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখো-কোটি আসন। উচ্চবিত্ত মানুষের সন্তানদের অনেকেই হয়তো বাস ব্যবহারই করে না। কিন্তু স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর সন্তানদের প্রতিদিনের যাতায়াতের জন্য ব্যয় করতে হয় উপার্জনের একটা বড় অংশ।

শত শত বাসের মালিকের যদি ব্যবসায়িক লাভালাভে সামান্য ঘাটতিই হয়, তবে সরকার তো সে ব্যাপারটা দেখতেই পারে। যুক্তরাজ্যেও কনজারভেটিভ পার্টি অর্থাৎ সরকারি দলের প্রতি মানুষ আঙুল তোলে বিভিন্ন সময়, এরা সাধারণ মানুষের অনেক দাবিই উপেক্ষা করে বলে একটা প্রচলিত আওয়াজ আছে। এরা ধনী মানুষের পক্ষে কথা বলে। স্বাভাবিকভাবে ব্রিটেনের সব মানুষও বিত্তবান তথা অতি ধনীর পর্যায়ে পড়েন না। কিন্তু নাগিরকদের মৌলিক অধিকারের কথা যখন প্রবলভাবে উচ্চারিত হয়, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকারও তার অবস্থান থেকে নড়তে বাধ্য হয়। শুধুই বিরোধী দল বলবে এবং তাদের কথা শুনেই আগাতে হবে, এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে না। কারণ দলের বাইরেও মানুষ থাকে। এবং এই মানুষদের নিয়েই রাষ্ট্র এবং সরকার।

বাংলাদেশের লাখ লাখ ছাত্রের কোনো দল নেই। কিন্তু শিক্ষা তাদের মৌলিক অধিকার। তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে ন্যূনতম সুযোগ-সবিধাটুকুও রাষ্ট্রের কাছে চাওয়া তাদের অধিকার এবং এগুলো বাস্তবায়ন করাও রাষ্ট্র নামক অভিভাবকের দায়িত্ব। ঢাকা শহর কিংবা রাজধানীই বাংলাদেশ নয়। ভিন্ন শহর আর প্রত্যন্ত অঞ্চল নিয়েই তো একটা দেশ । ঢাকা শহরে ছাত্রছাত্রীরা সুযোগ পাবে, তা-ও আংশিক; এটা কোনো ধরনের বৈষম্য।

তাছাড়া বাস মালিকপক্ষ করুণা দেখানোর কেউ হতে পারে না। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে সারাদেশ। ছাত্ররা যখন অধিকার আদায়ে রাস্তায় নামে, তখন পুলিশ এসে এদের ছত্রভঙ্গ করে। মালিকরা এসে রাষ্ট্রের পুলিশদের সহায়তা করে না। মালিকপক্ষ কেন বলবে আমরা হাফ ভাড়া নেবো, ছুটির দিনে পুরো ভাড়া দিতে হবে। দাবি তো সরকারের কাছে, প্রয়োজনে সরকারই ভর্তুকি দেবে মালিকদের, ছাত্রছাত্রীরা কেন ওই শোষণকারীদের করুণার পাত্র হতে হবে। কোনো সভ্যতাই এটা সমর্থন করে না।

অন্তত একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন। ম্লান করে দিয়েছে চলমান রাজনীতির শূন্যতা। যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। সেজন্যই সরকারের ঘোষণার আগেই বাস মালিকপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে হাফ ভাড়ার। আসলে বাংলাদেশে এখন চলছে একধরনের রাজনীতিহীনতা। প্রচলিত রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা এখন আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না। সাধারণ নাগরিক হতাশায়। সরকারের উন্নয়ন স্লোগানে যেমন সরকারদলীয় মানুষগুলো শুধুই জোয়ারের কথা বলছে, অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল এখন একটা মাত্র ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম রাখছে।

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে বড় বড় সমাবেশ করছে, যা শুধু বিএনপি ছাড়া আর কারও মাথাব্যথার নয়। কারণ দেশের রাজনীতির প্রধান প্রধান মানুষগুলো এবং লুটেরারাই চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। কারণ রাজনীতিবিদদের অর্থাৎ তাদের তৈরি করা চিকিৎসা ব্যবস্থায় তাদেরই কোনো আস্থা নেই, সেজন্য।

গত কয়েক বছরে যে ক'টা আন্দোলনে গর্জে উঠেছে বাংলাদেশ, সেগুলোর সবকটাই করেছে সাধারণ ছাত্ররা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝ থেকেই নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে এবং সত্যি কথা বলতে কি এরাই ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে সত্যিকার দাবিগুলো। অর্থাৎ এখন বাংলাদেশে এ সাধারণ ছাত্রসমাজই যেন কাজ করছে বিরোধী দলের হয়ে এবং তা তাদের দাবিদাওয়া আদায়ের স্বার্থেই। এখানে প্রচলিত রাজনীতি তাদের স্পর্শ করেনি।

ছাত্রছাত্রীদের দাবিগুলোতে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং অভিভাবকদের সমর্থন আবারও প্রমাণ করছে, রাজনীতিতে ভোট-গণতন্ত্র-খালেদা জিয়ার চিকিৎসা-উন্নয়ন এগুলো বাংলাদেশের রাজনীতির মৌল ইস্যু নয়, ন্যূনতম অধিকারকে মানুষ এখনও প্রাধান্য দিচ্ছে। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার আন্দোলন যেমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থার দেউলিয়াত্ব, ঠিক তেমনি শিক্ষার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্রছাত্রীদের মাঠে নামা এবং জোটবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়েই আবারও প্রমাণিত হচ্ছে এখনও তরুণরাই প্রধান শক্তি এবং এরাই ছিনিয়ে আনতে পারে কাঙ্ক্ষিত অধিকার।

লেখক : ব্রিটেন প্রবাসী কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস