শিক্ষার্থীরা রাস্তায়, বাসে মার খাচ্ছে শ্রমিকরা, সমাধান কত দূর
ইয়াহিয়া নয়ন
হাফ পাশ আর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ক্লাশ ছেড়ে রাস্তায় নেমেছে শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকরা রয়েছেন চরম উৎকণ্ঠায়। ওদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ঠ বিভাগ ক’দিন পরপরই পরিবহন মালিকদের সঙ্গে মিটিং করে চলেছে। সমাধান এখনও আসছে না। জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, পরিবহন নৈরাজ্যের কাছে কি রাষ্ট্রযন্ত্র এতটাই অসহায়?
২৫ নভেম্বর রাজধানীর বিজয় সরণিতে গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে তুলকালামকাণ্ড ঘটে যায়। অধিকাংশ যাত্রী কন্ডাক্টরের চাহিদা অনুযায়ী ভাড়া দিলেও বেঁকে বসেন দু-তিন নিয়মিত যাত্রী। সরকারি নির্দেশার বাইরে তারা কানাকড়িও বেশি দেবেন না। বাসচালক-কন্ডাক্টর-হেলপারও নাছোড়বান্দা। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি, কিল-ঘুষি ও মারামারি শুরু হয়ে যায়। যাত্রীদের মারের চোটে হেলপারের নাক ফেটে রক্ত ঝরে। ইদানিং বাড়তি ভাড়া আদায় করে বাসের চালক-কন্ডক্টরকে জরিমানাও দিতে হচ্ছে। মোহাম্মদপুর রুটে ১৩ টাকার স্থলে ৩০ টাকা ভাড়া নেওয়ায় রজনীগন্ধ্যা পরিবহনের একটি বাসের চালককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাস-চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের অভিযোগ-বাসমালিকদের চুক্তিভিত্তিক টাকা দিতে গিয়ে তাদের বাধ্য হয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে হয় এবং অন্য বাসের সঙ্গে রেষারেষিতে যেতে হয়। এজন্য যাত্রীদের সঙ্গে তাদেরই মুখোমুখি হতে হয়। মারামারি ও সংঘাতে যেতে হয়। মার খেয়ে তাদের শরীর থেকেই রক্ত ঝরে। কিন্তু বাস মালিকরা ঘরে বসে শুধু মুনাফাটা কেড়ে নেন। তাদের কারও মুখোমুখিও হতে হয় না। মার খেতেও হয় না। শিকড় পরিবহনের একজন চালক আমাকে বলেছেন আরেক কথা। তার মালিক তাকে বলেছেন, সিটিংয়ের ভাড়া নিবি, ওয়েবিল চলবে। পারলে গাড়ি চালা নইলে চলে যা, লোকের অভাব নাই। বিনয়ের সাথে সেই চালক বললেন, ভাই এখন পেটের দায়ে কাজ করছি। প্রতিদিন পাবলিকের মার-গালি খাচ্ছি। কোই যামু কন?
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে বাসচালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কেউ বেতনভুক্ত নন। মাসিক বেতনের আওতায় তাদের নেওয়া হচ্ছে না। বাস মালিকরা পরিবহন শ্রমিকদের দিনমজুর হিসাবেই ব্যবহার করছে। বাসচালকদের এক নেতা জানান, ২০১৮ সালের আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর মালিক সমিতি রাজধানীতে চুক্তিতে বাস চালানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত তারা আজও বাস্তবায়ন করেননি। জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে আমাদের বাস চালাতে হয়। অনেক সময় মাথা ঠিকও থাকে না। প্রতিবাদও করতে পারি না। কারণ নিজের তো গাড়ি নেই। গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেই না খেয়ে থাকতে হয়। রাজধানীর শতকরা ৯৯ শতাংশ বাস চুক্তির ভিত্তিতে চলে। এক্ষেত্রে চালক-হেলপার-কন্ডক্টাররা একেবারেই অসহায়।
রাজধানীতে চার হাজারের মতো বাস (গাড়ি) রয়েছে। বাস মালিকদের প্রতিশ্রুতি ছিল-চালককে প্রতিদিন ১৫০০ টাকা, সহকারী চালককে ৭৫০ এবং হেলপারকে ৭৫০ টাকা দেওয়া হবে। বিনিময়ে প্রতিদিন বাসে যে পরিমাণ টিকিট বিক্রির টাকা তা মালিকের হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী বাসমালিককে শুক্র ও শনিবার বাসপ্রতি প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা এবং রোববার থেকে বৃহস্পতিবার বাসপ্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিনের টাকা উঠাতে গিয়ে তাদের (চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার) হিমশিম খেতে হয়। বাধ্য হয়েই তারা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন। প্রতিদিন সিটি করপোরেশনকে বাসপ্রতি ৬০ টাকা ‘চাঁদা’ দিতে হয়। এছাড়া পুলিশ-ট্রাফিক পুলিশদের টাকা দিতে হয়। চালক-কন্ডাক্টারদের সাথে আলাপকালে তারা আরও জানান, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিতে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু মালিককে প্রতিদিন যে নির্ধারিত টাকা দিতে হয়, হাফ ভাড়া কার্যকর হলে আমাদের আয় কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে তো মালিক কম টাকা নেবে না। ইদাীিং সড়কে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে গেছে জানিয়ে একাধিক চালক জানান, বাধ্য হয়ে সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে তাদের অতিরিক্ত ভাড়া নিতে হচ্ছে। ওদিকে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে আশি ভাগ বাস মালিকরা নিজেদের গরিব বলে অনুদান-ভর্তুকি চাচ্ছেন।
চালকরা জানান, আগে বাস চালাতেন জমা হিসাবে। দিনের শেষে মালিককে জমার টাকা বুঝিয়ে দিতে হতো। জমার টাকা, গ্যাস, তেল, লাইন খরচ তোলার পরে নিজের আর হেলপারের (সহকারী) আয় তোলা লাগত। এখন প্রতি ট্রিপ হিসাবে টাকা দিতে হয়। ট্রিপ কম হলে আয় কমে যায়। ট্রিপ কম হয়েছে-এমন অনুরোধ মালিকপক্ষ বোঝে না। ফলে ট্রিপের জন্য আমরা (চালক) বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালাই। এ কারণে একই রুটের (পথ) ও একই পরিবহন এবং অন্য পরিবহনের বাসের সঙ্গে আমাদের রেষারেষি করতে হয়।
সর্বশেষ ১১ আগস্ট লকডাউন উঠে যাওয়ার পর গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়। তখন ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে পরিবহন চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাসে উপচেপড়া ভিড় হওয়া স্বত্ত্বেও বাসমালিক সংগঠনগুলো ক্রমবর্ধমান অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেছে। সর্বশেষ ৪ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বাড়ানো হয়। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে সরকার বাসভাড়া ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করে। সিটিং ও গেটলক সার্ভিস সরকার বন্ধ করলেও সিটিং ও চেকের (ওয়েবিল) নামে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ডিজেল চালিত পরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হলেও সিএনজি চালিত পরিবহনের ভাড়াও বাড়ানো হচ্ছে। ডিজেল-সিএনজি একাকার হয়ে গেছে। প্রায় ক্ষেত্রে সিএনজিচালিত বাস হলেও তাতে ডিজেলচালিত স্টিকার লাগানো হচ্ছে এবং ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া আদায় করা হচ্ছে (এক প্রকার জোর করে)।
যাত্রীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম ও বাসভাড়া বাড়ানো একেবারে অযৌক্তিক। এছাড়া অধিকাংশ বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা বাসের একাধিক স্থানে টানিয়ে রাখার নির্দেশনা মানা হয় না। ভাড়া নিয়ে কোনো ঝামেলা হলে বাসচালক, কন্ডাক্টর ও হেলপাররা অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে। তাদের অধিকংশের মুখে ভাষা জঘন্য। তাদের (চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপার) অধিকাংশ নেশাগ্রস্ত। যত্রতত্র বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠানো-নামানো এবং বাসগুলোর মধ্যে রেষারেষিতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। যাত্রীসহ পথচারীরা মারাও যাচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম